ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল
আজ বিশ্ব বাবা দিবস। আমি সারা বছর হরেক বিষয়ে হকের রকম লেখালেখির চেষ্টা করি। লিখি কাজের ফাঁকে আর ব্যস্ততার অবসরে। লিখি নানান বিষয়ে, কিন্তু আজকের মত লেখা লিখেছি কমই। আজকের লেখাটা আজকের এই বিশেষ দিবসে আমার প্রয়াত পিতার উদ্দেশে উৎসর্গকৃত, যার মত হওয়ার আমার চেষ্টাটা নিরন্তর, তবে এখন পর্যন্ত লক্ষ্যটা অর্জনের ধারে কাছেতো পৌঁছাতে পারি-ই নাই, কোনদিন আদৌ পারবো কিনা তাও জানিনা। আমার প্রয়াত পিতা প্রকৌশলী মাহতাব উদ্দিন আহমেদ একজন লড়াকু মানুষ ছিলেন। অসুস্থতার সাথেও লড়েছিলেন দীর্ঘদিন। কিন্তু পরপর তিন-তিনটি হার্ট অ্যাটাকে ধাক্কা সামলাতে না পেরে অবশেষে ২০১৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোর চারটায় তিনি এই পৃথিবী ছেড়ে যান।
পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন প্রকৌশলী। কাজ করতেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে। প্রতিষ্ঠানটির সর্বোচ্চ পদ প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তৎকালীন ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন বোর্ড ও যমুনা বহুমুখী সেতু কর্তৃপক্ষের (বর্তমানে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ) নির্বাহী পরিচালকের পদেও কিছুদিন কাজ করেছেন। কাজেই পেশার জায়গা থেকে তিনি সফল ছিলেন এটুকু বলাই যায়। আমার যতটুকু দেখা, তাকে তার সহকর্মীরা যেমন ভয় পেতেন, ভালোও বাসতেন ঠিক তেমনি ভাবেই। তার কাছে অফিস মানে ছিল সপ্তায় সাতটি দিন, আর দিনে সম্ভব হলে চব্বিশ ঘন্টাই। আবার সহকর্মীদের বিপদে তাদের পাশে দাঁড়াতেন বটের ছায়া হয়ে। আমার মনে আছে ভিভিআইপি অন্টোরাজের কাছাকাছি চলে আসায় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তার সরকারি গাড়ি চালককে গ্রেফতার করতে চাইলে তিনি নিজ চাকরির ঝুঁকি নিয়ে তাদের বাধা দিয়েছিলেন, কারন তার সরকারি চালকটি তার নির্দেশেই ওয়ার্ক সাইটে তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর তারায় ঐ অঘটনটি ঘটিয়ে বসেছিল।
উত্তরবঙ্গের সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়নে আমার বাবা তার পেশার জায়গা থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর পর থেকে পঞ্চগড় পর্যন্ত মহাসড়কগুলোর সংস্কার এবং সম্প্রসারণ তার তত্ত্বাবধানেই হয়েছিল। পাশাপাশি দক্ষিণবঙ্গের সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নেও তিনি ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি তার কর্মবহুল জীবনে রোড রিহ্যাবিলিটেশন এন্ড মেইন্টেইনেন্স প্রজেক্টের প্রজেক্ট ডাইরেক্টর হিসেবে কর্মরত ছিলেন, যা সে সময় বিশ্বব্যাংক কর্তৃক এশিয়া মহাদেশের শ্রেষ্ঠ প্রজেক্টের স্বীকৃতি পেয়েছিল। পাশাপাশি দেশীয় সড়ক নির্মাণ শিল্পের বিকাশে তিনি অবদান রেখেছিলেন। তার প্রস্তাবিত ‘ডমেস্টিক প্রাইস প্রেফারেন্সের’ প্রণোদনার কারণে পরবর্তী সময়ে দেশে সড়ক নির্মাণে বৃহৎ প্রতিষ্ঠাগুলো বিকশিত হয়, যারা আজও এদেশে এই সেক্টরটিতে নেতৃত্বে দিচ্ছেন।
আমার বাবা সবসময় চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসতেন। জেনারেল এরশাদের মার্শাল ল’র সময়ে তৎকালীন উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও নৌ বাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান ছিলেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। আজকের যে মুক্তি সরণী, সেখানটায় একটা সময় ছিল গভীর খাদ। মাথা গরম এই নৌ কর্মকর্তার খায়েশ হয়েছিল তিনি সেই খাদটুকু আর দেখতে চান না। মুক্তি সরণী নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী আমার বাবাকে তিনি সময় দিয়েছিলেন চব্বিশ ঘন্টা। আমার বাবাও কাজটি করে দেখিয়েছিলেন। চব্বিশ ঘন্টা পর সড়ক পথে সিলেট থেকে ঢাকায় ফিরতি পথে ঐ নৌ কর্মকর্তা আমার বাবার পেছনে মোটর সাইকেলে চড়ে ঐ খাদের জায়গাটি পার হয়েছিলেন, কারণ এর মধ্যেই আমার বাবা পুরো খাদটি জুড়ে প্রশস্ত সড়ক নির্মাণ করতে না পারলেও, মোটর সাইকেল চলার উপযোগী একটি রাস্তা ঠিকই তৈরি করে ফেলেছিলেন।
এমন অনেক গল্পই আজ মনে পড়ছে তাকে নিয়ে লিখতে বসে। আশির দশকের শুরুর দিকে তিনি যখন পার্বত্য চট্টগ্রামে মাইনি ভ্যালি প্রজেক্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন, তখন তাকে দেখেছি সে সময়ে ঐ অঞ্চলে সক্রিয় শান্তি বাহিনীর শীর্ষ নেতাদের সাথে গভীর রাতে বাসায় বসে মিটিং করতে। একইভাবে নব্বইয়ের দশকেও দেখেছি রোড ইম্প্রুভমেন্ট এন্ড মেইন্টেনেন্স প্রজেক্টের প্রজেক্ট ডাইরেক্টর হিসেবে কর্মরত আমার বাবাকে কুষ্টিয়া অঞ্চলের সর্বহারাদের সাথে বাসায় গভীর রাতে বৈঠকে বসতে। উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, তাদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করানো যে তারা যেন তাদের এলাকার মানুষের স্বার্থে এই উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে বাধাগ্রস্ত না করেন। বলাই বাহুল্য এই দু জায়গাতেই তিনি সফল হয়েছিলেন।
আমার বাবা মনেপ্রাণে ছিলেন একজন ‘খাটি সিলেটি’! তার পুরো চাকরি জীবনের স্বপ্ন ছিল সিলেটকে ঢাকার আরো কাছাকাছি নিয়ে আসা। তার এই স্বপ্নটি বাস্তবায়নের সুযোগটিও তিনি পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ভৈরব হয়ে ঢাকা সিলেটের বর্তমান মহাসড়কটির নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী। শুধু তাই নয় এই প্রকল্পটির প্রস্তাবনাটিও ছিল তারই। তিনি প্রায়ই গর্ব করে বলতেন যে, তিনি-ই প্রথম সিলেটি যিনি এই রাস্তা দিয়ে গাড়ি করে ঢাকা থেকে সিলেট গিয়েছেন। প্রকল্পটির প্রজেক্ট ডাইরেক্টর হিসেবে তিনি এইটুকু প্রিভিলেজ গ্রহণের সুযোগটি হাতছাড়া করতে চাননি।
রোড ইম্প্রুভমেন্ট এন্ড মেইন্টেনেন্স প্রজেক্টটি থেকে প্রায় একুশ কোটি টাকা সাশ্রয় করেছিলেন আমার প্রয়াত বাবা। সে সময়ে খুলনার বিভাগীয় কমিশনার ছিলেন মরহুম ফজলুল হক মিয়া। ফজলুল হক চাচার ছেলে ইমন, আজকের ঢাকা সিএমএইচ-এ কর্মরত লেফটেনেন্ট কর্নেল ডা. একেএম ফয়জুল হক, সে সময়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে আমার রুমমেট ছিল। সেই সুবাদে চাকরির সূত্রে খুলনায় থিতু হওয়া আমাদের দুজনের বাবাদেরও ছিল প্রচণ্ড সখ্য। দুজনের আরেকটা জায়গায় মিল ছিল। দুজনই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অন্ধ ভক্ত এবং পাশাপাশি স্নেহধন্যও। এই দুই সরকারি কমকর্তা এ সময় একটা দারুণ ‘ষড়যন্ত্র’ করে বসেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী তখন খালেদা জিয়া। অথচ তারা ঐ প্রজেক্ট থেকে সাশ্রয় করা টাকার কিছুটা অংশ ব্যয় করে গোপালগঞ্জের মোড় থেকে টুঙ্গিপাড়া পর্যন্ত কাঁচা সড়কটিকে হেরিংবোন সড়কে উন্নীত করেন। এর প্রায়শ্চিত্তও তাদের ঠিকঠাক মতই করতে হয়েছিল। ফজলুল হক মিয়া চাচাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় বিএনপি সরকার। আমার বাবার কপালে জোটে ওএসডি। বাধ্যতামূলক অবসরের জায়গায় কেন ওএসডি সেটা ব্যাখ্যা করছি এখনই।
জেনারেল এরশাদের মার্শাল ল’র সময় কোন কারণ না দর্শিয়েই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক চাইলেই যে কোন সরকারি কর্মকর্তাকে মার্শাল ল অর্ডিনেন্স নম্বর ৯ (এমএলও ৯) নামের এক অদ্ভুতুরে কালো আইনের বলে বরখাস্ত করতে পারতেন। আমার বাবার কপালেও জুটেছিল এই এমএলও ৯। অপরাধটা ছিল অবশ্যই ‘গুরুতর’। সামরিক সরকারের সে সময়কার দাপুটে কর্মকর্তা মেজর জেনারেল আতিকের ভাতুস্পুত্রকে পার্বত্য চট্টগ্রামের মাইনি ভ্যালি প্রজেক্টে কাজ দেয়ার অন্যায় আবদারটি রক্ষা না করায় জেনারেল আতিকের অভিযোগে জেনারেল এরশাদ আমার বাবাকে এমএলও ৯ করে ঘরে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সামরিক আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা জিতে চাকরি ফিরে পেয়েছিলেন আমার বাবা। এ কাজটাও একদমই সহজ ছিল না। সামরিক আইনের বিরুদ্ধে মামলা করায় আগ্রহী কোন ল’ইয়ারের খোঁজ আমার বাবা সে সময়টায় গরু খোঁজা করেও পাননি। পরে নিজেই সান্ধকালীন ল’ কলেজে ভর্তি হয়ে ওকালতি পাস করেছিলেন তিনি।
আমার বাবা প্রচলিত অর্থে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। একাত্তরে তিনি চট্টগ্রামে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (তৎকালীন কন্সট্রাকশন এন্ড বিল্ডিং)-এ নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের পথে রওনা হয়েছিলেন। মাঝ পথে আমার প্রয়াত পিতামহ তাকে কাপ্তাই থেকে ফিরিয়ে আনেন। সরকারি চাকুরে ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলে তাতে তার অন্যান্য ছেলেমেয়েদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার ভয়ে ভীত হয়েই এমনটি করেছিলেন আমার প্রয়াত দাদা। একাত্তরের পুরোটা সময় আমার বাবা মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীকে পাকিস্তানী সেনা মুভমেন্ট সম্বন্ধে তথ্য সরবরাহ করতেন। সড়ক ও জনপথে কর্মরত থাকার কারণে এ ধরনের মুভমেন্টগুলোর খবরা-খবর তার কাছে আগে-ভাগে চলে আসতো।
পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক সহায়তা প্রদানেরও। বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে তাকে পাকসেনারা হত্যার উদ্দেশে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তার পরম সৌভাগ্য তিনি নির্মম নির্যাতনের বিনিময়ে প্রাণে রক্ষা পান। কারণ তাকে হত্যার দায়িত্বপ্রাপ্ত পাকিস্তানী মেজরের একমাত্র ছেলেটিও ছিল সে সময় আমার সমান। দশ মাস বয়সের আমি আগের দিন প্রথম ‘আব্বা’ বলে ডেকেছি জেনে মেজর সাহেবের কেন যেন একটু দয়ার উদ্রেক হয়েছিল। তবে বন্দুকের বাটের আঘাতে-আঘাতে তার কোমড়ে যে স্থায়ী ক্ষত তৈরি হয়েছিল, সেজন্য তিনি কষ্ট পেয়েছেন জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত। প্রচণ্ড কোমড় ব্যথায় তিনি রাতের পর রাত জেগে থাকতেন অথচ কিডনির ক্ষতি হবে বলে আমি ডাক্তার হয়েও তাকে ভালো কোন ব্যথার ওষুধ দিতে পারিনি।
পাশাপাশি আমার বাবা একজন প্রচণ্ড কোমল হৃদয়ের অধিকারী মানুষ ছিলেন। তার মৃত্যুর পর একজন ভদ্রলোকের কাছে শুনেছি, সে সময়টায় তিনি আর্থিক সংকটে ছিলেন। তার উপর মাথায় বোনের বিয়ের দায়িত্ব। আমার প্রয়াত বাবা তাকে অনুদান দিয়ে ছোট করেননি, কিন্তু বিয়েতে তার বোনকে একটি সোনার হার উপহার দিয়েছিলেন। আমার ময়মনসিংহ জমানায় নব্বইয়ের দশকের শুরুতে মোবাইল ফোন ছিল খালেদা জিয়ার বাংলাদেশে একটি দুষ্প্রাপ্য বস্তু। গদা সাইজের মোবাইল ফোনের এক আঘাতে মাথার খুলি উড়িয়ে দেয়া গেলেও, সেই মোবাইল হাতে পেতে সেই আমলে গুণতে হতো লক্ষাধিক টাকা। এহেন দুষ্প্রাপ্য বস্তু আমাদের বন্ধু-বান্ধবদের হাতের নাগালে চলে এসেছিল আমার প্রয়াত পিতার কল্যাণে। কারণ তার সরকারি গাড়িতে বসানো ছিল একটা মোবাইল ফোন যা কাজ করতো শুধু মাত্র ঢাকা শহরের চৌহদ্দীর ভিতরে। আর সেই মোবাইলে দু-এক মিনিট এদিক-সেদিক কথা বলাটা ছিল আমাদের কাছে এক বিরাট বিনোদন।
উদাহরণ আছে এমনি আরো অনেক। আমি এমন একজনকে চিনি যিনি একটি বাহিনীর সর্বোচ্চ পদে চাকুরি করে পরে খালেদা জিয়া সরকারের রোষাণলে পরে দীর্ঘদিন কষ্ট করেছেন। এমনকি জেলের ঘানিও টেনেছেন বেশ কিছু দিন। তার পাশে ছিলেন আমার প্রয়াত পিতা তার সেই দুর্দিনে, নিজের উপরও বিএনপি সরকার খরগহস্ত হতে পারে জেনেও। একজন সফল প্রকৌশলী হিসেবে তিনি ছিলেন অনেকের জন্যই অনুপ্রেরণার উৎস। এতটাই যে, আমার মার্কিন প্রবাসী মামাতো ভাইকে বলতে শুনেছি তিনি আমার বাবাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে আমেরিকার মত দেশে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন এবং যোগদানও করেছিলেন মার্কিন সরকারের মহাসড়ক নির্মাণ সংস্থায়।
আমার বাবা একজন ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। দিনে পাচবার নামাজ আর বছরে ত্রিশ দিন রোজা রাখার পাশাপাশি তার অন্যতম হবি ছিল নিয়মিত কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না করিয়ে গরিবদের মাঝে তা বিতরণ করা আর প্রতি বছর শীতকালে ঢাকার ফুটপাতে-ফুটপাতে কম্বল বিলি করে বেড়ানো। তার সাথে গাজীপুর বা ব্রাক্ষণবাড়িয়ার কোন ভাবেই কোন যোগাযোগ ছিল না। তারপরও তিনি এই দুটি জেলায় দুটি মসজিদ নির্মাণের ব্যয় ভার বহন করেছিলেন।
আমার পিতা ছিলেন একজন পরিপূর্ণ মানুষ। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত তিনি তার নিজের টাকায় জীবন যাপন করে গেছেন। ছেলে বা মেয়ের কাছে তাকে কখনও হাত পাততে হয়নি। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, কাজেই রাষ্ট্রীয় শেষকৃত্য তার প্রাপ্য ছিল না। কিন্তু বনানী জামে মসজিদে বাদ যোহর জানাজা শেষে বনানী গোরস্থান পর্যন্ত তার শেষ যাত্রায় সঙ্গী হয়েছিল আনুষ্ঠানিক পুলিশ এসকোর্ট। কারণটা তখন বুঝিনি। জেনেছি অনেক পরে। বড় আপাকে বলে ব্যবস্থাটি করেছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অকাল প্রয়াত বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল ভাই।
আমি সম্প্রতি বহু সাধের একটা গাড়ি কিনেছি। মা’র জন্মদিনে মাকে সাধের সেই গাড়িটিতে চড়িয়ে ঘুড়িয়ে এনেছি একটা চক্কর। ফেসবুকে এই ছবি দেখে অনেকে অভিনন্দন জানিয়ে অনেক রকম মন্তব্য করেছেন। সঙ্গত কারণেই হঠাৎ গাড়িটা কেনার কারণটা জানতে চাননি কেউই। সত্তরের দশকের শেষের দিকে আমার বাবার পোস্টিং হয় সড়ক ও জনপথের ওয়ার্কশপ শাখায়। সেখানে তিনি আবিষ্কার করেন গ্যারেজে পরে থাকা জরাজীর্ণ একটা মার্সিডিজ। পরে পরে নষ্ট হচ্ছিল অমন খানদানি গাড়িটি। তরুণ তুর্কী প্রকৌশলী মাহতাব উদ্দিন আহমেদ গাড়িটি ওয়ার্কশপ থেকে বের করে দু’একদিন চালিয়েছিলেন।
খবরটা পৌঁছে গিয়েছিল জয়পুরহাটের নামকরা রাজাকার আব্দুল আলিমের কানে। সে তখন জিয়ার মন্ত্রিসভায় যোগাযোগ মন্ত্রী। গাড়িটিতো তার বাসায় পৌঁছে দিতে হয়েছিলই, দুর্ব্যবহার করেছিল সে আমার প্রয়াত পিতার সাথে। আমি নিশ্চিত জানি ওপারে বসে আমার বাবা আমার এই গাড়ি কেনার বিষয়টি দারুণ উপভোগ করছেন, যেমনটি তিনি উপভোগ করতেন আমার প্রতিটি সাফল্য- পত্রিকায় প্রকাশিত কোন লেখা, সাইন্টিফিক জার্নালে প্রকাশিত কোন আর্টিক্যাল অথবা প্রকাশিত কোন বই। পরম যত্নে নিজের বালিশের নিচে রেখে দিতেন সেটি। আর পাশাপাশি আমার ঢোল পেটানোয় তার ধারেকাছেও ছিল না কেউই। গভীর রাতে চেম্বার শেষে আমি ঘরে না ফেরা পর্যন্ত কোনদিন ঘুমাতে দেখিনি তাকে।
বিএনপির সময় টেন্ডারবাজির দিনগুলোতে সড়ক ও জনপথের যে কর্তাব্যক্তিটি টেবিলে লাইসেন্স করা রিভলবার রেখে অফিস করতেন, ভয়ে যার ধারে কাছেও ঘেঁষতো না কোন টেন্ডারবাজ, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নানা ভোগান্তির শিকার হয়ে পুরোপুরি ভেঙে যায় সেই মাহতাব উদ্দিন আহমেদের শরীরটা এবং একটা সময় পরাস্ত হন তিনি। তিনি পরাস্ত হয়েছিলেন, কিন্তু হার মানেননি। আজকের এই বিশেষ দিবসে ‘হার না মানা, সেই বাবার প্রতি তার গর্বিত সন্তানের এটি একটি গর্বিত নিবেদন।
লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও চেয়ারম্যান ফোরাম ফর দ্যা স্টাডি অব দ্যা লিভার বাংলাদেশ।