দূরদর্শী সংগঠক শেখ মনি

প্রচ্ছদ রাজনীতি

#ড. মুহম্মদ মনিরুল হক

বাংলাদেশের স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে যে ক’জন তারকা ছাত্রনেতার সমাবেশ ঘটেছিল, বাঙালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উত্তুঙ্গ মুহূর্তে তাঁদের মধ্যে সবচাইতে বেশি দেদীপ্যমান হয়ে উঠেছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি। জাতীয় স্বাধীনতার প্রতীক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরে এই যুবনেতাই ছিলেন তৎকালীন আন্দোলনের সংগঠক ও কর্মীদের উপর সবচাইতে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব।

তিনি দু’বার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। বাঙালী, বঙ্গবন্ধু ও দেশাত্ববোধের চেতনায় উদ্দীপ্ত শেখ মনি ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে চ্যান্সেলর ও তৎকালীন গবর্নর মোনেম খানের কাছ থেকে সনদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে গণবিরোধী শিক্ষানীতির প্রতিবাদ করেন। ফলে সরকার তাঁকে প্রেফতার করে দেড় বছর জেলে বন্দী রাখে।

শেখ মনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, তেজস্বী ও সুদর্শন পুরুষ। স্বদেশের আদর্শ, সাহস ও শৌর্যকে আত্মস্থ করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন যুব সমাজের সম্মিলিত আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রতীক। তিনি বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। তিনি ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ দেশের শ্রমিকদের সংগঠিত করে ঐতিহাসিক হরতাল সফল করেছিলেন। ইতিহাসবিদরা বলেন, ওই হরতাল সফল না হলে বাঙালীর মুক্তি সংগ্রাম পিছিয়ে যেত। ছয়দফা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারিসহ আটটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। ফলে ১৯৬৮ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়া হলেও শেখ মনি মুক্তি পাননি। কারাগারের রোজনামচায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘৬ দফা প্রস্তাব জনগণের সামনে পেশ করার পর থেকে সরকার আমার ওপর অত্যাচার চালাইয়া যাচ্ছে।…আমার ভাগনে শেখ ফজলুল হক মনি ও আরও অনেকে ১৯৬৬ সাল থেকে জেলে আছে এবং সকলের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়েছে।’

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। ঐ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইশতেহার প্রণয়ন থেকে শুরু করে জয়লাভ পর্যন্ত সকল কিছুর অন্যতম কারিগর ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি। পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশের ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনসহ বাঙালীর অধিকার বাস্তবায়নের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু তিনি নির্বাচনী ইশতেহার ও কর্মসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। একাত্তরের পঁচিশে মার্চে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আক্রমণের পর সবাই যখন কি করতে হবে এই চিন্তায় দিশেহারা, তখন পাদপ্রদীপের উজ্জ্বল আলোর মতো উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিলেন শেখ মনি। বঙ্গবন্ধুর একান্ত অনুসারী হিসেবে সেদিন তিনি আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন মুজিববাহিনী। যৌথবাহিনীর কোন ভূমিকা ছাড়াই শেখ মনির নেতৃত্বাধীন মুজিব বাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম দখল করেছেন। এ বাহিনীর প্রধান হিসেবে তিনি ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামে পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন।

শেখ মনির গভীর অধ্যয়ন, চারিত্রিক দৃঢ়তা, জানা-শোনা-দেখা ও পরিশ্রম তাঁর অন্তর্দৃষ্টিকে করেছিল প্রখর। অপ্রিয় হলেও তিনি সব সময় সত্য ও স্পষ্টকথা বলতেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও উদারতা ছিল বিশাল। একাধারে তিনি লেখক, গল্পকার, তাত্ত্বিক, সাংবাদিক, সামাজিক সংগঠক ও বাঙালী সংস্কৃতির উপাসক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর রচিত প্রথম গল্পের সংকলন ‘বৃত্ত’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তাঁর নিবন্ধ নিয়ে সংকলিত ‘দূরবীণে দূরদর্শী’ গ্রন্থটি ইতিহাসের অন্যতম সংযোজন। তাঁর উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘অবাঞ্ছিতা’ টেলিফিল্মও দর্শক নন্দিত হয়েছে। দৈনিক ‘বাংলার বাণী’র’ প্রতিষ্ঠাতা শেখ মনি ‘বাংলাদেশ টাইমস’ ও সাপ্তাহিক ‘সিনেমা’ পত্রিকারও সম্পাদক ছিলেন। তাঁর উদ্ভাবনী চিন্তা ও যুগান্তকারী উদ্যোগ স্বাধীনতা আন্দোলনের পথকে প্রশস্ত করেছিল। তাঁর আদর্শ ও সংগ্রামের মূল প্রেরণা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবও তাঁকে ¯েœহ করতেন। ১৯৬৭ সালে কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘১৫ তারিখেও রেণু এসেছিল জেলেগেটে মনির সঙ্গে দেখা করতে।’ ৪৭তম জন্মবার্ষিকীতে পাওয়া কেক নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘কিছুটা আমার ভাগ্নে মনিকে পাঠাতে বলে দিলাম জেলগেট থেকে। ওর সঙ্গে দেখা হবে না, এক জেলে থেকেও।’

শিক্ষা-দীক্ষা, চিন্তা-চেতনা, মেধা-প্রজ্ঞা ও চালচলনে শেখ মণি ছিলেন বাঙালীর দেশিকোত্তম ব্যক্তিÑস্বভূমিতে শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা বৈশ্বিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ। ‘দূরবীণে দূরদর্শী’ গ্রন্থে শেখ মনি বলেছিলেন, ‘আমরা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। আমাদের জনতার আশা-আকাক্সক্ষা, ভাবনা-চিন্তা আমাদের সাধের বাংলাদেশটিকে কেন্দ্র করে। বঙ্গবন্ধুর জীবন আমাদের মতো একটি সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত সমস্যাসঙ্কুল দেশের মানুষের জন্য অশেষ মূল্যবান।… আমরা কেবল শুরু করেছি। আবর্জনা সাফ করে আমাদের যাত্রাপথ তৈরি হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন সেই পথপ্রদর্শক-কা-ারি। খোদা না করেন, তাকে যদি আমরা হারাই, তাহলে বাংলার এই সাড়ে সাত কোটি দুঃখী মানুষের ভাগ্যে কি আছে! …জাতীয় স্বার্থেই তাঁর জীবনের জন্য যে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে তার চেয়ে শতগুণ কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা দরকার…।’

শেখ মনি নিজের জীবন দিয়েও বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে পারেননি। স্বামীকে বাঁচাতে এসে তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী সামসুন্নেসা আরজু মনি জীবন দিয়েছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের চোখের আড়ালেÑভাগ্যগুণে বেঁচে গেছেন তাঁদের দুই শিশুপুত্র। তাঁদের জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ ফজলে সামস্ পরশ ইংরেজী সাহিত্যে ডিগ্রী নিয়ে একটি বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। কনিষ্ঠপুত্র শেখ ফজলে নূর তাপস ঢাকা-১০ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সরকার পক্ষের অন্যতম আইনজীবী ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস যুক্তরাজ্য থেকে ব্যারিস্টার-এট-ল ডিগ্রী নিয়ে আইন পেশায় নিয়োজিত আছেন। ৪ বছর বয়সে বাবা-মা হারানো তাপস ‘স্মৃতি না থাকার বেদনা যে কত কষ্টের’ নামক নিবন্ধে মা’র গান স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন,

‘পরশ/তাপস সোনা বলি শোন

থাকবে না আর দুঃখ কোনো

মানুষ যদি হতে পারো।’

মা-বাবা হারানো দুই শিশু জীবনের অনেক বছর কেঁদে কেঁদে বড় হয়েছেনÑমানুষ হয়েছেন। ক্ষমতা পেয়েও প্রতিহিংসার কথা ভাবেননি, আইনী পথে মা-বাবা হত্যাকারীর বিচার চেয়েছেন।

শেখ মনির কাছে বাঙালীর ঋণ অনেক। তিনি দুঃসময়ে অত্যন্ত সাহাসিকতার সঙ্গে জাতির হয়ে বীরত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিয়েছিলেন। স্বাধীনতার সময় ভারত সরকারের কাছ থেকে পাওয়া ‘শিক্ষকতার প্রস্তাব’ কিংবা স্বাধীনতার পর মন্ত্রিত্বের পদ না নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বাধীন বাংলার প্রথম যুব সংগঠন আওয়ামী যুবলীগ। ১৯৭২ সালের ১১ নবেম্বর প্রতিষ্ঠিত যুবলীগের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি একটি সুন্দর যুবসমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ঘাতকের বুলেট সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে দেয়নি। অকালে চলে গেলেও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনে শেখ মনির প্রেরণা যুব সমাজকে সামনে চলতে অনুপ্রেরণা জোগাবে। সে প্রেরণা ও আদর্শে যুবসমাজ এগিয়ে চললে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের সোনার বাংলার পথ দৃঢ় হবে, শেখ ফজলুল হক মনির নিরন্তর উদ্যোগ-স্বপ্ন, পরিশ্রম, সংগ্রাম সার্থক রূপ পাবে।

লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *