মিজানুর রহমানঃস্টাফ রিপোর্টার।
অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের পর্ব পেরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ আজ এক চরম বাস্তব ব্যাপার। এ কথা সর্বজনবিদিত যে, একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামের দীর্ঘ ন’মাসের ত্যাগ ও তিতিক্ষার অবসানে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। বাংলা ও বাঙালির স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে উপযুক্ত সম্মান ও সম্ভ্রমের সঙ্গে জায়গা করে নিতে পেরেছে যে মানুষটার জন্যে, তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
ইতিহাসের পাতা থেকে তাঁর নাম মুছে ফেলার অনেক অপচেষ্টা হয়েছে এই রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই। তবে সবংশে তাঁকে নির্মম হত্যার পরেও তিনি থেকে গেছেন বাঙালির হৃদয় ও মননের সমস্ত সত্তা জুড়ে। তাঁর এই অর্জন সম্ভব হয়েছে তাঁর সারা জীবনের ত্যাগের বিনিময়ে, যে ত্যাগ ছিল বাংলা ও বাঙালির জন্য সর্বৈব নিবেদিত।
১৯৬৯ সালের উত্তাল দিনগুলোয়, যখন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সমগ্র পূর্ব বাংলার মানুষজন সংগ্রামমুখর, তখনই তাঁর নামের আগে বঙ্গবন্ধু অভিধাটি যুক্ত করেন ওই দেশের আপামর সাধারণ মানুষ। দেশবন্ধু, নেতাজি, শের-এ-বাংলার পরে বাঙালি জাতি পেয়েছিল বাংলার এক জন প্রকৃত বান্ধব। তাই ওই শিরোপাটি তাঁর শিরস্ত্রাণে পরিয়ে দিতে কারও মনে কোনও কুণ্ঠা ছিলনা। তখনকার পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ইতিহাসের এক দুর্মর ঘুর্ণাবর্ত তাঁকে এই অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে গড়ে তুলেছিল। তবে তাঁর দেশপ্রেম ও নিষ্ঠা ছিল আকাশচুম্বী এবং তার লক্ষণ যৌবনকালেই তাঁর মধ্যে দেখা দিয়েছিল। তারপর ধাপে ধাপে তা পরিণতির দিকে এগোতে থাকে।
শেখ মুজিবের মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার লক্ষণ তাঁর ছাত্রাবস্থাতেই দেখা দেয়। বস্তুত, স্নাতক শ্রেণিতে পাঠরত অবস্থাতেই তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা বিকশিত হয় এবং তিনি দেশ ও দশের কাজে ক্রমশ জড়িয়ে পড়েন। তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে যুক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী (১৯৪৬) হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী তাঁকে তাঁর পিতৃভূমি গোপালগঞ্জ মুসলিম লিগের শাখা এবংমুসলিম ছাত্র সংগঠন গড়ে তুলতে বলেন।
সেই কাজ অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গেই তিনি করতে পেরেছিলেন। অত্যন্ত ব্যক্তিত্বপূর্ণ তাঁর চেহারা, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল অসাধারণ বাগ্মিতা। তাঁর ভাষণের মধ্যে মিশে থাকত দেশজ উপমা উৎপ্রেক্ষার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলাম। কবিগুরুর ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি তাঁর সমগ্র সত্তা জুড়ে এমন ভাবে ছিল, যা উত্তরকালে স্বাধীনদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মর্যাদা পায়। তাঁর সাতই মার্চের ভাষণ শুনলেই বোঝা যায়, অতি সংক্ষেপে বলবার বিষয়টি বুঝিয়ে বলার ক্ষমতা তাঁর কতখানি !
শ্রোতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করার অবিস্মরণীয় এই ক্ষমতাই শুধু নয়, একই সঙ্গে অতি সাধারণ গ্রামীণ মানুষ ছাড়াও তিনি শহরের শিক্ষিতজনের সঙ্গেও সহজে মিশে যেতে পারতেন। এক দিকে ছিল গ্রামের সঙ্গে তাঁর নাড়ির যোগ এবংঅন্য দিকে অনেক দিন কলকাতা শহরে থাকার সুবাদে নাগরিক বোধের সঙ্গেও তিনি সুপরিচিত ছিলেন।
তাঁর রাজনৈতিক জীবন মুসলিম লিগের ছত্রছায়ায় শুরু হলেও দেশভাগের বছরের প্রারম্ভেই তিনি ওই দল ত্যাগ করেন। দেশভাগের পরে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিমা প্রভুদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের প্রবণতা তাঁকে নানা ভাবে আলোড়িত করে। ওই সময় তিনি ক্রমান্বয়ে অনুভব করেন দ্বিজাতিতত্ত্বের অসারতা। এই তত্ত্ব যে কেবল ক্ষমতা লাভের একঅনিবার্য হাতিয়ার, তা-ও তিনি মর্মে মর্মে অনুভব করেন। এ ভাবেই তিনি আস্তে আস্তে বাঙালি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন।
মুসলিম লিগ থেকে নিজেকে সরিয়ে সেই সময় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘গণতান্ত্রিক যুব লিগ’। একই সময়ে তিনি ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লিগ’ গঠন করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি নবগঠিত আওয়ামি মুসলিম লিগ’-এর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন, পরে ১৯৫২ সালে এই দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হয়ে দলকে সুসংগঠিত করেন। অচিরেই এই দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদপড়ে শুধু আওয়ামি লিগ হিসেবে পরিচিত হয় এবং হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে দেশের আপামর সাধারণ মানুষের দল হয়ে ওঠে এবং তাঁর নেতৃত্বে সমস্ত পূর্ব বাংলায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন গণমানসে এক নতুন চিন্তা চেতনার জন্ম দেয়। স্বাধিকার অর্জনের এক দুর্মর সাহস একটু একটু করে সবার মধ্যে বিস্তার লাভ করে তাঁরই নেতৃত্বে। ১৯৫৪ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে তিনি পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হন। ’৫৪ সালের আগে তিনি চার বার কারাবরণ করেন। ’৫৪-র পরে কয়েক বার তিনি নানা বিভাগের মন্ত্রী নির্বাচিতহন।
মন্ত্রিসভায় বাঙালি আধিপত্য এবং মুসলিম লিগ বিরোধী জোটের কারণে পশ্চিমা প্রভুদের উস্কানি দেশে নিরন্তর এক অশান্তির জন্ম দেয়। এরই ফাঁকফোকর দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব খানের নেতৃত্বে মার্শাল ল’ জারি হয়। দেশব্যাপী নেমে আসে এক অশান্তির কালোছায়া। সমগ্র পূর্ব বাংলায় চালু হয় এক অঘোষিত স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। সাধারণ মানুষের মনে জমতে থাকেক্ষোভ, দেখা দেয় দ্রোহকালের অশনি সঙ্কেত। আপাত নিরীহ অতি সাধারণ মুখচোরা ও গোবেচারা বাঙালিও ক্রমশ ফুঁসতে থাকে এই অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে।
এই পরিস্থিতিতেই কালক্রমে শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন পূর্ব বাংলার অবিসংবাদিত নেতা ‘বঙ্গবন্ধু’, যার চূড়ান্ত পরিণতি তাঁর ছয় দফা আন্দোলন এবং যা ক্রমান্বয়ে দেশের মুক্তিসংগ্রামে পর্যবসিত হয়। প্রকৃতপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের দমনপীড়ন নীতির কারণে সারা পূর্ব বাংলায় তখন এক অভূতপূর্ব গণ জাগরণ ঘটে। দেশের সাধারণ নির্বাচনে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করার পরেওআওয়ামি লিগকে সরকার গড়তে দেওয়া হয় না। উপরন্তু মিলিটারি শাসনের কালো ছায়া সারা পূর্ব বাংলাকে গ্রাস করে। তাই ওই দেশে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে।
এই যুদ্ধে ভারতের প্রত্যক্ষ সাহায্য এবং সোভিয়েত রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সমর্থন স্বাধীন বাংলাদেশকে বাস্তব করে তোলে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এই দেশের জন্ম এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিতহয়। পাকিস্তান অর্জনের মূল আদর্শ দ্বিজাতিতত্বকে ভুয়ো প্রমাণ করার জন্য কতখানি অনিবার্য ছিল এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, তা আজ ইতিহাস অনুসন্ধানের বিষয়।
কিন্তু বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ যে একটি কঠিন বাস্তব ব্যাপার তা ওই দেশের স্বাধীনতা অর্জনের এই ৪৮ বছরের প্রাক্কালে খুব জোর দিয়েই বলা যায়। ওই দেশের ক্রমশ স্বনির্ভর হয়ে ওঠার যে নজির আমরা দেখতে পাইতা-ও বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য। আজ ওই দেশের অর্থনৈতিক প্রগতি এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক অগ্রগতি বিশেষ ভাবে উল্লেখ করার মত।
তবে যে ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, তার পিছনে সবচেয়ে বড় যাঁর অবদান সেই বঙ্গবন্ধুকেই ১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট পাকিস্তানপন্থী ঘাতকদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল। ’৭১ থেকে ’৭৫, এই অল্প কয়েকটি বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ বিরোধী শক্তি এমন ভাবে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে যে ওই দেশে ধীরে ধীরে স্বৈরতান্ত্রিক শক্তি মাথা তুলে দাঁড়ায়।সারা দেশে এক চরম অস্থিরতা ও অশান্তি দেখা দেয়। স্বাধীনতার পক্ষের চিন্তা চেতনার বিলোপ ঘটাতে সামরিক শক্তির অশুভ কালোছায়া সারা দেশকে গ্রাস করে।
সেই অপশক্তিকে হটাতে দীর্ঘ কুড়ি বছর অপেক্ষা করতে হয়। এই কুড়ি বছরে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে। দেশের অগ্রগতি নানা কারণেই ব্যাহত হয়। সুখের কথা, শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য উত্তরাধিকারিণী, তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা পিতার আরব্ধ ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করার জন্য তাঁরই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে আওয়ামি লিগের হাল ধরেন এবং সাধারণমানুষের আস্থা অর্জন করে ক্ষমতায় আসেন। এক বার নয়, দু’বার নয়, চার বার। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি আজ তাই একান্ত ভাবেই চোখে পড়ার মতো।
তবে এ কথাও ঠিক, যে ’৭৫-এর পরে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা-সহ সংবিধানের বেশ কিছু পরিবর্তন ওই দেশকে প্রগতির পথ থেকে অনেকটাই সরিয়ে এনেছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি তাঁর আত্মীয়-পরিজন ও ঘনিষ্ঠ অনুগামীদের কয়েক জনকে হত্যা করে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তিমুছে দিতে চেয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের নাম, সেইসঙ্গে তাঁর নীতি ও আদর্শের জলাঞ্জলি দিয়ে পাকিস্তানেরই পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন তারা। প্রকৃতপক্ষে সেই কাজে তারা অনেকটাই সাফল্যও পায়।
মনে রাখা দরকার, সত্তরের নির্বাচনে অভুতপূর্ব সাফল্য পেলেও তার বিপক্ষে পড়েছিল ২৮% ভোট। সেই ২৮ ভাগ অপশক্তিই ফুলে ফেঁপে বাংলাদেশের বিরোধী শক্তি হিসেবেপাকিস্তানি আধিপত্যের বিস্তার ঘটাতে চাইছে। তবে নানা ঘটনাবর্তে সেই অপশক্তিকে পরাহত করেছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। পরবর্তীকালে শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছে। ফিরে এসেছে শেখ মুজিবুর রহমানের নীতি ও আদর্শ।
বাংলাদেশ আর শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় দু’টি সমার্থক শব্দ । পাকিস্তানের অপশাসন থেকে মুক্তিলাভের জন্যেই এই রাষ্ট্রের জন্ম । এই রাষ্ট্রের জন্ম বাঙালি চিন্তা চেতনার এই পীঠস্থান হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে। তাই শেখ মুজিবকে অস্বীকার করলে বাংলাদেশের অস্ত্বিত্বেরও কোনও মূল্য নেই। এই দেশকে পাকিস্তানের পদানত করার স্বপ্ন যাঁরা দেখেন তাঁরা আসলে এক আত্মঘাতীচক্রান্তেরই প্রণেতা। কেননা সেটা যদি দুঃস্বপ্নেও সম্ভব হয় তা হলে বাংলাদেশ এই নামটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে। তাই স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ টিকে থাকলে এই রাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবুর রহমানও টিকে থাকবেন। কেননা জন্মদাতাকে অস্বীকার করে কারও পরিচয় যেমন অর্থহীন, তেমনই বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রশ্নে শেখ মুজিবও অনিবার্য।