নিউজ ডেস্ক : ঐতিহাসিক ২৩ জুন। এদেশের বৃহত্তম এবং ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গৌরব ও ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন কাজী বশিরের স্বামীবাগস্থ বাসভবন ‘রোজ গার্ডেনে’ অনুষ্ঠিত সম্মেলনের মাধ্যমে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা পালনের মাধ্যমে দলটি পূর্ববাংলার একক ও নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। ১৯৫৫ সালে দলীয় মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা গ্রহণের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’ নামকরণ করা হয়।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে ছয়দফা আন্দোলন, ১৯৬৮ সালে আগরতলা মামলা, ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান প্রভৃতি আন্দোলন-সংগ্রামে আওয়ামী লীগ দলটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে অংশ নিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধুর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে পরিচালিত দীর্ঘ ৯ মাসের বীরোচিত মুক্তিযুদ্ধ, ৩০ লক্ষেরও অধিক শহিদের রক্ত এবং ৩ লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রম হানির বদৌলতে বাংলাদেশ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৮৮ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক হলিস বি. শেনারি ১৯৭৩ সালে বলেছিলেন, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৯০০ ডলারে পৌঁছাতে সময় লাগবে ১২৫ বছর। কিন্তু স্বাধীনতার ৪০ বছরে ২০১১ সালে এদেশের মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ৯২৮ ডলারে। ২০২০ সালে তা ২০০০ ডলার ছাড়িয়েছে। করোনা মহামারির মধ্যে প্রায় সব দেশে যেখানে অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে, মাথাপিছু আয় কমেছে; সেখানে ২০২১ সালে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ২২২৭ ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছে সরকার। ১৯৭৬ সালে অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফালান্ড এবং জন রিচার্ড পারকিনসন বাংলাদেশ : দ্য টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট গ্রন্থে লিখেছিলেন, উন্নয়ন প্রত্যয়টি যদি বাংলাদেশে সফল হয়, তাহলে পৃথিবীর সব জায়গায় সফল হবে। উন্নয়নের ‘টেস্ট কেস’ নামে আলোচনায় আসা দেশটি সব বাধা পেরিয়ে এখন উন্নয়নের বিস্ময়কর রোলমডেল হিসেবে বিশ্বদরবারে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর অন্যতম দ্রুততম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশ। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অনন্য সব অর্জন নিয়ে ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছর উদ্যাপন করেছে প্রিয় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের শ্রেণীকরণে ২০১৫ সালের ১ জুলাই নিম্ন আয় থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে ধারাবাহিক উন্নতির কারণে বাংলাদেশ এ তালিকায় আসে। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্য বলে স্বীকৃতি দেয়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওই কমিটি বাংলাদেশকে উত্তরণের জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ করে। মাথাপিছু আয়ের পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য সামাজিক সূচকে উন্নতি এবং অর্থনীতির সক্ষমতার বিচারে বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্য বলে মনে করেছে জাতিসংঘ। ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বের হয়ে ভারত, চীন, মালয়েশিয়ার মতো এলডিসি নয় এমন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাবে বাংলাদেশ। ২০২০ সালে দ্য ইকোনোমিস্ট ৬৬টি সবল অর্থনীতির তালিকা প্রকাশ করে, যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য বা এমডিজি’র অনেক সূচক অর্জন করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কেড়েছে বাংলাদেশ। এমডিজিতে ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি হারে কমাতে বাংলাদেশ সক্ষম হয়। এমডিজি অর্জনের জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশ। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অর্মত্য সেন তাঁর ভারত : উন্নয়ন ও বঞ্চনা গ্রন্থে লিখেছেন, বাংলাদেশ সামাজিক উন্নয়নের পথে দ্রুত এগিয়ে যাবে, এ কথা কেউ ভাবেনি। দেশ স্বাধীনের পর অনেকেই তখন বলেছিলেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কেউ কেউ তাকে ‘বাস্কেট কেস’ বলে খরচের খাতায় ফেলে দিয়ে বলেছিলেন, এ দেশকে কোনো অর্থনৈতিক সাহায্য দেয়াই উচিত নয়। কারণ, সে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খাদ্য উৎপাদন করে উঠতে পারবে না। তিনি আরও বলেছেন, জীবনমানের নানা সুপ্রচলিত মাপকাঠিতে বাংলাদেশ কেবল ভারতের চেয়ে অনেক ভালো করছে না, অনেকটা এগিয়েও গেছে। অনেক সামাজিক সূচক, যেমন: গড় আয়ু, শিশুমৃত্যুর হার, টিকা দেওয়ার মাত্রা, সনাতন প্রজননের হার এবং এমনকি স্কুলশিক্ষার কিছু মাপকাঠিতে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বিজয় অর্জন আমাদের জন্য সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ অনেক দূরে এগিয়ে গেছে। দারিদ্র্যবিমোচন, শিক্ষারপ্রসার, নারী উন্নয়ন, শিশু ও মাতৃমৃত্যুরহার কমানোসহ বিভিন্নক্ষেত্রে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে এগিয়ে যাচ্ছে প্রিয় স্বদেশ। জাতিসংঘ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ, মহেশখালীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরসহ সারাদেশে ১০০টি অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশের প্রতিটি ঘরে এখন বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। ধান, ফল, মাছ উৎপাদনে বিস্ময়কর সাফল্য এসেছে। শিশুদের টিকাদান কর্মসূচির সাফল্যের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম আদর্শ দেশ হিসেবে অবস্থান করে নিয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবতায় রূপ দিয়ে বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। কৃষিখাতে অভূতপূর্ব সাফল্যের জন্য বিশ্বদরবারে বারবার আলোচিত হয়েছে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে সমগ্র বিশ্বের নিকট প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিবিড় সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্রঋণের ব্যবহার এবং দারিদ্র দূরীকরণে সাফল্য, বৃক্ষরোপণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকের ইতবাচক পরিবর্তন প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমগ্র বিশ্ব এখন বাংলাদেশকে উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ গণ্য করছে। ২০২০ সালের সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। এখন যে ধরনের অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনোমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের ওয়ার্ল্ড লিগ টেবিল ২০২১ রিপোর্টে। রিপোর্ট অনুযায়ী উন্নয়নের চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ১৫ বছর পর বিশ্বের ১৯৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থান হবে ২৫তম। উন্নয়ন গবেষকরা আজকের বাংলাদেশকে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’, দক্ষিণ এশিয়ার ‘তেজি ষাঁড়’, অফুরন্ত সম্ভাবনার এক বাংলাদেশ’সহ নানা অভিধায় ভূষিত করেছেন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে আমরা বিশ্বসভায় অন্য এক মর্যাদাপূর্ণ বাংলাদেশকে দেখতে পেয়েছি। বর্তমান সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়া।
যে বাংলাদেশ এক সময় পরিচিতি সমস্যায় ভুগতো, সেই বাংলাদেশ এখন সমগ্র বিশ্বে পরিচিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁরই কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশের গৌরব ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কারণে। যে বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করেছিল শূন্য হাতে সেই বাংলাদেশ এখন মহাশূন্যে উপগ্রহ পাঠায়, নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু বানায়। ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে যে দেশটি যাত্রা শুরু করেছিল, অনেক ঘাত-প্রতিঘাত ও চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সেই বাংলাদেশ এখন বিশ্বের চোখে এক বিস্ময়। ২০২১ সালের ১০ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে নিকোলাস ক্রিস্টফ বাংলাদেশ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ৫০ বছর আগে এই মাসে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি জন্ম নিয়েছিল জেনোসাইড, দারিদ্র্য ও ক্ষুধার মধ্যে। তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে দারিদ্র্য বিমোচনের উপায় জানতে বাংলাদেশের নিকট থেকে শিক্ষা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। ওয়াশিংটন পোস্ট-এর ভাষ্যকার মাইক বার্ড লিখেছেন, একসময় দক্ষিণ কোরিয়াকে উন্নয়নের মডেল হিসেবে উদাহরণ দেওয়া হতো। এখন বাংলাদেশের উদাহরণ দেওয়া হয়।
উন্নয়নের সূচকে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি তার ভিত্তি রচনা করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি ঘোষণা করেছিলেন, মাটি ও মানুষকে কাজে লাগিয়ে এদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করবেন। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও তাদের জীবনমানের উন্নতির জন্য তিনি আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যার সুযোগ্য নেতৃত্ব, কূটনৈতিক দক্ষতা ও নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আজ সত্যিকারঅর্থেই ইতিহাসের স্বর্ণযুগে।
লেখকঃ মোহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম রাসেল
সদস্য, প্রচার ও প্রকাশনা উপ-কমিটি
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ