নঈম নিজাম : বিখ্যাত লেখক সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা অন্যরকম। এই জীবনে কিছু মানুষ আমাকে অকারণে পছন্দ করেন।
সমরেশ মজুমদার তাঁদের একজন। নিউইয়র্কের হাডসন নদীর তীরে আমরা একসঙ্গে ঘুরেছি।
আবার মেঘনা নদীতে নৌকায় চড়ে ডাবের পানি পান করেছি নরসিংদীর রাজিউদ্দিন রাজু ভাইয়ের অতিথি হয়ে। রাজু ভাই আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন রায়পুরা আদিয়াবাদ স্কুলের একটি অনুষ্ঠানে।
সময়টা ওয়ান-ইলেভেনের পর ২০০৭ সালে। দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ।
রাজু ভাই আমাদের নিয়ে ঘুরলেন নিজের নির্বাচনী এলাকায়। দেখালেন সাহিত্যবিষয়ক অনুষ্ঠান করছেন। বাস্তবে রাজনৈতিক কর্মীদের উপস্থিতি ছিল বেশি। রাজু ভাইয়ের বাড়িতে খেয়েছিলাম আমরা। কালবেলা, কালপুরুষ, উত্তরাধিকার, সাতকাহনের মতো বিখ্যাত উপন্যাসগুলোর লেখক সমরেশ মজুমদার আমাকেও একটি উপন্যাস উৎসর্গ করেন। নাম অনুপ্রবেশ। গল্প আড্ডায় সমরেশের কোনো তুলনা চলে না। একবার তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে। শেখ হাসিনা প্রচুর বই পড়েন। সমরেশেরও প্রায় সব বই তাঁর পড়া। এ আলাপের আগে সমরেশ জানতেন না শেখ হাসিনা বইয়ের পোকা। ২০০৫ সালে একবার সুধা সদনের দোতলায় আলাপকালে শেখ হাসিনা আমাকে বলেছেন, বিশ্বমানের বইগুলো তাঁকে বেছে পছন্দ করে দেন বোনের মেয়ে রুপন্তি। সমরেশের সঙ্গে কথায় কথায় আড্ডা, আলাপে শেখ হাসিনা বই নিয়ে গল্প শুরু করেন। একপর্যায়ে জানান সমরেশ মজুমদারের বেশির ভাগ বই তাঁর পড়া। মুগ্ধ হলেন লেখক। বললেন, আপনি আমার এত লেখা পড়েছেন! রাজনীতিবিদরা এত পড়ে আগে জানতাম না। অবাক হচ্ছি। ভালোও লাগছে একজন রাজনীতিবিদের এত পড়ার কথা জেনে। শেখ হাসিনা হাসলেন। তারপর সাতকাহনের দীপাবলি চরিত্র নিয়ে কথা বললেন। সমাপনী নিয়েও নিজের মত তুলে ধরেন।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হলো। চা পানের সময় হাসতে হাসতে সমরেশ বললেন, মনোযোগী পাঠিকা ক্ষমতায় এলে ভাগ্য খুলে যাবে এই লেখকের। তখন এ দেশে যা চাইব তা-ই পাব। শেখ হাসিনাও হাসলেন। বললেন, একজন লেখক যা চাইবেন তা-ই দেব। সমরেশ মজুমদারের চোখে-মুখে দুষ্টামির হাসি। বললেন, এভাবে হবে না। কাগজ-কলমে লিখে দিতে হবে। কাগজ-কলম নিন। লিখে দিন। সমরেশ ভেবেছিলেন শেখ হাসিনা এবার পিছু হটবেন। কিন্তু না, কাগজ-কলম আনালেন। বিস্মিত সমরেশ মজুমদার বললেন, লিখুন, আমি ক্ষমতায় এলে লেখক সমরেশ মজুমদারের বাংলাদেশে প্রবেশে কোনো ভিসা লাগবে না। শেখ হাসিনাও মজা করে তা-ই লিখলেন। তারপর স্বাক্ষর করে তারিখ বসালেন। লেখক যত্ন করে কাগজটি নিয়ে গেলেন। এখনো তাঁর সংগ্রহে আছে সেই কাগজটি। শেখ হাসিনা তখন দেশ স্বাধীনের পর কীভাবে কবি নজরুলকে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু নিয়ে এলেন সেই স্মৃতিচারণা করেন। গল্প আড্ডা শেষ হলো। সমরেশ মজুমদার বিদায় নিলেন। সময় বয়ে যায়। থেমে থাকে না। কিন্তু লেখককে তো সব ভুলে থাকলে চলে না। ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলো। শেখ হাসিনা হলেন প্রধানমন্ত্রী। সমরেশ মজুমদার ঢাকায় এলেন। ঢাকা বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাকে তিনি পাসপোর্ট দিলেন না। তিনি শেখ হাসিনার লেখা সেই কাগজটি দেখালেন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাকে। ইমিগ্রেশনের সেই কর্মকর্তাও সমরেশ মজুমদারের লেখার ভক্ত। বললেন, স্যার আপনার লেখার আমিও ভক্ত। বাংলাদেশে আপনাকে স্বাগত। কিন্তু কলকাতা বিমানবন্দরে আপনাকে পাসপোর্ট দেখাতে হয়েছে। সেটাতে সিল না দিলে তারা আবার মাইন্ড করবে। ভাববে আপনি বাংলাদেশে আসেননি। সমরেশ মজুমদার হাসলেন। তারপর পাসপোর্টটি এগিয়ে দিলেন।
শেখ হাসিনার এমন হাজারো ঘটনা আছে লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের সঙ্গে। কবি শামসুর রাহমান বলতেন, হাজারো কথা থাকবে। কিন্তু শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শেষ ঠিকানা। শামসুর রাহমানের সঙ্গেও আমার অসাধারণ ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। শামসুর রাহমান ছিলেন সহজ-সরল মানুষ। তিনি আমার বাসায় আসতেন। আমি যেতাম। অনেক বিষয়ে কথা হতো। বাদ পড়ত না রাজনীতিও। শেখ হাসিনাকে তিনিও পছন্দ করতেন। ব্যক্তিগত কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিল না। বিখ্যাত লেখক শওকত ওসমান খুব দুঃসময়ে ছিলেন। পরিবার-পরিজনের সঙ্গে সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছিল না। আর্থিক সমস্যা ছিল। সে সময় একজন মানুষ মাঝেমধ্যে রান্না করে খাবার পাঠাতেন। তিনি শেখ হাসিনা। এভাবে সবাই পারেন না। ইতিবাচক, মানবিক অবস্থানের জন্য আলাদাভাবে তৈরি হতে হয়। পারিবারিকভাবে তা পেতেও হয়। শেখ হাসিনা পারিবারিকভাবে তা পেয়েছেন। লেখক হুমায়ূন আহমেদ ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য গেলেন আমেরিকা। ভিসাগত জটিলতার কারণে টানা আমেরিকায় থাকাটা সমস্যা ছিল। তাঁর পাশে দাঁড়ালেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ দূতাবাসের উপদেষ্টা করে ভিসাগত সংকট দূর করেন। হুমায়ূন আহমেদ সেই কথা লিখে গেছেন।
শেখ হাসিনা মিডিয়া বোঝেন। মানুষকেও বোঝেন। ১৯৮৮ সালের বন্যার পর তিনি কবি নির্মলেন্দু গুণকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সে চিঠিটি পরে প্রকাশ করেন কবি। সেই চিঠির কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি, ‘আপনার অনুরোধে কিছু ছবি পাঠালাম। তবে আমার একটা অনুরোধ রাখবেন। “ত্রাণ বিতরণ করছি” এ ধরনের কোনো ছবি ছাপবেন না। মানুষের দুর্দশার ছবি যত পারেন ছাপান। আমার ধারণা এ ধরনের অর্থাৎ ত্রাণ বিতরণের ছবি টেলিভিশন ও খবরের কাগজে দেখে মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছে। ওরা গরিব, কিন্তু সেটা কি ওদের অপরাধ? একশ্রেণি যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ আহরণ না করত তাহলে এরা কি গরিব হতো? কার ধন কাকে বিলাচ্ছে?’ শেখ হাসিনা এমনই। তাঁর সঙ্গে দেশ-বিদেশ ঘুরে কিংবা পেশাগত কাজ করতে গিয়ে দেখেছি ভাবনার জগতে তিনি বাস্তববাদী। মিডিয়ারও বিভিন্ন দিক তাঁর জানা। আবার মানুষের দুঃখ-কষ্ট তিনি পরিপূর্ণভাবে অনুভব করেন। ২০১৩ সালে একবার অনেকক্ষণ ধরে কথা বলার সময় তিনি পত্রিকার পাতার ভাঁজের ওপর, নিচের সংবাদ কিংবা তৃতীয় পৃষ্ঠার বিভিন্ন সংবাদ নিয়ে কথা বলেন। বিভিন্ন পত্রিকার নিউজ কভারেজের বৈষম্য ও ট্রিটমেন্ট নিয়ে কথা বললেন। থ খেয়ে গেলাম। বললাম, আপা, আপনি পত্রিকার বার্তা সম্পাদক হলেও ভালো করতেন।
শেখ হাসিনার সঙ্গে ভালোমন্দ নিয়ে কথা বলা যেত। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লিখে তাঁর সামনে যাওয়া যেত। ২০০১ সালে তিনি ক্ষমতা ছাড়লেন। খুব ভোরে আমার বাসায় এলেন পীর হাবিবুর রহমান। বললেন, চলুন গণভবনে যাই। আপা ক্ষমতা ছেড়েছেন। দেখা করা যায় কি না দেখুন। ফোন করলাম সদ্যবিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর এপিএস ইব্রাহিম হোসেন খানকে। তিনি বললেন, চলে আসুন। পীরকে নিয়ে গেলাম গণভবনে। প্রবেশ করেই দেখি প্রধানমন্ত্রী নিজের ব্যক্তিগত উইংয়ে কর্মরত সবাইকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা প্রবেশ করে এভাবে মুখোমুখি হব ভাবিনি। একটু দূরেই দাঁড়ালাম। তিনি খেয়াল করলেন। আমাকে ডাকলেন। কাছে যেতেই বললেন, আমার সঙ্গে লন্ডন, ব্রাসেলস গেলে, ফিরে এসে লিখে দিলে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে? তারপর বললেন, আতা খানের রেস্টুরেন্টে বসে লিখেছ নাকি? জবাবে বললাম, আপনার নিবেদিত শফিক ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে লিখেছি। একদিন সানু মিয়ার সঙ্গে গিয়েছিলাম দিলশাদ রেস্টুরেন্টে। শফিকুর রহমান চৌধুরী ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি কিছু তথ্য দিয়েছিলেন। নেত্রী আর কথা বাড়ালেন না। জানতে চাইলেন এটিএন বাংলার সর্বশেষ কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে। ভোটের আগে সব নিউজ শুরু হবে কি না। বিদায়ী তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদকে নিয়েও কথা হয়। পরে আমি বললাম, এটিএন বাংলার জন্য একটি বড় সাক্ষাৎকার নেব নির্বাচন ঘিরে। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে মানুষের মনের প্রশ্নগুলোর জবাব দেবেন। তিনি সময় দিতে বললেন সংশ্লিষ্টদের। এক ঘণ্টার বেশি নেওয়া সেই সাক্ষাৎকারে আমার সঙ্গে প্রশ্নকারী প্যানেলে ছিলেন ইকবাল সোবহান চৌধুরী। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি এটিএন বাংলায় অনেকবার সম্প্রচারিত হয় ২০০১ সালের নির্বাচনী প্রচার শুরুর পর।
শেখ হাসিনার সঙ্গে একজন পেশাদার সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করার অনেক স্মৃতি আছে আমাদের অনেকের। ২০১৩ সালের বাংলাদেশ প্রতিদিন সরকারের সব নেতিবাচক কাজের কট্টর সমালোচক। স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, মাহমুদুর রহমান মান্না, গোলাম মাওলা রনি, কাজী সিরাজসহ অনেকের সমালোচনামূলক লেখা প্রকাশ করতাম। সে সময় একদিন বিকালে ফোনে আমার সঙ্গে কথা বললেন জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম ও ওমর ফারুক চৌধুরী। তাঁরা বললেন, প্রধানমন্ত্রী ডেকেছেন রাতে। নানক ভাইয়ের সংসদ ভবনের অফিসে গেলাম। তিনজনই আমাকে নিয়ে গেলেন। গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর রুমে প্রবেশ করলাম। ভাবলাম পত্রিকা নিয়ে কি বলেন? টানা ২২ মিনিট প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ওয়ান টু ওয়ান কথা হয়। তিনি কী প্রকাশ হয়েছে পত্রিকায় কী হয়নি কিছুই বললেন না।
মিডিয়ার বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেন আমার সঙ্গে। এরপর নানক, আজম, ফারুক ভাইকে ডাকলেন। আরও ১৫ মিনিটের মতো কথা হয়। এই শেখ হাসিনাই আমাদের চেনা মিডিয়াবান্ধব নেত্রী। তিনি পত্রিকার কট্টর সমালোচক লেখকদের নিয়ে কোনো প্রশ্নই করেননি। কী প্রকাশ করেছি আর করিনি সে প্রসঙ্গেও গেলেন না। বরং বিভিন্ন বিষয়ে আমার কথা মন দিয়ে শুনলেন। এই হলেন শেখ হাসিনা। এ প্রজন্মের অনেকে মনে করেন শেখ হাসিনা শুধু তোয়াজই পছন্দ করেন। সমালোচনা নয়। ঠিক নয় কথাটা। তিনি গঠনমূলক সমালোচনাকে সব সময় গুরুত্ব দেন। ২০১৭ সালের দিকে মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে বের হয়ে একজন সিনিয়র মন্ত্রী আমাকে ফোন করেন। বললেন, প্রধানমন্ত্রী আজ তথ্যমন্ত্রী ইনু সাহেবকে ডেকে তোমার কাগজের কিছু বিষয় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সেদিন বিকালে ছিল প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন। গেলাম ভয়ে ভয়ে। সংবাদ সম্মেলনে আমি কোনো প্রশ্ন করি না। কিন্তু সামনের সারিতে বসি। প্রধানমন্ত্রীর চোখের সামনে বসলাম। তিনি প্রবেশ করতে সালাম দিলাম। হাসিমুখে সালাম নিলেন। বুঝলাম যা শুনেছি মন এতটা খারাপ নয়। অনুষ্ঠান শেষে আমি আর কবি নির্মলেন্দু গুণ কথা বলছিলাম। তিনি এগিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন। কথা বললেন হাসিমুখে। বুঝলাম ক্যাবিনেটে প্রবেশের মুখে হয়তো কেউ কিছু লাগিয়েছিলেন। এ কারণে ইনু ভাইকে একচোট নিয়েছেন বাংলাদেশ প্রতিদিন নিয়ে। একটু পর আবার আগের শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এখন দেশ-বিদেশে নানামুখী প্রচারণা চলছে। ইউটিউব, ফেসবুকে চলছে পরিকল্পিত মিথ্যাচার। আমরা জীবিত কিংবদন্তিকে সঠিক মূল্যায়ন করতে পারি না। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছর ছিলেন। সে সময় দেশ-বিদেশের ষড়যন্ত্র ছিল। মিডিয়া, রাজনীতিবিদ সবাই বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু এখন সময় এসেছে অনেক কিছু হিসাব-নিকাশের। আগের লেখায় বলেছি, বয়স আমাদেরও বাড়ছে। কিছু কথা জানিয়ে যেতে হবে। কিছু কথা লিখে যেতে হবে আগামী প্রজন্মের জন্য। বর্তমানকে মূল্যায়ন করবে আগামী। কিন্তু বাস্তবতাকে তো আড়াল করা যায় না। নিউজ মিডিয়া নামের প্রতিষ্ঠানটি করার আড়ালের উৎসাহদাতা মানুষটির নামও শেখ হাসিনা। এক সন্ধ্যায় ভোরের কাগজে বসে কাজ করছি। ভোরের কাগজের অফিস তখন নয়াপল্টন। নুরুল ফজল বুলবুল গাড়ি চালিয়ে এলেন আমার কাছে। বললেন, আপা তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। হাতের কাজ শেষ করে ২৯ মিন্টো রোডে বিরোধী দলের নেতার বাসায় গেলাম। তখন মিডিয়া সিন্ডিকেট নামের একটি সংবাদ সংস্থা ছিল কট্টরভাবে শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয়সহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের বিরুদ্ধে। নেত্রী আমার সঙ্গে কথা বললেন এ বিষয়টি নিয়ে। বিস্মিত হলাম, অনেক সিনিয়র থাকতে তিনি আমাকে কেন ডাকলেন। বুঝলাম একটা বিশ্বাস ও স্নেহ আছে বলেই ডেকেছেন। ভালো লাগল। নেত্রী তাকালেন আমার দিকে। বললেন, কী করা যায় বল? জবাবে বললাম, পাল্টা একটা প্রতিষ্ঠান করা যেতে পারে। তিনি বললেন, শুরু কর। দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। সংসার জীবনে ভালোই আছি। মাত্র পুত্রসন্তানের জন্ম হয়েছে। ঝুঁকি নেব কি না ভাবছিলাম। সেই ভাবনা বুঝতে পেরে তিনি আবার বললেন, শুরু কর। কোনো কিছু লাগলে আমি আছি, দেখব। আমার জীবনে নিউজ মিডিয়া অধ্যায়ের সূচনা এভাবে। ১৯৯৬ সালের ক্ষমতার মেয়াদে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিই। নিউজ মিডিয়ার সংবাদগুলো সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করত জনকণ্ঠ আর ইনকিলাব। এ ছাড়া আজকের কাগজ, খবর, রূপালী, বাংলার বাণী, ইত্তেফাকেও নিউজ মিডিয়ার খবর প্রকাশিত হতো। এ ছাড়া ঢাকার এবং বাইরের আরও অনেক পত্রিকা নিউজ মিডিয়ার খবর নিত। নিউজ মিডিয়া করতে গিয়ে শিখেছি কী করে প্রতিষ্ঠান চালাতে হয়। যা কাজে লাগছে এখন কিংবা ২০০১ সালে এটিএন বাংলার জীবনে।
সব কাজেরই একটা ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক থাকে। দেখতে হবে কে কীভাবে নেয়। নিউজ করে বিপদে পড়েও এ দেশের সাংবাদিকরা শেখ হাসিনার কাছে আশ্রয় পেতেন। ১৯৯১ সালের মেয়াদে বিএনপি ক্ষমতায়। ১৭ মন্ত্রীর দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট করে বিপাকে পড়ি সৈয়দ বোরহান কবীর ও আমি। রিপোর্টটি প্রকাশের পর সংসদে তোফায়েল আহমেদ তীব্র হইচই করেন। সংসদে হয় অনির্ধারিত বিতর্ক। সে বিতর্কের সূত্র ধরে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বোরহান ও আমার পেছনে লাগে। বোরহান আমাকে বলল, বিষয়টি আপাকে জানাও। আমি দেখা করে সবকিছু জানালাম। তিনি বললেন, সরকারি সংস্থা কাগজপত্র চাইলে বলবে সব আমার কাছে তোমরা দিয়ে দিয়েছ। তোমাদের কাছে কোনো কাগজপত্র আর নেই। আমরা তা-ই বলেছিলাম। আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। এটিএন বাংলায় কাজ করার সময় বগুড়ায় অস্ত্র উদ্ধার নিয়ে জামায়াতের বিরুদ্ধে খবর সম্প্রচারিত হয়। জামায়াত তখন ক্ষমতায়। মন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ মামলা করে বসেন। ২ শতাধিক পুলিশ ঘেরাও করে এটিএন বাংলা অফিস। ফোন করলাম বিরোধীদলীয় নেতাকে। তিনি বললেন, পারলে অফিস থেকে চলে যাও। পরে সব দেখব। ওরা আটক করে অত্যাচার চালায়। পুলিশ আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। সেবার আটক আর করেনি। আমাদের সহকর্মীরা সবাই অফিসে শক্ত অবস্থান নেন।
শেখ হাসিনা সব সময় সাংবাদিকদের পাশে থাকতেন। পাশে থাকেন। তাঁর সঙ্গে কুড়িগ্রামের বাসন্তীর বাড়ি গিয়েছিলাম। আবার আজমির শরিফে খাজা বাবার মাজারও জিয়ারত করেছিলাম। আজমির যাওয়ার পথে গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। মরুভূমির মাঝে নামলেন তিনি ছোট্ট একটা ক্যামেরা হাতে। সেই ক্যামেরা দিয়ে আমাদের নিয়ে ছবি তুললেন। ১৯৯১ সালে ভোলা যাওয়ার পথে তিনি লঞ্চের ডেকে বসে গল্প করছেন সফরসঙ্গীদের সঙ্গে। কোনো অহমিকা নেই। আড্ডায় তিনি হয়ে ওঠেন পরিবারের বড় বোন। আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় তিনি দেশের অভিভাবক। বঙ্গবন্ধু দেশটা স্বাধীন করেছেন। আর শেখ হাসিনা এগিয়ে নিচ্ছেন সামনের দিকে। হিসাব-নিকাশ একদিন হয়তো ভালোভাবে হবে। ইতিহাস তাঁকে মূল্যায়ন করবে কাজ দিয়ে। বর্তমান বাস্তবতায় অনেক প্রশ্ন আসছে। কবি শামসুর রাহমানের পুরনো কথা ধরেই বলছি, কঠিন পথ অতিক্রম করে শেখ হাসিনা আজকের অবস্থানে। একুশে আগস্টসহ অনেকবার তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। আল্লাহ তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছেন এ দেশের অনেক কাজ করানোর জন্য। বাংলাদেশ আজ বদলে যাচ্ছে। বিশ্বে নতুন করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে। পাকিস্তান আজ বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখে বিস্মিত। বলছে, শিখতে হবে বাংলাদেশের কাছ থেকেই। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোও বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবছে নতুন করে। এ সম্মান, এ মর্যাদার আড়ালের মানুষটি শেখ হাসিনা। বিতর্ক আছে, থাকবে। কিন্তু বাংলাদেশের এই এগিয়ে চলাকে অস্বীকার করা যাবে না।
লেখক: সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন