নিখাদ বার্তাকক্ষ : বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বুধবার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৩ তম জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে ছিল, সকালে কবির সমাধিতে পুস্পস্তবক অর্পণ, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। জাতীয় পর্যয়ে এবার কবির জন্মবার্ষিকীর মুল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় কুমিল্লায়।
নজরুল স্মৃতি বিজড়িত কুমিল্লার বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন প্রাঙ্গণে (টাউন হল) সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় কুমিল্লা জেলা প্রশাসন আয়োজিত জাতীয় পর্যায়ে কবির জন্মবার্ষিকী উদযাপনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এমপি’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর।
স্মারক বক্তৃতা করেন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও নজরুল গবেষক শান্তি রঞ্জন ভৌমিক।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সিমিন হোসেন (রিমি) এমপি, কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. ক. ম. বাহাউদ্দিন বাহার, সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য রওশন আরা মান্নান এবং কবি পৌত্রী খিলখিল কাজী ও মিষ্টি কাজী। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান। পরে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে নৃত্যনাট্যসহ ৩০ মিনিটের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়।
অনুষ্ঠানে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, মানুষের মুক্তি আর সাম্যের জয়গানে নজরুল ছিলেন স্বতন্ত্র । তিনি বলেন, ‘বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করা অন্য কবিদের সাথে কাজী নজরুল ইসলামের পার্থক্য হচ্ছে, তিনি মুক্তির পক্ষে, সাম্যের পক্ষে, নির্যাতিতদের পক্ষে কথা বলেছেন। তার কবিতা ও গান মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছে। কবিতা লেখার কারণে তাকে বারংবার কারাগারে যেতে হয়েছে। তার কবিতা ও গান বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। সে কারণে তার সাহিত্যকর্ম তাকে অনন্য করেছে। সে জন্যই কাজী নজরুল ইসলাম অন্য কবিদের থেকে স্বতন্ত্র।’
তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি যে কবি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন তিনি হচ্ছেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। অন্য কবিদের চাইতে নজরুলের স্বাতন্ত্র্য হচ্ছে, অন্য কবিরা কবিতা লিখেছেন, সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। কিন্তু কাজী নজরুল শুধু সাহিত্যকেই সমৃদ্ধ করেছেন তা নয়, তিনি মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে তিনি ত্বরান্বিত করেছেন। একজন কবি যে মানুষকে উদ্দীপ্ত করতে পারে, মুক্তিকামী মানুষকে সাহস জোগাতে পারে, মানুষকে যে বিদ্রোহী করতে পারে, সেটির প্রমাণ হচ্ছেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।’
‘একইসাথে দ্রোহ, মুক্তি, সাম্য ও সম্প্রীতির কবি নজরুল যখন বাংলা তথা ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক হানাহানি চলছিলো, তখন সম্প্রীতির মন্ত্র উচ্চারণ করে লিখেছেন- মোরা একই বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু মুসলমান, মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তার প্রাণ’ স্মরণ করেন ড. হাছান।’
হাছান মাহমুদ বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আগে বাঙালি জাতির পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালির জন্য কোনো রাষ্ট্র কখনো রচিত হয়নি। বাংলা ভাষাভাষি কিছু কিছু এলাকা নিয়ে বিভিন্ন সময় স্বাধীন রাজা ছিলো কিন্তু কোনো স্বাধীন রাজ্য বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাজার বছরের ঘুমন্ত বাঙালিকে জাগ্রত করেছেন এবং এ জন্য কাজী নজরুল ইসলামের কাছ থেকেও তিনি মুক্তির পক্ষে, সাম্যের পক্ষে কথা বলার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন, অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। সেই কারণে বঙ্গবন্ধু মুজিব ১৯৭২ সালে ইন্দিরা গান্ধীকে বলে কবিকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন।’ পরে তিনি অনুষ্ঠানের সভাপতি এবং অতিথিদের সাথে নিয়ে বেলুন উড়িয়ে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন।
সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, ‘কবিতার ইতিহাসে কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ এক অনন্য সাধারণ রচনা। এক রাতেই তিনি বাংলা তথা বিশ্বসাহিত্যের অনবদ্য এ কবিতাটি রচনা করেছেন। মাত্র ২২ বছর বয়সে ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে নজরুল রচনা করেন ১৪১ পংক্তির এই ভুবন বিজয়ী কবিতা যার প্রথম শ্রোতা ছিলেন মুজাফফর আহমদ।’
এর আগে সকালে রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন কবির সমাধিতে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ হতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এমপি’র নেতৃত্বে সকাল সাড়ে ছয়টায় কবির সমাধিতে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ হতে পুস্পস্তবক অর্পণ করা হয়। এ সময় মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুরসহ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদাসহ বিভিন্ন দপ্তর-সংস্থার কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
আওয়ামী লীগের পক্ষে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে নিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহা উদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, কেন্দ্রীয় নেতা ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, সাংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আবদুস সবুর, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, উপদপ্তর সম্পাদক সায়েম খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
জাতীয় কবির স্মৃতি বিজড়িত ময়মনসিংহের ত্রিশাল, কুমিল্লার দৌলতপুর, মানিকগঞ্জের তেওতা, চুয়াডাঙ্গার কার্পাসডাঙ্গা এবং চট্টগ্রামে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ও স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৩ তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হয়। এ উপলক্ষে নজরুল মালা, নজরুল বিষয়ক আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে স্থানীয় প্রশাসন।
বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ-রাগিনী সৃষ্টি করে বাংলা সঙ্গীত জগতকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তার কবিতা, গান ও সাহিত্য কর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। তাঁর লেখনি জাতীয় জীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তাঁর কবিতা ও গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশে তাঁর বসবাসের ব্যবস্থা করেন। ধানমন্ডিতে কবির জন্য একটি বাড়ি প্রদান করেন।