আনোয়ার হোসেন শামীম : সারাদিন মনে খুব দুঃখ নিয়ে দেখছি, একটা ভিডিওকে কেন্দ্র করে ফেসবুকে ডাক্তার ও পুলিশদের বাকযুদ্ধ, যুক্তি-পাল্টাযুক্তির খেলা। এই দু’পেশার বাইরের লোকেরাও থেমে নেই। কেউ এপক্ষে কেউ ওপক্ষে গিয়ে নানা মত-প্রতিমত তাদেরও। কিন্তু একজনও বলছেন না যে, দুই-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে সামনে এনে মানুষের বিপদের মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনের, দেশের জন্য সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকারকারী দুটি পেশার লোকদেরকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়াটা ভীষণ অন্যায্য কাজ হচ্ছে।
জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে ডাক্তার ও পুলিশের সমন্বয় ও পরিপূরক সহযোগিতা যখন সবচেয়ে বেশি দরকার, তখন এই পারস্পরিক ছিদ্রান্নেষণ, দোষারোপ-পাল্টা দোষারোপের খেলা বন্ধ করা, এই মুহূর্তে বন্ধ করা ভীষণ জরুরি।
যা হোক, ঘটনা একটা ঘটেছে। মিডিয়ার কল্যাণে সেটার ভিডিওচিত্র আমরা সবাই দেখেছিও। সেখানে একজন ম্যাজিস্ট্রেট থাকলেও অনেকের উপস্থাপনায় এটি ইতোমধ্যে ডাক্তার-পুলিশ যুদ্ধে পরিণত। আচ্ছা, এক সাথে বসবাসকারী দুই ভাইয়ের মধ্যেও তো ঝগড়া মারামারি ঘটে! যদি এখানে কোনও পক্ষে কোনও অন্যায় হয়েও থাকে, প্রয়োজনে সঠিক তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিকে শাস্তির মুখোমুখি করা হোক। তিনি ডাক্তার হন বা পুলিশ, তাতে কিছুই এসে যায় না। কিন্তু এই করোনাময় দিনে দেশবাসীর সবচেয়ে আস্থার দুটি জায়গাকে বিতর্কিত করা, ডাক্তার এবং পুলিশ সদস্যদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পারস্পরিক কাঁদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ করা হোক।
ভিডিওতে ওই নারী ডাক্তারের প্রতি পুলিশ সদস্যদের আচরণ এবং বিপরীতক্রমে ডাক্তারের আচরণের সমালোচনায় জ্ঞানগর্ভ মন্তব্য করে আত্মপ্রসাদের ঢেকুর তোলার আগে দয়া করে জেনে নিন- এমনও হতে পারে, ওই নারী ডাক্তার হয়তো সারারাত করোনা ওয়ার্ডে নাইট ডিউটি করে ফিরছিলেন। নির্ঘুম রাত আর ক্ষেত্র বিশেষে রোগীর অ্যাটেন্ডেন্টদের অন্যায্য আচরণ/দাবি সহ্য করে আসা একজন মানুষের সামান্য রুক্ষ আচরণ নিয়ে সারারাত নাক ডেকে ঘুমানো এই আপনি কোন বিবেকে প্রশ্ন তোলেন! ভোর থেকে শুরু করে বিকেল পর্যন্ত ৩৬ ডিগ্রি তাপমাত্রার তপ্ত রোদে পুড়ে ডিউটি করা পুলিশ সদস্যের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে আয়নায় নিজের চেহারাটাও একবার দেখুন না, ব্রো। এমন পরিস্থিতিতে থাকলে আপনার আচরণ কেমন হতো!
জানি, অনেকেই থানায় বা পথঘাটে অতি প্রয়োজনের মুহূর্তে পুলিশি সেবা চেয়েও পাননি, মৃত্যুপথযাত্রী স্বজনের প্রতি কোনও ডাক্তারের অন্যায্য আচরণ অনেকের মনে কষ্টের ক্ষত সৃষ্টি করেছে ভীষণ, কিন্তু বলুন তো- আপনার আমার নিত্যদিনের সম্ভাব্য বিপদ, দুর্যোগ, দুঃসময়ে যাওয়ার মতো, সবসময় সব জায়গায় সাহায্য চাওয়ার মতো আর কোনও ডিপার্টমেন্ট কি আছে? বিপদের মুহূর্তে সাড়া দিলেও এরা, না দিলেও এই দুই পেশাজীবীই কিন্তু। সরকারি-বেসরকারি চাকুরিতে নিয়োজিত সকল পেশাজীবীই দেশ ও জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন, এটা ঠিক। তাদের সবার কাজের গুরুত্ব এবং মহত্ত্বের প্রতি পূর্ণ সম্মান জানিয়ে বলতে চাই, নিজের চরম বিপদের মুহূর্তে, বিপন্ন সময়ে আপনি আপনার পাশে কাকে খুঁজে পান? (কাজের ধরনের কারণে) রাস্তার মোড়ের ওই টহল পুলিশ কিংবা হাসপাতালের জরুরি ওয়ার্ডে ঘুমঘুম চোখে দায়িত্ব পালন করে চলা ডাক্তারই তো!
অনেক ডাক্তার বা পুলিশের আচরণ আপনার মনে তীব্র ক্ষোভ, অসন্তোষ সৃষ্টি করলেও এটাই সত্যি যে, রাতের আঁধার নামলে অন্য সকল পেশাজীবী যখন শান্তির ঘুম ঘুমোতে যান, তখন আপনার সম্ভাব্য বিপদের মুহূর্তে সাড়া দেওয়ার জন্য এই ডাক্তার আর পুলিশ সদস্যরাই রোস্টার খুলে রাতের শিফটের ডিউটির হিসেব মেলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কখন আপনার শ্বাসকষ্ট ওঠে, কিংবা আপনার স্ত্রীর ডেলিভারির ব্যথা। আপনার এলাকায় অদৃশ্য আততায়ী ঘুরছে, নাকি দাগী ডাকাতদল প্রস্তুত হচ্ছে জোরপূর্বক সর্বস্ব লুটে নেওয়ার। কিছু অপেশাদার পুলিশ সদস্যের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে অনেকে অনেক সময় বলে ফেলেন- ‘আমি কখনও কোনও পুলিশের হেল্প চাইব না কিংবা ‘পুলিশের সাহায্য আমার দরকার নেই’।
কিন্তু বাস্তবতা উনি নিজেও জানেন, এক রাত, শুধু একটি রাত পুলিশ ডিউটি করা বন্ধ করে দিলেই, যখন দেখা যাবে তাঁর সহায়-সম্পদ, স্ত্রী-কন্যার ইজ্জত, নিজের মানসম্মান সব লুণ্ঠিত হয়ে গেছে! তখন, কেবল তখনই বুঝা যাবে যে, আমরা সবাই আসলে নিজের অজ্ঞাতসারে প্রতিমুহূর্তেই পুলিশের সেবা নিয়ে চলেছি। তেমনি কশাই বলে গালি দিলেও গভীর রাতে বাবার বুকে ব্যথা শুরু হলে পরিচিত কোনও ডাক্তারের স্মরণ নেওয়ার চিন্তাই আগে মনে আসে সবার।
অন্য পেশার মানুষদের কর্মপরিবেশে সামান্য এদিক-ওদিক হলেই যেখানে হরতাল ধর্মঘট শুরু হবার শঙ্কা তৈরি হয়, সেখানে এই দুই পেশার লোকেদেরকে প্রতিমুহূর্তে অন্যায্য সব আচরণ সহ্য করে, কখনও উদ্যত লাঠির নিচেই দায়িত্ব পালন করে যেতে হয়। কখনও সহকর্মীর আহত শরীর এক পাশে সরিয়ে রেখে ব্রতী হতে হয় অর্পিত দায়িত্ব পালনে। তপ্ত রোদে দিনভর ডিউটির প্রশংসাপত্র না জুটলেও কিছু সদস্যের অপেশাদারিত্বের দায় নিয়ে তারাই জাতীয় ঘুষখোর।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনা রোগীদের চিকিৎসা ও রাত জেগে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ছোটাছুটির স্বীকৃতি পত্র না পেলেও অবসর সময়ে ঘাম ঝরানো প্রাইভেট প্র্যাকটিসে কামানো পয়সাকেও মহাদুর্নীতি আখ্যা দিতে কসুর করেন না কেউ। (এখানে বলে রাখি, আমি কোনও ঘুষ দুর্নীতিকে জাস্টিফাই করছি না। ছোট-বড় যেমনই হোক, সকল দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমার দৃঢ় অবস্থান ছিল, আছে এবং ইনশাআল্লাহ থাকবে সবসময়)।
বলতে থাকলে তালিকা ফুরোবে না। সবাই শুধু ডাক্তার এবং পুলিশদের রুক্ষ আচরণের কথাই বলেন, কিন্তু সারাদিন রোদে পুড়ে আর রাতের ঘুম বাদ দিয়ে, অনেকের অন্যায় আচরণ হজম করা হার্শ ওয়ার্কিং এনভায়রনমেন্ট যে তাদেরকে রুক্ষ করে রাখে- এই বাস্তবতা কেউ বুঝতে চান না। সবাই শুধু সিঙ্গাপুর, ভারত, থাইল্যান্ডের ডাক্তারদের সাথে আর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপানের পুলিশের সাথে তুলনা করে এদেশীয় ডাক্তার পুলিশের অদক্ষতা প্রমাণ করতে চান, কিন্তু নিজেরা সেসব দেশের মানুষের মতো আন্তরিক, সহযোগিতাপরায়ণ ও সৎ কিনা কিংবা সেসব দেশের মতো কর্মপরিবেশ, উন্নত প্রশিক্ষণ এদেশের ডাক্তার-পুলিশদেরকে কখনও দেওয়া হয়েছে কিনা, সেই প্রশ্নে যেতে আগ্রহী হন না।
সবশেষে বলবো, বিপদাপন্ন মানুষের কল্যাণে এই দুই পেশাজীবীর চেয়ে বেশি কাজে আসে, রাত জেগে আপনার বিপদের মুহূর্তে সাড়া দেওয়ার অপেক্ষায় থাকেন, এমন আর একটা পেশাও যদি খুঁজে না পান, জীবনে একবার হলেও কোন ডাক্তার বা পুলিশের আন্তরিক সেবা যদি পেয়ে থাকেন, তাহলে পক্ষে-বিপক্ষ নিতে গিয়ে মানবতার সেবামূলক এই দুই পেশা সম্পর্কে মানহানিকর কটু মন্তব্য করার বদলে আসুন আমরা সবাই একটি হ্যাশট্যাগ চালু করি- #Love_doctor_love_police.
এই হ্যাশট্যাগ-এর নিচে সংক্ষেপে লিখুন-
>>ডাক্তার কিংবা পুলিশের কাছ থেকে আপনি কখনও কোনও হেল্প পেয়ে থাকলে সেটা, কিংবা
>> দেশের দুর্দিনে এই দুই পেশাজীবীর অনন্য ভূমিকাকে স্বীকৃতি জানিয়ে আপনার কোনও মতামত থাকলে সেটা।
লেখক- ৩৪ তম বিসিএস (পুলিশ), সহকারী পুলিশ সুপার (রাঙ্গুনিয়া সার্কেল), চট্টগ্রাম।