এটাও বাংলাদেশ, এটাই বাংলাদেশ

অন্যান্য প্রচ্ছদ


মতামত : ডা. মামুন-আল-মাহতাব (স্বপ্নীল)

আগের দিন বিকেল থেকে জ্বর, সর্দি আর সাথে আবার পেটটাও খারাপ। যদিও রাতেই এন্টিজেন টেস্ট আর রক্ত পরীক্ষাগুলো বলছে কোভিড নাই, তারপরও দুরু দুরু বুকে ঘুমাতে গেছি, পাছে না আবারো কোভিডে কুপোকাত হই এই শংকায়। পিসিআর রিপোর্ট আসবে সেই দুপুরে। সকালে শরীর খারাপ আর পিসিআর রিপোর্ট হাতে না পাওয়ায় হাসপাতল মুখো হইনি। ঘুমটা ভাঙলো প্রথমে পিসিআরের নেগেটিভ রিপোর্টে আর তারপর পিযূষদা আর রেজা সেলিম ভাইয়ের পরপর দুটো ফোনে।

তাদের কাছেই প্রথম জানলাম দুঃসংবাদটি, কুমিল্লার ঘটনাটি যা এখন বহুল আলোচিত আর যথেষ্টই পুরোনো। এর পরে কয়েকটা ঘন্টা কাটলো সম্প্রীতি বাংলাদেশ আর ব্যক্তিগত যোগাযোগগুলোকে কাজে লাগিয়ে কুমিল্লা, বরং বলা ভালো, দেশজুড়ে প্রগতিশীল মানুষগুলোকে চাঙ্গা করা আর পরিস্থিতি বিশ্লেষণে। পর্যবেক্ষণ করছিলাম আর পাশাপাশি যখন বুঝতে চাচ্ছিলাম কি হচ্ছে আর কি হতে পারে, একটা বিষয় বুঝতে পারছিলাম না কোনভাবেই। কোন পাগলও যে দেবতার প্রতিমার নিচে আমাদের পবিত্রতম ধর্মগ্রন্থটিকে রেখে নিজের পায়ে নিজেই কুড়ালের অমন আঘাত করবে না, এটাতো পাগলেও বোঝে। তাহলে কেন বুঝতে পারছে না এতগুলো মানুষ। মনুষ্যত্ব আর ধর্মের শিক্ষাকে শিকায় তুলো কিভাবে ধর্মের নামে এমন আদিম বর্বরতায় মেতে আঠছে এই একবিংশ শতাব্দির ফেসবুক আর ইন্টারনেটের আলোয় আলোকিত এতগুলো মানুষ, তাও শুধু কুমিল্লায় নয়, দেশের আরো অনেকখানেই অনেক জায়গাতেই?

দুই.ফেসবুকে আমি সাধারণত বাহাসে জড়াই না। আমার স্ট্যাটাস সবার পছন্দ হবে এমন প্রত্যাশা আমি কখনই করিনা। কিন্তু কেউ যখন শালিনতার মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে আমার ওয়ালে কোন আগেও কমেন্ট করে বসে, আমি তখন বিনয়ের সাথে তাকে ব্লক করে দিয়ে তার কমেন্টটি ডিলিট করে দেই। অনেকটা ‘আমার ফেসবুক আমি চালাবো, শালিনতা আর শিষ্টতার ব্যত্যয় না ঘটিয়ে যেমন খুশি তেমন চালাবো’ এমনি একটা এপ্রোচ আরকি।

এবার শারদীয় দুর্গোৎসবের সময় বরাবরের মতই সম্প্রীতি বাংলাদেশ থেকে আমরা সাড়াদেশে অনেকখানেই অনেক মণ্ডপে শারদীয় শুভেচ্ছা আর সম্প্রীতির বানী সংবলিত ব্যানার ঝুলানোর ব্যবস্থা করেছি। পাশাপাশি আমাদের সংগঠনের সভ্যরা সারাদেশেই মণ্ডপে-মণ্ডপে যেয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সাথে শারদীয় শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। বরাবরের মতই আমি সেই বিষয়গুলো আমার ওয়ালে শেয়ারও করেছি। বিপত্তিটা বাধলো একটা বিশেষ স্ট্যাটাস নিয়ে। স্ট্যাটাসে লিখেছিলাম, ‘এটাও বাংলাদেশ, এটাই বাংলাদেশ’। দুটো ছবি জুড়ে দিয়েছিলাম স্ট্যাটাসটার সাথে। একটা ছবিতে কিছু মুলসমান ছেলে কোন একটা মণ্ডপে প্রতিমাকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে ছবি তুলছে আর অন্যটিতে একজন মাদ্রাসার ছাত্র একটি প্রতিমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারা শুধুই উৎসবের আমেজটা উপভোগ করছে মাত্র। স্ট্যাটাস দেয়ার পর আমাকে আমার ফেসবুক চালানোর ফর্মুলা মেনেই কমপক্ষে পঞ্চাশটা কমেন্ট ডিলিট করতে হয়েছে এবং অবশ্যই ব্লক করতে হয়েছে কমেন্টকারীদের। সাথে আনফ্রেন্ডও করতে হয়েছে বহুজনকে। এদের মধ্যে যেমন আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক এবং নার্স, তেমনি আছেন ইউকেতে কর্মরত বাংলাদেশী পেশাজীবী আর শিক্ষিত ও সুশীল হিসেবে পরিচিত আরো অনেকে। এরা যে শুধু ইসলাম ধর্মাবলম্বী তাই নন, আছেন অনেক সনাতন ধর্মাবলম্বীও। দেশটার একটা অংশ কখন কিভাবে এমন আস্তাকুড়ে গিয়ে পড়লো আর আমি বোকা কিছুই টের পেলাম না, এটা বোঝাই আপাতত আমার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

তিন.অষ্টমীর রাতে দেশের একটি প্রথিতযশা টিভি চ্যানেলের টকশোতে অংশ নিতে গিয়ে এসব বিষয়ের পোস্টমর্টেম করতে হলো। আমার ধারণা অনেক ঘাটাঘাটি করে আমি এসবের একটা উত্তর খুঁজে পেয়েছি। এ দেশটা হাজার এবং হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ এটি যেমন সত্য, তেমনি এটাওতো বাস্তবতা যে সেই ব্রিটিশ আমল থেকে আজ পর্যন্ত, শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারগুলো বাদ দিলে, যে বা যারা যখন যে নামে এই ভূখণ্ডকে শাসন করেছেন, তারা প্রত্যেকেই রাষ্ট্রীয়ভাবে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পৃষ্টপোষকতা করেছেন। ব্রিটিশ আমলের যে ‘বঙ্গ ভঙ্গ’ তা কিন্তু বাঙালির আত্মউন্নয়নের কোন উদ্যোগ ছিল না, বরং তা ছিল বাঙালির মগজে ঢোকানো যে এদেশে দুটো গোত্র আছে, একটা মুসলমান আর অন্যটা হিন্দু। আর এই দুই গোত্রের মানুষকে পারস্পরিক সহযোগিতা নয়, বরং প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। এরই ধারাবাহিকতা আমরা দেখেছি পাকিস্তানের চব্বিশ বছরে আর স্বাধীন বাংলাদেশে জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ার আমলেও। সত্তরের যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়, সেই নির্বাচনেও কম-বেশি ত্রিশ শতাংশ বাঙালির ভোট নৌকায় পড়েনি। অর্থাৎ এই মানুষগুলো তখনও পাকিস্তানই চেয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে এরা শুধু টিকেই থাকেনি বরং খেয়ে-পড়ে হৃষ্ঠ-পুষ্টও হয়েছে। এদের ছানাপোনারাই ‘মেরি মি আফ্রিদি’ কিংবা ‘আমি রাজাকার’ ব্যানার দেখিয়ে গর্ব বোধ করে।

আমার ব্যাখ্যায় টকশোটির সঞ্চালকের ঈষৎ আপত্তি। শত বছর বা অর্ধ শতাব্দি পুরাতন বিষয় কি করে আজকের বাংলাদেশে পার্টিনেন্ট হয়। আমার যুক্তিটাও সেখানেই। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে আমাদের নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রকৃত স্বাধীনতা ভোগের সময়কালতো মাত্র এক যুগের চেয়ে এক বেশি। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর থেকে আওয়ামী লীগের এই নিরবচ্ছিন্ন শাসনকালেইতো আমাদের যা কিছু অর্জন, যার বেশিরভাগটাই আবার কেটে গেছে যুগের পর যুগ পিছিয়ে পড়া দেশটাকে টেনে একটা জায়গায় তুলে আনতে। সময় খুব একটা দেয়া যায়নি আদর্শিক ভিত্তিটাকে মজবুত করায়।

সে কারণেই সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিষয়ে বিরোধীদের কোন অর্বাচীন সমালোচনার জবাব দিতে সরকার দলীয় নেতারা যতটা ত্বরিৎ এবং সরব, তার ঠিক বিপরীত চিত্রটি আমরা দেখি নাসিরনগর, বোরহানুদ্দিন কিংবা কুমিল্লার বেলায়। তারা প্রথমটায় কেমন যেন থতমত খেয়ে যান, তাকিয়ে থাকেন নির্দেশনার প্রত্যাশায়, তারপর বরাবরের মতই সামনে এগিয়ে আসেন সেই মহিয়সী নারী, নড়েচড়ে বসে দল থেকে শুরু করে প্রশাসনের সবাই আর আবারো এক সময় সব স্বাভাবিকের বাংলাদেশ সব কিছুকে ভুলে গিয়ে সামনে চলতে শুরু করে। কিন্তু এভাবে আর কত দিন?

চার.কুমিল্লা-কাণ্ড কারা ঘটিয়েছে বিরোধী দলীয় নেতার লিক হওয়া ফোনালাপ আর তাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্য পর্যালোচনা করলেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। এই বোকারা ইতিহাস থেকে শেখেনা। এরা কেন যেন ভুলে যায় ফ্রাংকেনস্টাইনের প্রথম শিকার হন কিন্তু তার স্রষ্টাই। যে তালেবানকে পেলে-পুষে বড় করেছে আমেরিকা, সেই তালেবানের কাছে নাকে খৎ দিয়েই তাদের আফগানিস্তান ছাড়তে হয়েছে। আবার তালেবানের পোষ্য আইএস খোরাসানের একের পর এক আত্মঘাতি বোমা হামলায় এখন নড়বড়ে আফগানিস্তানের উপর তালেবানী নিয়ন্ত্রণ।

এই বোকারা জানেনা যাদের ঘাড়ে ভর দিয়ে এরা ক্ষমতায় আসার দিবাস্বপ্নে বিভোর আর সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিতে গিয়ে তারা নোংরা করছে দেশের কিছু মানুষের মননকে, ক্ষমতায় আসলে এরাই তাদের ঘাড়গুলো মটকাবে সবার আগে। আর সরকার দলীয় যারা ভাবছেন এদের হালুয়া-রুটির টুকটাক ভাগ দিয়ে নিজেদের কোর্মা-পোলাও সুরক্ষিত রাখবেন, তারা যে অধমেরও অধম, সেটাতো বলাই বাহুল্য।

পাঁচ.শত বছরের পিছিয়ে পরা বাংলাদেশকে টেনে তোলার দায়িত্ব যিনি স্বেচ্ছায় নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন, সাম্প্রদায়িকতার জঞ্জালমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা সবাই এখন তার দিকেই তাকিয়ে আছি। তিনি হাসলেই হাসে যেমন বাংলাদেশ, তিনি কঠোর হলেই যে নড়েচড়ে বসে সবাই, এটা আরো একবার প্রমাণিত হলো এই দফায়। আপা সম্প্রতি দুটো কঠিন কথা বলেছেন যা আমাদের নতুন আশায় বুক বাঁধার শক্তি যোগাচ্ছে। তিনি সম্প্রতি বলেছেন ভালো মানুষগুলোকে তিনি একটা জায়গায় তুলে নিয়ে আসবেন। আর কুমিল্লাকাণ্ডের পর পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন দোষী প্রত্যেককে খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনা হবে। আপা যেভাবে তার জাদুর স্পর্শে দেশটাকে উন্নয়ন আর ঘুরে দাঁড়ানোর রোল মডেলে পরিণত করেছেন, তার পঞ্চম মেয়াদে বাংলাদেশ যে সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক মানুষদের বাসভূমিতে পরিণত হবে, আমি এখন মনে-প্রাণে তা বিশ্বাস করতে শুরু করেছি।

আমি এখন ২০২৩- এর পর সেই বাংলাদেশের প্রত্যাশায়, যেখানে উৎসব সত্যি সত্যিই হবে সবার। যেদিন আমাকে ‘এটাও বাংলাদেশ, এটাই বাংলাদেশ’ স্ট্যাটাসে কোন কমেন্ট ডিলিট করে কাউকে ব্লক করতে হবে না, আমি এবং আমরা সেই বাংলাদেশটার প্রত্যাশায় এখন আপার দিকে তাকিয়ে আছি।


লেখক : ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশনবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ওসদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *