মিজানুর রহমানঃস্টাফ রিপোর্টার।
সরকারি পরিপত্র অনুসারে একজন কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের একটি প্রকল্পের পরিচালক হবেন। বিশেষ প্রয়োজনে অনুমোদন সাপেক্ষে সর্বোচ্চ দুটির দায়িত্ব পেতে পারেন। তবে সরকারি এ নীতিমালার ধার ধারে না জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীন এ প্রতিষ্ঠানটি তাদের এক পরিচালককে (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) একসঙ্গে ১১টি প্রকল্পের দায়িত্ব দিয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, এনএসসিতে গড়ে ওঠা একটি সিন্ডিকেটকে প্রকল্পের টাকা নয়ছয়ের সুযোগ করে দিতেই এক ব্যক্তিকে এতগুলো প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ জন্যই পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) পক্ষ থেকে সরকারি নীতিমালা অনুসরণে চিঠি দেওয়া হলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে উপেক্ষিত হয়েছে মন্ত্রণালয়ের সুপারিশও।
এই ১১ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. শাহ আলম সরদার। বছরখানেক আগে থেকে তিনি মোট ১৯৪ কোটি ৩৮ লাখ ৯০ হাজার টাকার বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পগুলো সামলাচ্ছেন। এর আগে তাঁর স্থলে ছিলেন জাতীয় ক্রীড়া সংস্থার পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মু. শুকুর আলী।
১১ প্রকল্পে একই কর্মকর্তাকে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ কোনোভাবেই ঠিক নয় মন্তব্য করে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারের পরিপত্র অবশ্যই মানা দরকার। আমি বিষয়টি জানতাম না। এটা একেবারেই ঠিক নয়। আইএমইডি থেকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে অথচ তারা মানছে না, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য আচরণ নয়।’
কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে স্বীকার করে মন্ত্রী বলেন, ‘আমি চেষ্টা করছি এটাকে বন্ধ করার জন্য। তবে একটু সময় লাগছে।’ এ বিষয়ে তিনি খোঁজ নেবেন বলে জানান।
এনএসসির বিভিন্ন প্রকল্পের সংক্ষিপ্তসার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিভিন্ন সময় অনুমোদন হওয়া এই ১১ প্রকল্পের ১০টিই নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। ফলে বেশ কয়েকটির ব্যয় বাড়াতে হয়েছে। অবশ্য আইএমইডির সহকারী পরিচালকের চিঠিতে প্রকল্পের সংখ্যা ১২টি উল্লেখ আছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতগুলো প্রকল্পের পরিচালক একজন হওয়ায় কাজের মান, সময় কোনোটিই সঠিকভাবে তত্ত্বাবধান হয়নি। আর নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প শেষ না হওয়াটাই যেন এনএসসিতে রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, প্রকল্প শুরুর পর এর নানা কিছু সংযোজন করে পরিধি বাড়ায় এনএসসি, যা প্রকল্প প্রণয়নের সময়ই করার কথা। এতে করে সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হয়, প্রকল্পের ব্যয়ও বেড়ে যায়। কয়েকটি প্রকল্পের কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয়রা।
তবে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিব মো. মাসুদ করিম বলেন, লোকবল সংকট থাকায় এক কর্মকর্তাকে একাধিক প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এই রীতি অনুসরণ করা হচ্ছে।
সরকারি পরিপত্রের লঙ্ঘন
প্রকল্প পরিচালক নিয়োগসংক্রান্ত পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা পরিপত্রের ৪.১, ৪.২ ও ৪.৩ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী একজন কর্মকর্তাকে সর্বোচ্চ দুটির বেশি প্রকল্প পরিচালক করা যাবে না।’ আর ৪.৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘ইতিমধ্যে যেসব কর্মকর্তা একাধিক প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন তাঁদের অনুচ্ছেদ ৪.৩-এ বর্ণিত কমিটির সুপারিশ গ্রহণ করা না হলে দুটি প্রকল্পের বেশি প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব (যদি থাকে) থেকে অব্যাহতি দিতে হবে।’
মানা হয়নি মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা-২ শাখা থেকে সহকারী প্রধান মো. তাজুল ইসলাম স্বাক্ষরিত একটি চিঠি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ১১টি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার জন্য ১২-১২-২০১৭ তারিখে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দুটি প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে পঞ্চম গ্রেড বা তদূর্ধ্ব একজন কর্মকর্তাকে নিয়োগের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
তবে মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ আমলে না নিয়ে ২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিব মো. মাসুদ করিম যুব ও ক্রীড়া সচিব বরাবর এক চিঠিতে ওই দুটিসহ ১১টি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে এনএসসির পরিচালককে (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়ার অনুরোধ জানান।
উপেক্ষিত আইএমইডির সুপারিশ
২০১৯ সালের ১৬ ও ১৭ সেপ্টেম্বর বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সহকারী পরিচালক মো. তাজুল ইসলাম ফরিদপুর উপজেলার ভাঙ্গা উপজেলা স্টেডিয়াম নির্মাণ প্রকল্পটি সরেজমিন পরিদর্শন করে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠান। এতে তিনি লেখেন, আলোচ্য প্রকল্পের আওতায় একজন পরিচালককে ১২টি প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এটা কিভাবে সম্ভব তা বোধগম্য নয়। এ ব্যাপারে সরকারি নীতিমালা অনুসরণ প্রয়োজন। নির্মাণসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির কারণে ডিপিপি সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে প্রতিবেদনটিতে এমন পর্যবেক্ষণও স্থান পেয়েছে।
এনএসসি কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) এবং ১১টি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. শাহ আলম সরদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি আসলে খণ্ডকালীন প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে আছি। এটা আমার অতিরিক্ত দায়িত্ব। এ বিষয়ে এনএসসির সচিব মহোদয় আপনাকে বিস্তারিত বলতে পারবেন।’
জানতে চাইলে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিব মো. মাসুদ করিম বলেন, ‘এনএসসিতে পরিচালক পর্যায়ে লোকবলের সংকট আছে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ও অবহিত আছে। দীর্ঘদিন ধরে এই রীতি অনুসরণ করা হচ্ছে।’ একই কর্মকর্তা একাধিক প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে থাকলে কাজে বিঘ্ন হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে মাসুদ করিম বলেন, ‘তারপরও যেহেতু সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিতে হয়, প্রকল্প চলমান রাখতে হয় সে জন্য আমরা একই কর্মকর্তাকে একাধিক প্রকল্পের দায়িত্ব দিয়ে থাকি। এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে।’
যে ১১ প্রকল্পের দায়িত্বে একজন
কিশোরগঞ্জ জেলার সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্টেডিয়াম উন্নয়ন এবং ভৈরব উপজেলায় সৈয়দ আইভি রহমান স্টেডিয়াম নির্মাণ (সংশোধিত) প্রকল্প, নাটোর ও গাইবান্ধা জেলা সদরে ইনডোর স্টেডিয়াম নির্মাণ (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্প, জামালপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আব্দুল হাকিম স্টেডিয়াম কমপ্লেক্স উন্নয়ন প্রকল্প, শেরপুর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি স্টেডিয়াম উন্নয়ন এবং ইনডোর স্টেডিয়াম নির্মাণ প্রকল্প, সিলেট জেলা স্টেডিয়াম এবং আবুল মাল আবদুল মুহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্সের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প, মুন্সীগঞ্জ জেলা স্টেডিয়াম এবং বিদ্যমান সুইমিং পুলের অধিকতর উন্নয়নসহ ইনডোর স্টেডিয়াম ও টেনিস কোর্ট নির্মাণ প্রকল্প, সিলেট বিভাগীয় ক্রিকেট কমপ্লেক্সের আউটার স্টেডিয়ামের উন্নয়ন এবং মাগুরা বীর মুক্তিযোদ্ধ আছাদুজ্জামান আউটার স্টেডিয়াম উন্নয়নসহ জাতির পিতার ম্যুরাল স্থাপন প্রকল্প, নেত্রকোনা জেলা সদরে ইনডোর স্টেডিয়াম, খেলোয়াড়দের জন্য ডরমেটরি ভবন নির্মাণ এবং বিদ্যমান টেনিস কমপ্লেক্সের উন্নয়ন প্রকল্প, রাজধানীর পল্টন কাবাডি ও ভলিবল স্টেডিয়ামের উন্নয়ন প্রকল্প, ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলা স্টেডিয়াম নির্মাণ প্রকল্প, মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলা স্টেডিয়াম এবং দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলা স্টেডিয়াম উন্নয়ন প্রকল্প। এর মধ্যে শেষেরটি ছাড়া সব কটিরই মেয়াদ শেষ হয়েছে। ব্যয় বাড়ানো হয়েছে বেশির ভাগের