বিশেষ নিবন্ধ ::
ফিলিস্তিনি শিশুদের জীবন কীভাবে কাটে তা নিয়ে বিশ্বের খুব কম মানুষেরই ধারণা আছে। ইসরায়েলি দখলদারিতে আমরা আমাদের ঘরের ভেতরে কেমন অনিরাপদ; আমাদের প্রতিটা দিন কেমন করে কাটে, সেটা অনুভব কজন করতে পারে। দখল হয়ে যাওয়া পশ্চিম তীরের নাবি সালেহ নামের একটা গ্রামে আমি বেড়ে উঠেছি। আমার বয়স যখন সাত, তখন থেকেই আমি আমার মায়ের মুঠোফোনে চলচ্চিত্র বানাতে শুরু করি।
আমি আমার চলচ্চিত্রে আমাদের প্রতিদিনকার জীবন দেখাতে চেয়েছি। জানালার কাছে বোমা বিস্ফোরণ কিংবা দরজা ভেঙে ইসরায়েলি সেনাদের বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ার শব্দে রাত ৩টায় আমাদের ঘুম ছুটে যায়। এমন অনেক সময় গেছে যখন চোখ খুলে দেখতে পেয়েছি ইসরায়েলি সৈন্যরা আমার ঘরের ভেতরে। তারা তাদের বন্দুক দিয়ে আমার খেলনাগুলো গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। আমার মাথায় বন্দুক তাক করে ঘর থেকে তারা বেরিয়ে যাচ্ছে।
এ সপ্তাহে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন এবং জেনেভায় মানবাধিকার কাউন্সিলের সভায় বিশ্বনেতারা মিলিত হবেন। ফিলিস্তিনি শিশুদের নিপীড়নের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে নীরব রয়েছে সেটা পরিসমাপ্তির জন্য, এটা অনেক বড় একটা সুযোগ। ইসরায়েল আমাদের অধিকার হরণ করছে। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেও দায়মুক্তি পাচ্ছে। আমাদের সবচেয়ে বড় মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা, আমাদের বেঁচে থাকার অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। আমাদের পরিবার, আমাদের বিদ্যালয়, আমাদের বাড়ি তাদের লক্ষ্যবস্তু। গাজায় আমাদের বন্ধুরা প্রতিদিন ইসরায়েলি বোমার লক্ষ্যবস্তু হওয়ার ভয়ে থাকে।
আমার কাজিন, মুহাম্মদ মুনির আল-তামিমি এ বছরের ঈদে খুন হয়েছে। ইসরায়েলি সৈন্যরা আমাদের গ্রামে হামলা করে। রাস্তায় যাকে পেয়েছে তাকেই গুলি করতে শুরু করে। মুহাম্মদ তার ভাইকে খুঁজতে রাস্তায় বের হয়। তাকে পেটে গুলি করে সৈন্যরা। তার বয়স হয়েছিল মাত্র ১৭ বছর। আমাদের মৃত বন্ধু আর স্বজনদের জন্য আমরা শোক করি। কিন্তু আমরা ভেঙে পড়ি না। বুলেট আমাদের হত্যা করতে পারে না। সেগুলো আমাদের দখলদারি থেকে মুক্ত হতে শক্তি দেয়।
ইসরায়েল বিশ্বে একমাত্র দেশ যারা নিয়ম করে শিশুদের আটক করে। সামরিক আদালতে তাদের বিচার করে। আমার আরেক কাজিন আহেম তামিমিকে ইসরায়েলের কারাগারে আট মাস আটকে রাখা হয়েছিল। সে সময়ে ওর বয়স ছিল ১৬ বছর। আরও অনেক নারী ও শিশু সেখানে ছিল। তাদের অনেককে প্রশাসনিক ক্ষমতাবলে আটকে রাখা হয়েছিল। কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ বা বিচার ছাড়াই তারা কাউকে বছরের পর বছর আটকে রাখা হতে পারে। এর ফলে শিশুরা যে ভয়ংকর ট্রমার মুখোমুখি হয় তার কারনে মুক্তির পরও অনেকে আর তাদের শৈশবের নির্মল আনন্দ উপভোগ করতে পারে না।
আমার বয়স তখন মাত্র ১২ বছর, জর্ডান থেকে ফিরছিলাম। ইসরায়েলি সেনারা আমাকে সীমান্তে আটকে দেয়। তারা তিন ঘণ্টা ধরে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। আমার সঙ্গে কোনো আইনজীবী কিংবা আমার বাবা-মাকে যেতে দেওয়া হয়নি। এটা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এই ঘটনার পর, সাংবাদিক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমি বিশ্বের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সাংবাদিক। সাংবাদিক হওয়ায় আমি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুরক্ষা পেয়েছি। কিন্তু ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে সাংবাদিক গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা নিয়মিতভাবেই ঘটে।
অ্যাকশন এইড ও আল-হক আয়োজিত একটি গণশুনানির প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে আমি কথা বলব। ফিলিস্তিনি শিশুদের মানবাধিকার হরণ এবং আন্তর্জাতিক আইনের যে সব লঙ্ঘন সেখানে ঘটে, সেটার বিবরণ আমি দেব। ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নির্যাতিত আল জাজিরার সাংবাদিক জিভারা বুদেরি সেখানে ইসরায়েলি হামলায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কীভাবে হরণ হয়, তা নিয়ে কথা বলবেন। অন্য সাক্ষীরা শেখ জারা থেকে ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোর জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি, জর্ডান উপত্যকার ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠনের প্রমাণ দেবেন। ফিলিস্তিনে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এবং মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন তদন্ত নিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল যে আহ্বান জানিয়েছে সদস্য দেশগুলো সে ক্ষেত্রে পূর্ণ সহযোগিতা করবে বলে আশা করি।
এই সব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও, আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি আশাবাদী। আমরা একটা বদলে যাওয়া প্রজন্ম। আমরা এমন এক প্রজন্ম, যারা ফিলিস্তিনকে মুক্ত করবে। আমরা একটা ভালো বিশ্ব বানাব, যে বিশ্বে দখলদারি কিংবা উপনিবেশ থাকবে না। যে বিশ্বে ফিলিস্তিনিরা তাদের মর্যাদা নিয়ে মুক্তভাবে বাস করতে পারবে। কিন্তু আমরা একা এটা করতে পারব না। বিশ্ব সম্প্রদায়কে ফিলিস্তিনকে নিয়ে তাদের নীরবতা ভাঙতে হবে। নিপীড়নের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইয়ে সঙ্গী হতে হবে।
জান্না জিহাদ ফিলিস্তিনি সাংবাদিক, শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকর্মী