ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) : একেক খেলায় একেক রকম নিয়ম। স্প্রিন্টে জিততে হলে ছুটতে হয়। যে যত জোরে ছুটবে, জিতটা হবে তার। আবার এর উল্টোটাও আছে। ছোটবেলায় তেমন খেলাও ঢের খেলেছি। সেই আমলে সিডি প্লেয়ারের বালাই ছিল না। সেই সময় ছিল গদা সাইজের ক্যাসেট প্লেয়ার, আর তাতে বাজত ফিতা লাগানো ক্যাসেট। ক্যাসেট প্লেয়ারের ওপরের প্রমাণ সাইজের বোতামটায় চাপ দিলে বাজতে শুরু করত গান। তার তালে তালে নাচতে হতো; আর হঠাৎ করে বোতামটি আবার টিপে দিয়ে গানটা বন্ধ করলে কাজ ছিল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়া। যারা পারত তারা টিকত, আর যারা পারত না তারা খেলা থেকে বাদ। এভাবে শেষ পর্যন্ত যে টিকে থাকত খেলা শেষে জিতত সে-ই। জীবনের পঞ্চাশটা বছর পার করে এসে ছোটবেলার সেই খেলাটার নাম মনে করতে পারছি না। সম্ভবত খেলাটার নাম ‘বরফ-পানি’ আর সাহেবি নাম ছিল ‘স্ট্যাচু’। নাম যা-ই হোক না কেন, এত বছর পর খেলাটার কথা হঠাৎ মনে পড়ল দুই-তিন দিন ধরে টিভির পর্দায় ঈদে ঘর-ফিরতি মানুষের নানা কসরত আর যুক্তির ফুলঝুরিতে।
এটা তো মানতেই হবে যে আমাদের কচ্ছপগতির জীবন গত এক যুগে খোলনলচে পাল্টে গেছে। আমরা ছুটছি তো ছুটছি। আরবি ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে আগে আগে ছুটছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আর পেছনে গোটা জাতি। আর সেই ছুটে চলাটাও বহুমাত্রিক। ছুটছে বাংলাদেশ পদ্মার বিশাল বিস্তারকে জয় করতে যেমন একদিকে, তেমনি অন্যদিকে মহাকাশে ছুটছে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট। কয়েক দিন পর ঢাকায় ছুটবে মেট্রো রেল আর কর্ণফুলীর পাতালে চলবে গাড়ি। সেই দিনও আর দূরে নয়, যখন দেশটা ভাসবে পারমাণবিক বিদ্যুতে, আর চার কিংবা ছয় লেনের মহাসড়কে যুক্ত হবে দেশের প্রতিটি জনপদ। ধান, পাট, শাক-সবজি, ফল, মাছ কিংবা ডিম—এসব কিছুর উৎপাদনে শীর্ষ দশে থাকা এ জাতির মানসিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এমন আমূল পরিবর্তন এনেছেন যে এরা এখন আর থামতেই চায় না। এরা ছুটছে গার্মেন্টে, খুদে ব্যবসায়, আর কলকারখানায়; তারপর ঈদটা যখন সমাগত তখন তাদের সব ছোটাছুটি গ্রামে ছেড়ে আসা প্রিয়জনদের উদ্দেশ্যে। হোক না ছুটি মাত্র তিনটি দিনের, তাতে কী? কী এসে যায় পথে বাস না চললে, আর ঘাট না ছাড়লে ফেরি? পথে পুলিশের চেকপোস্ট কিংবা ঘাটে বিজিবির টহল, থামবে না তারা কিছুতেই। তারা ছুটবে তো ছুটবে! এক যুগে যদি হয় একটি প্রজন্ম, তাহলে শেখ হাসিনার প্রজন্ম তো ভুলেই গেছে বসে থাকা। তাদের ডিকশনারিতে স্থবিরতা শব্দটি খুঁজতে হলে ঘাঁটতে হবে পাতার পর পাতা। বেন জনসনকে বরফ-পানি খেলতে বললে ফলাফল যা দাঁড়াত, কভিডের বিধি-নিষেধ মানতে গিয়ে বাঙালির আজ সেই দশা!
অথচ কভিড রোগটা এমনটাই যে এখানে গতি আর স্থিতি জড়তার সমন্বয় ছাড়া মুক্তি নেই। জীবন বাঁচলে থমকে যায় জীবিকা, আর জীবিকাকে অগ্রাধিকার দিলে জীবন পড়ে সংশয়ে। জীবন আর জীবিকাকে তাই চলতে দিতে হয় পাশাপাশি। কখনো জীবন আগে, তো কখনো জীবিকা। শুধু জীবনের অগ্রাধিকারে পরিণতিটা হতে পারে আমাদের প্রতিবেশীর মতো। পাঁচটি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বেসামাল নির্বাচন আর একটা ধর্মীয় উৎসব—পরিণতিতে কাঁদছে গোটা ভারত। অথচ ভারতের স্বাস্থ্য অবকাঠামো আমাদের তুলনায় তো বটেই, গোটা বিশ্বেই ঈর্ষণীয়। যে দিল্লি, মুম্বাই বা বেঙ্গালুরুতে চিকিৎসা নিতে শুধু বাংলাদেশ থেকেই নয়, রোগী ছুটে আসত মধ্যপ্রাচ্য, এমনকি উন্নততম পশ্চিম ইউরোপ থেকেও, তারাই হিমশিম খাচ্ছে কভিডের সাম্প্রতিকতম ঢেউটা সামলাতে গিয়ে। শুধু ভারতের কথাই বা বলি কেন, গত বছরের এ সময়টায় যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? ওই সময় না ছিল ভারতীয় ভেরিয়েন্ট, না সাউথ আফ্রিকান, ব্রাজিলিয়ান কিংবা ব্রিটিশ ভেরিয়েন্টও। তার পরও কভিডে মানুষ মরেছে অকাতরে, যেমন মরেছে একই সময় ইতালি আর ফ্রান্সেও। কারণটা সবারই জানা। এসব দেশ তখন জীবিকাকে দিয়েছিল জীবনের ওপর অগ্রাধিকার। আবার সেই ব্রিটেনই যখন জীবনকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে কঠিন লকডাউনে, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সে দেশে প্রথমবারের মতো প্রয়োজন পড়েছে স্কুলে, স্কুলে মিড-ডে মিল সরবরাহের, আর মানুষের না খেয়ে মরা ঠেকাতে বিত্তবানদের থেকে বাড়তি খাবার সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে ফুডব্যাংক।
জীবন আর জীবিকার সমন্বয়ে হাতে গোনা যে গুটিকয়েক সরকার গোটা বিশ্বে মুনশিয়ানার স্বাক্ষর রেখেছে, তার অন্যতম শেখ হাসিনার সরকার, যার স্বীকৃতিও মিলেছে একের পর এক। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, কমনওয়েলথ কিংবা ব্লুমবার্গ—গুনে শেষ করা কঠিন। সেই বাংলাদেশে ঈদকে সামনে রেখে আজকের বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে আজ ঢুকে পড়েছে কভিডের ‘ভেরিয়েন্ট অব কনসার্ন’ সাউথ আফ্রিকান, ব্রাজিলিয়ান, আর ব্রিটিশ ভেরিয়েন্টগুলোর সঙ্গে সর্বশেষ সংযোজন ‘ভেরিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট’ ইন্ডিয়ান ভেরিয়েন্টটি। এসব ভারী কথার শানেনজুল হচ্ছে, শঙ্কা আছে—স্বাস্থ্যবিধি না মানলে ঈদের সপ্তাহখানেকের মধ্যেই আমাদের ঘরের দুয়ারে হানা দিতে পারে কভিড বর্গীর তৃতীয় ঢেউটি। কারণ এত সব ভেরিয়েন্ট থাকা মানে কভিডের সংক্রমণের সক্ষমতা বেড়ে গেছে ৭০ থেকে ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত। আর যদি বাড়তে থাকে রোগী, মিলবে না কভিড হাসপাতালে বিছানা, জুটবে না প্রয়োজনীয় হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা আর ভেন্টিলেটরও। জুটবে শুধু ভোগান্তি আর দীর্ঘ হবে কবরস্থানে দাফনের জন্য অপেক্ষমাণ লাশের সারি। গত মাসেই কিন্তু ঢাকার শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে এক্সকাভেটর দিয়ে খুঁড়ে রাখতে হচ্ছিল আগাম কবর। তার চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি যদি আমরা হতে না চাই তাহলে বরফ-পানি খেলায় জিততেই হবে এখনই। মনে রাখতে হবে, দিল্লি, বেঙ্গালুরু বা মুম্বাইয়ের সামনে স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতায় ঢাকা, চট্টগ্রাম কিংবা সিলেট দাঁড়াতেই পারবে না। কাজেই দিল্লি, বেঙ্গালুরু বা মুম্বাইয়ের মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হলে ঢাকা, চট্টগ্রাম কিংবা সিলেটের পরিস্থিতিটা কী দাঁড়াবে তা আমাদের চিন্তারও বাইরে।
সেই প্রেক্ষাপটেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির কাছে প্রশ্ন রেখেছেন—এই একটা ঈদে দেশে না গেলে কী হয়? আহ্বান জানিয়েছেন যার যার অবস্থানে থেকে ঈদ উদযাপন করতে, আর আজকের এই ডিজিটাল বাংলাদেশে এটি তো খুবই সম্ভবও। আমাদের ধর্মেও তো আছে যেখানে মহামারি সেখানে না যেতে, আর মহামারি ঘরের দুয়ারে এসে উপস্থিত হলে ঘর না ছাড়তে। ১৯৭১ সালের ক্যালেন্ডারের সঙ্গে এ বছরের ক্যালেন্ডারটার অদ্ভুত মিল। প্রতিটা দিন আর তারিখ হুবহু এক। ওই বছরও ঈদ এসেছিল। কিন্তু সেদিন আমাদের পূর্বসূরিরা ঈদ আনন্দে গা না ভাসিয়ে চালিয়ে গিয়েছিলেন প্রতিরোধ, সংগ্রাম। আর তাই আমরা তারপরের ৪৮টি বছর প্রাণখুলে স্বাধীন দেশে ঈদ উদযাপন করতে পেরেছি। আজ যদি আমরা ভুল করি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে বহুদিন হয়তো এমনি করেই ‘নিউ নরমাল’ ঈদ উদযাপন করে যেতে হবে।
অতএব, যদি খুব তাড়াতাড়ি ‘ওল্ড নরমাল’ ঈদ উদযাপনে ফিরে যেতে চান, আসুন সবাই মিলে সেই মহীয়সী নারীর কথা শুনি, যিনি আমাদের ছুটতে শিখিয়েছেন। আসুন সবাই এই ঈদে স্প্রিন্ট বাদ দিয়ে বরফ-পানি খেলায় মাতি।
লেখক : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও
সদস্যসচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ