অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) : এখন তারা পরেছে নতুন খোলস। একাত্তরের ‘নিরপেক্ষভাবে বাংলাদেশ বিরোধিতাকারী’ শক্তির ঘাড়ে চেপে তারা এখন আবারো মাঠে। সমস্যা হচ্ছে, একাত্তরের ওদের আর ওদের আজকের ছানা-পোনাদের চেনাটা যত সহজ, এই নতুন সাম্প্রদায়িক শক্তির বেলায় তা ততটা সহজ নয়
হঠাৎ অশান্ত হয়ে উঠেছে দেশের রাজনীতি। সকালে হাসপাতালের উদ্দেশে ঘর ছাড়ার আগে একটু টিভির পর্দায় চোখ বোলালাম। অন্য সময় হলে হয়তো চলতি গাড়িতে ফেসবুকে চোখ বুলিয়েই জেনে নিতাম আপডেট। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পের দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ধীর এখন ফেসবুকের গতি। তাই দশটা মিনিট নষ্ট হলেও সর্বশেষের খোঁজে এই অনির্ধারিত টেলিদর্শন। দেখলাম একজন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎকার। তার মতে, মোদির সফরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের অর্জন যথেষ্ট হলেও অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নতুন মোড় নেয়ায় কিছুটা হলেও বিব্রত সরকার। একটু বোঝার চেষ্টা করলাম। ভদ্রলোকের বক্তব্যের প্রথম অংশের সঙ্গে একেবারেই একমত আমি। তবে দ্বিতীয় ভাগের সঙ্গে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আর রাজপথে গত কদিনে যা ঘটছে, তা কখনোই নতুন কোনো ফেনমেনোন না। এটি পুরোনো কাসুন্দির নতুন মোড়কে মাঠে আসা মাত্র।
আমরা যারা নব্বইয়ের দশকে রাজপথে ছিলাম, তাদের কাছে তো বটেই, এমনকি হালের প্রজন্মের কাছেও এটি রাজনীতির কোনো নতুন মোড় নয়। এ দেশে জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং তারপর জেনারেল এরশাদের হাত ধরে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে রাজনীতিতে আবারো একাত্তরবিরোধী, সাম্প্রদায়িক শক্তির অনুপ্রবেশ ও উত্থান। শুরুর দিকে এরা বিএনপি বা জাতীয় পার্টির ভেতরে থেকে মুখোশের আড়ালে সক্রিয় ছিল। শাহ আজিজুর রহমান, মুস্তাফিজুর রহমান, মওলানা মান্নান, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আব্দুল আলিম প্রমুখ মানবতাবিরোধী অপরাধী এই দুই জেনারেলের মন্ত্রিসভার শোভাবর্ধন করেছিল। আর খালেদা-তারেক জমানায় এসে রাখঢাকের কোনো বালাই আর ছিল না। তখন জামায়াতের নিজামী-মুজাহিদরাই এ দেশের মন্ত্রী এবং সেটা জামায়াত পরিচয়েই। ২০০৯ সালে ভোটবিপ্লবের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ‘ঘুরে দাঁড়ানো বাংলাদেশের’ নতুন করে চলার শুরু। জামায়াতের সঙ্গে চূড়ান্ত বোঝাপড়াটা এরই মধ্যে সুসম্পন্ন হয়েছে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীরা যত ক্ষমতাশালীই হোক না কেন, ফাঁসিতে ঝুলছে একের পর এক। মানুষ পঁচাত্তর-পরবর্তী মিথ্যার বিভ্রান্তি কাটিয়ে আবারো সত্যিটা চিনতে শিখেছে। ফলে সঙগত কারণেই জামায়াত এখন ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে। বাকি শুধু একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের জন্য সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার।
এখন তারা পরেছে নতুন খোলস। একাত্তরের ‘নিরপেক্ষভাবে বাংলাদেশ বিরোধিতাকারী’ শক্তির ঘাড়ে চেপে তারা এখন আবারো মাঠে। সমস্যা হচ্ছে, একাত্তরের ওদের আর ওদের আজকের ছানা-পোনাদের চেনাটা যত সহজ, এই নতুন সাম্প্রদায়িক শক্তির বেলায় তা ততটা সহজ নয়। হেফাজতের কুকর্মের যত দায় মোটা দাগে তার সবটুকু সব মাদ্রাসার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়াটা হবে ঘোরতর অন্যায়। দেশে যে বহু লাখ মাদ্রাসা ছাত্র আছে, তাদের খুব সামান্য অংশই পাকিস্তানের আইএসআই আর এ দেশে জামায়াত-বিএনপির আর্থিক সমর্থন আর অনৈতিক ইন্ধনে হামলে পড়ছে সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা আর সম্পতির ওপর। কাজেই একদিকে যেমন মাদ্রাসার নিরীহ অংশটিকে মূলধারায় সম্পৃক্ত করাটা জরুরি, তেমনি পাশাপাশি সাপের মাথাটা পিষে দেয়াটাও কম জরুরি কিছু না। ২০১৩ আর ২০১৫-এর আগুন-সন্ত্রাস আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়, যে শিক্ষাটি একাত্তরে এত লাখ তাজা প্রাণের বিনিময়ে আরো একবার পেয়েও আমরা বেমালুম ভুলে বসেছিলাম। সমস্যা হচ্ছে, প্রথম কাজটি সম্পাদনে আমরা যতটা উদ্যোগী, সর্প বিনাশে আমাদের কেন যেন ঠিক ততটাই দ্বিধা।
২০১৩ আর ২০১৫-এর আগুন-সন্ত্রাসের পর বাংলাদেশ ও ভারত তাদের দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে পরস্পর একসঙ্গে কাজ করেছে। যেহেতু বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিশাল ল্যান্ড বর্ডার রয়েছে, তাই দুই দেশের ইন্টারনাল সিকিউরিটির স্বার্থেই হেফাজতের সাম্প্রতিক এই তাণ্ডবের পর তারা একসঙ্গে আরো দৃঢ়ভাবে কাজ করবে। ভারতের শাসক দলের কারো কারো যদি বাংলাদেশে তাদের সত্যিকারের মিত্র সম্পর্কে ন্যূনতম কোনো সন্দেহও থেকে থাকে, এরপর তা যেমন আর থাকা উচিত না, তেমনি চিড়িয়াখানায় খাঁচাবন্দী কেউটে দেখে এ দেশের শাসক দলের কেউ যদি দুধ-কলা দিয়ে সাপকে বশে আনার দিবাস্বপ্ন দেখে থাকেন, তবে তাদের সেই স্বপ্নভঙ্গও আশা করি হয়ে গেছে।
অনেকে সাম্প্রদায়িক শক্তির সাম্প্রতিক উদ্ধত আচরণে শঙ্কিত। ভাবছেন, পাছে পথ না হারায় বাংলাদেশ। আমি মোটেও তেমনটা ভাবি না। একটা সময় ছিল যখন ময়ময়সিংহ মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে জয় বাংলা স্লোগান ধরা মানেই ছিল ধাওয়া খেয়ে ক্যাম্পাস থেকে দৌড়ে বের হওয়া। গোপালগঞ্জ থেকে টুঙ্গিপাড়া পর্যন্ত কাঁচা রাস্তাটিকে হেরিংবোনে উন্নীত করার অপরাধে আমি চাকরি যেতে দেখেছি ময়ময়সিংহ মেডিকেল কলেজে আমার রুমমেট ডা. ইমনের (আজকে ঢাকা সিএমএইচে কর্মরত লেফটেন্যান্ট কর্নেল ডা. ফয়জুল হক) বাবা প্রয়াত অতিরিক্ত সচিব ফজলুল হক মিয়া চাচাকে, আর সঙ্গে ওএসডি হতে হয়েছিল আমার প্রয়াত পিতা সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তৎকালীন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মাহতাব উদ্দীন আহমেদকে। ‘তুই রাজাকার’ শিরোনামে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ছড়া সংকলন প্রকাশের অপরাধে আমাদের একুশের বইমেলায় নিষিদ্ধ হতে হয়েছিল। এসব কিছুই আমার নব্বই-পরবর্তী তথাকথিত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। আর এর চেয়ে ঢের বেশি কঠিন অভিজ্ঞতা ঝুলিতে জমা আছে আমার মতো আরো অনেকেরই। সেদিন আমরা স্লোগান দিতাম ‘সাকা-মুজাহিদ ভাই ভাই, এক দড়িতে ফাঁসি চাই’। স্লোগান দিতাম ঠিকই, কিন্তু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে পারিনি! সেই বাংলাদেশও পথ হারায়নি, পথ হারাতে দেননি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। আর আজ যখন সজীব ওয়াজেদ জয়কে দেখি ‘নব্য রাজাকারদের’ ঠিক ঠিক চিনে নিতে, তখন আবারো বিশ্বাসী হই ‘পথ হারাবে না বাংলাদেশ’!
লেখক: চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্যসচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ