মুক্তিযুদ্ধে যে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন কবরী
কিংবদন্তি অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরীর আসল নাম মিনা পাল। চট্টগ্রামের মেয়ে কবরী ১৯৬৩ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে নৃত্যশিল্পী হিসেবে মঞ্চে অভিষেক হয় তার। ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ ছবির মাধ্যমে অভিনয় জীবন শুরু করেন কবরী। তারপর একের পর এক সফল সিনেমা দিয়ে দর্শকদের মনে স্থায়ী আসন গেড়েছেন তিনি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সে বছরের ১৯ এপ্রিল পরিবারের সদস্যদের সাথে ঢাকা থেকে প্রথমে গ্রামের বড়ি এবং পরে সেখান থেকে ভারতে পাড়ি জমান তিনি।
অভিনয়ের বাইরে রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না কবরীর। তারপরও দেশের টানে ভারতে গিয়েও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন তিনি। একজন শিল্পী হিসেবে, বাংলাদেশি হিসেবে কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছিলেন, সে বিষয়ে গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে কবরী বলেছেন, ‘তখন তো আমি আওয়ামী লীগের কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলাম না। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে, সাধারণ মানুষ, একজন অভিনেত্রী এবং শিল্পী হিসেবে মানবতা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। বাবা, মা, ভাই-বোন, সম্পদ, লোভ-লালসা সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে আমি ভাষণ দিয়েছিলাম এবং জনসম্মুখে কাঁদছিলাম এ জন্য যে পাকিস্তানি বাহিনী যেভাবে হত্যা-নির্যাতন চালাচ্ছিল আমাদের দেশের মানুষের উপর তার হাত থেকে যেন আমার দেশের মানুষ অতি দ্রুত রক্ষা পায়। সে জন্য আমি মানুষের কাছে, বিশ্ববাসীর কাছে যে আহ্বান জানিয়েছিলাম তার পরিণতি যে কী হতে পারে তা একবারও আমার মনে আসেনি এবং ভাবার কোনো অবকাশও ছিল না।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, শিল্পী, সংগীত পরিচালক কলকাতায় পাড়ি জমান। তারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জমমত তৈরি, অর্থ ও পোশাক সংগ্রহ করতেন। সে সময় ভারতের ‘আকাশবাণী’তে কবরী বিশ্ববাসীর উদ্দেশে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। যা মাঝেমধ্যেই বাজানো হতো। এই ভাষণ রনাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধা, দেশের মানুষসহ বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে যায়।
সে সময়ের একটি স্মৃতি তুলে ধরে কবরী বলেন, ‘সেখানে একটি অনুষ্ঠানে আমি বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছিলাম। সেখানে আমি তুলে ধরি, কীভাবে আমি আমার মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ছেড়ে এক কাপড়ে একেবারে কপর্দকহীন অবস্থায় সেখানে পালিয়ে যাই। সেটা বলতে বলতে আমি বিশ্ববাসীর কাছে সাহায্যের আবেদন করি, আমার দেশের মানুষকে বাঁচানোর জন্য, আমার মা-বোনকে বাঁচানোর জন্য। তারপর আমি কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞানহারা হয়ে পড়ি। আর কিছুই জানি না।’
মুক্তিযুদ্ধে কাজ করতে পেরে গর্বিত মনে করতেই এই গুণী শিল্পী। এ বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘দেশের জন্য লড়াই করতে পেরেছিলাম বলে আমি গর্ববোধ করি৷ এ ছাড়া আমার দুই ছোট্ট শিশুও সে সময় আমার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী। এটাই আমার সবচেয়ে গর্ব ও সার্থকতার বিষয়।’