নিউজ ডেস্ক : ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যে মহাকাব্যিক ভাষণ দিয়েছিলেন, তার মূল কথা ছিল মুক্তি। এই মুক্তি শব্দটির ব্যঞ্জনা ছিল বহুমাত্রিক। রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়াও সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছিল এই শব্দে। আজ আমরা বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শন বলতে গণমানুষের জীবনমানের উন্নতিকেই বেশি করে বুঝে থাকি। তিনি যে রাষ্ট্রচিন্তা করতেন, তার মূলে ছিল সাধারণ মানুষ ও তাদের কল্যাণ। তার মতো করে তিনি তাই বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার কথা বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতিতে যুক্ত করেছিলেন।
আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি হিসেবে বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবনের বড় অংশই গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে কৃষকের দুঃখ-কষ্ট স্বচোখে দেখতেন। শ্রমিকের দুঃখও তিনি জানার চেষ্টা করতেন। কী করে এই শোষিত মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করা যায়, সেই বিষয়ে তিনি নিরন্তর ভাবতেন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারে পূর্ব বাংলার মানুষের তেমন উপস্থিতি ছিল না বলে বঙ্গবন্ধু বরাবরই বাঙালির জন্য ন্যায়বিচারের কথা বলতেন। তিনি পাকিস্তানি এলিটদের প্রধান টার্গেটে পরিণত হন। তাই সুযোগ পেলেই তাকে জেলে ভরা হতো। জেলে বসেও লিখতেন বাঙালির মুক্তি নিয়ে ভাবতেন।
তাই স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু প্রথমেই স্বদেশের পুনর্বাসন শুরু করে দেন। পরিস্থিতির কারণেই শিল্প কারখানা জাতীয়করণ করেন। তবে এসব কারখানার ব্যবস্থাপনা বোর্ডে ৪০ শতাংশ শ্রমিকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিলগ্নিকরণের প্রক্রিয়া শুরু করেন। ভূমি মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দেন। ১৯৭২ সালেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোনা থেকে ডলারে পরিবর্তন করার প্রথা তুলে নেয়। ফলে ৩ ডলারের এক ব্যারেল তেলের দাম হয়ে যায় ১১ ডলার। প্রতি টন গমের দাম ছিল আগে ৮০ ডলার, হয়ে যায় ২৪০ ডলার। সারের দাম ছিল প্রতি টন ৮০ ডলার, তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ২০০ ডলার। সারা বিশ্বেই মূল্যস্ফীতি হয় আকাশচুম্বী। তারপরেও ১৯৭৪ সালের মূল্যস্ফীতি ৬০ শতাংশকে ১৯৭৫ সালে ৩০-৩৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। মাত্র তিন বছরেই তিনি বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৯৩ ডলার থেকে টেনে ২৭১ ডলারে উন্নীত করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে যে ভাষণটি দিয়েছিলেন, তাতেই প্রতিফলিত হয়েছিল তার গণমুখী আধুনিক অর্থনৈতিক দর্শন। আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ার পাশাপাশি তিনি একটি ন্যায্য আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থারও প্রবক্তা ছিলেন।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিল মাত্র ৮ বিলিয়ন ডলারের মতো। কী করে সেই অর্থনীতি ২০১৯ সালে ৩০২ বিলিয়নে উন্নিত হল- তা আসলেই অনুভবের বিষয়। অর্থাৎ এই পাঁচ দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেড়েছে ৩৮ গুণের মতো। এই ২০০৯ সালেও আমাদের মোট জিডিপির আকার ছিল ১০২.৫ বিলিয়ন ডলার। মাত্র এক দশকেই তা বেড়েছে তিন গুণের মতো। অথচ এর আগের চল্লিশ বছরে প্রতি দশকে বাংলাদেশের জিডিপির আকার বেড়েছে মাত্র ১.৭৬ গুণ। পঁচাত্তর পরবর্তী দশকে প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল ৪ শতাংশ। তার পরের দশকে তা ছিল ৫.২ শতাংশ অথচ ২০০৭-০৮ থেকে ২০১৮-১৯ সময়কালে গড়ে ৭ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।
১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের চতুর্থ বর্ষ উদযাপন উপলক্ষ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের ঘোষণা দেন। এসময় কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতার প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘সমাজ ব্যবস্থায় যেন ঘুণ ধরে গেছে। এই সমাজের প্রতি চরম আঘাত করতে চাই—যে আঘাত করেছিলাম পাকিস্তানিদের। সে আঘাত করতে চাই এই ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে। আমি আপনাদের সমর্থন চাই। আমি জানি আপনাদের সমর্থন আছে কিন্তু একটা কথা, এই যে নতুন সিস্টেমে যেতে চাচ্ছি আমি, গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ করা হবে। ভুল করবেন না। আমি আপনাদের জমি নেব না। ভয় পাবেন না যে, জমি নিয়ে যাব। তা নয়। পাঁচ বছরের প্ল্যান—এই বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে কো-অপারেটিভ হবে। প্রত্যেকটি গ্রামে গ্রামে এই কো-অপারেটিভ-এ জমির মালিকের জমি থাকবে। কিন্তু তার অংশ—যে বেকার, প্রত্যেকটি মানুষ, যে মানুষ কাজ করতে পারে, তাকে কো-অপারেটিভ-এর সদস্য হতে হবে। এগুলো বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। পয়সা যাবে তাদের কাছে, ওয়ার্কাস প্রোগ্রাম যাবে তাদের কাছে। আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিল টাউটদেরকে বিদায় দেওয়া হবে, তা না হলে দেশকে বাঁচানো যাবে না। এই জন্যই ভিলেজ কো-অপারেটিভ হবে। আমি ঘোষণা করছি আজকে যে, পাঁচ বছরের প্ল্যানে প্রত্যেকটি গ্রামে ৫০০ থেকে হাজার ফ্যামিলি পর্যন্ত নিয়ে কম্পলসারি কো-অপারেটিভ হবে।’
দেশের অর্থনীতি নতুন করে গড়ে তুলতে ১৯৭৩ সালে প্রথম পাঁচসালা বা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। দারিদ্র দূর করা, সবার জন্য কর্মসংস্থান, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদা পূরণ, এবং কৃষির আধুনিকায়নের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানোই ছিলো প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য। দায়িত্ব নেয়ার কয়েক মাসের মধ্যে দেশের কৃষি ক্ষেত্রে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনেন বঙ্গবন্ধু। কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে সার ও কীটনাশকসহ কৃষি উপকরণ বিতরণ, ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে খাসজমি বণ্টন, পাঁচ হাজার টাকার উপরে কৃষিঋণ মওকুফ, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তিনি।