মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং সমুদ্র সম্পদ রক্ষায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে সদা প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, তাঁর সরকার সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনাকে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে চায়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সমুদ্রসীমা অর্জন কেবল নয় এই সমুদ্র সম্পদটা যেন দেশের উন্নয়নে ব্যয় হয় সে জন্য আমাদের কাজ করতে হবে এবং সে জন্যই আমরা সুনীল অর্থনীতি পদক্ষেপ বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিয়েছি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশাল এই সমুদ্রের সম্পদ আহরণ এবং তাকে কাজে লাগানোই আমাদের লক্ষ্য এবং সেই লক্ষ্য নিয়েই তাঁর সরকার কাজ করে যাচ্ছে। আর জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমাদের সমুদ্রসীমাকে রক্ষার জন্য নৌবাহিনীকেও শক্তিশালী করে আমরা গড়ে তুলছি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ নৌবাহিনীর নতুন পাঁচটি আধুনিক যুদ্ধ জাহাজ কমিশনিং করেছেন।
এ সময় তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ নৌবাহিনী তার ক্রমাগত অগ্রযাত্রায় আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল। দিনটি শুধু বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য নয়, সমগ্র দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত গৌরবের।’
এই কমিশনিং-এর ফলে বাংলাদেশের জলসীমা সুরক্ষায় এবং নৌবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি করে অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু করলো নতুন দু’টি আধুনিক ফ্রিগেট বানৌজা ওমর ফারুক, আবু উবাইদাহ ও একটি করভেট যুদ্ধজাহাজ প্রত্যাশা এবং দুইটি জরিপ জাহাজ বানৌজা দর্শক ও তল্লাশী।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুপুরে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সর মাধ্যমে জাহাজগুলোকে নৌবাহিনীতে কমিশনিং করেন।
এর আগে চট্টগ্রামে বানৌজা ঈশাখান নৌ জেটিতে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম শাহীন ইকবাল জাহাজসমূহের অধিনায়কগণের হাতে কমিশনিং ফরমান তুলে দেন।পরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নৌবাহিনীর রীতি অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে নামফলক উন্মোচন করেন।
অনুষ্ঠানে নৌবাহিনীর একটি সুসজ্জিত চৌকষ দল প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অব অনার ও প্রদান করেন।
গণভবন প্রান্তে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব:) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসসহ পিএমও এবং গণভবনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের নৌবাহিনীর সদস্যরা প্রতিনিয়ত লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে অনেক প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে সমুদ্র এলাকার সার্বিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করছে, যা প্রশংসার দাবিদার।
দেশের পরাষ্ট্রনীতি’র আলোকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা কারো সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাই না। জাতির পিতা আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে বলেছেন- ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে বৈরীতা নয়’, আমরা সেই নীতিতেই বিশ^াস করি। কিন্তু যদি বাংলাদেশ কখনো বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাকে মোকাবেলা করার মত সক্ষমতা আমরা অর্জন করতে চাই।
সরকার প্রধান বলেন, আমাদের সুশৃৃঙ্খল সশস্ত্রবাহিনী দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আজ আন্তর্জাতিক পরিম-লেও বিপুলভাবে প্রশংসিত পেশাদার একটি বাহিনী।
তিনি বলেন, গত ২০১০ সাল থেকে ভূ-মধ্যসাগরে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের অংশ হিসেবে আমাদের যুদ্ধজাহাজ সার্বক্ষণিকভাবে অংশগ্রহণ করছে। এই বছরের আগস্ট মাসে আমরা সেখানে পাঠিয়েছি আমাদের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির একটি করভেট বানৌজা ‘সংগ্রাম’, যা বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করেছে।
এ ছাড়া দক্ষিণ সুদানেও বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কন্টিনজেন্ট অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করে আসছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শান্তিরক্ষা মিশন ছাড়াও এ বাহিনী নিয়মিতভাবে বহুজাতীয় এক্সারসাইজ, বঙ্গোপসাগরে ‘কোর্ডিনেটেড প্যাট্রল’ ও কূটনৈতিক সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশের ‘মেরিটইম সিকিউরিটি’-কে সুসংহত করে চলেছে।
তিনি বলেন, মালদ্বীপে যখন সুপেয় পানির অভাব হয়েছিল তখন আমরা আমাদের নৌবাহিনীর জাহাজ দিয়ে সুপেয় পানি সেখানে পাঠাই এবং তাঁদের সহযোগিতা করি। এভাবেই দেশে এবং প্রতিবেশী দেশেও বাংলাদেশ নৌবাহিনী নানারকম সহযোগিতা প্রদান করে যাওয়ায় তিনি এই বাহিনীকে ‘কর্মমুখর’ আখ্যায়িত করে তাঁদের ধন্যবাদ জানান।
‘ভূ-রাজনৈতিক প্রয়োজনে একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠন করা হবে’- বঙ্গবন্ধুর ভাষণের এই উদ্ধৃতি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁরই পদাংক অনুসরণ করে নৌবাহিনীকে আধুনিক দক্ষ ও শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ তাঁর সরকার নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার কেবল নৌবাহিনী নয়, বঙ্গবন্ধুর ১৯৭৪ সালে করে যাওয়া ‘প্রতিরক্ষা নীতিমালা’র আলোকে ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন শুরু করেছে এবং সেইদিক থেকেই তাঁর সরকার নৌবাহিনীকে আধুনিক ও শক্তিশালী একটি বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার পদক্ষেপ নিয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের সরকার নৌবাহিনীতে বর্তমান প্রজন্মের উন্নত সাবমেরিন, যুদ্ধ জাহাজ, মেরিটাইম পেট্রোল এয়ারক্র্যাফট, হেলিকপ্টার ও বিশেষায়িত বাহিনী সংযোজন করেছে এবং এর মাধ্যমে ‘একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ’ মোকাবিলায় আমরা একটি ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনী গঠনের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি।’
আজকে কমিশন প্রাপ্ত জাহাজগুলো নৌবাহিনীকে আরো শক্তিশালী,দক্ষ এবং বেগবান করবে বলেই বিশ^াস করি,বলেন তিনি।
তিনি বলেন, আধুনিক সমরাস্ত্র সজ্জ্বিত দুইটি ফ্রিগেট ও একটি অত্যাধুনিক করভেট এবং আমাদের নিজস্ব খুলনা শিপইয়ার্ডে তৈরী দুটি আধুনিক জরিপ জাহাজ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নৌবাহিনীর ক্ষমতাকে আরও জোরদার করবে এটাই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। এ ছাড়াও নিজস্ব ইয়ার্ডে জাহাজ তৈরীর সক্ষমতা আমাদের আত্মবিশ্বাসকে বলিয়ান করেছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা ভবিষ্যতে অন্য দেশের জন্য জাহাজ তৈরী করে সরবরাহ করতে সক্ষম হব, ধীরে ধীরে সেই সক্ষমতাও আমরা অর্জন করবো।’ খুলনা শিপইয়ার্ড এবং ড্রাইডক বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হাতে তাঁর ’৯৬ পরবর্তী সরকার তুলে দিয়েছিল বলেই আজ দেশে যুদ্ধ জাহাজ নির্মান সম্ভব হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমেই আমাদের নৌবাহিনীর যাত্রা শুরু। নৌবাহিনীর সাহসী সদস্যদের মাধ্যমে পরিচালিত ‘অপারেশন জ্যাকপট’ আমাদের নৌযুদ্ধের ইতিহাসের এক অনন্য বীরত্বগাঁথা।
তিনি বলেন, দেশ স্বাধীনের পর যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশ পুণর্গঠনকালেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার লক্ষ্য নিয়ে সশস্ত্রবাহিনী গড়ে তুলে এর আধুনিকায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এরআগে জাতির পিতা পাকিস্তান আমলে তাঁর ৬ দফা প্রস্তাবেও বাংলাদেশেই নৌবাহিনী ঘাঁটি করার উল্লেখ করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর আন্তরিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারি বন্ধুপ্রতীম দেশ ভারত থেকে সংগৃহীত ২টি পেট্রোল ক্রাফট ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’ নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যাত্রা শুরু হয়। তিনি বলেন,সমুদ্র সীমায় বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ১৯৭৪ সালেই জাতির পিতা সমুদ্রসীমা আইন প্রণয়ন করেন, যদিও জাতিসংঘই তা অনেকে পরে করেছে।
জাতির পিতাকে হত্যার পর যারা ক্ষমতায় এসেছিল তারা এসব ব্যাপারে কোন চিন্তা বা উদ্যোগ কিছুই গ্রহণ করেনি উল্লেখ করে বলেন, ‘এরই মাঝে ২১ টি বছর পার হয়ে যায়। আর ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে এসেই এ ব্যাপারে প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করে।’
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ নৌবাহিনী শান্তিকালীন বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশবাসীর আস্থা ও প্রশংসা অর্জন করেছে।
কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সরকারের গৃহিত কার্যক্রম বাস্তবায়নেও নৌবাহিনী যথাযথ ভূমিকা রেখেছে, তাছাড়া যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগেও নৌবাহিনী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং যথাযথভাবে তাঁদের সাহায্য করেছে। প্রধানমন্ত্রী এজন্য নৌবাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
করোনাভাইরাসের মধ্যেও দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে তাঁর সরকার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ভবিষ্যতে এই করোনাভাইরাস থেকে বাংলাদেশ ও বিশ^ মুক্তি পাবে এবং বাংলাদেশ আরো এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে কেননা জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টাই আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। তাঁর সরকারের উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ায় ২০৪১ সাল পর্যন্ত প্রেক্ষিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ এবং ২১০০ সাল পর্যন্ত শতবর্ষব্যাপী ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নের পদক্ষেপের উল্লেখ করে ভবিষ্যতে উন্নয়নের গতিধারাটা যেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রাখতে পারে সেই চিন্তাধারা থেকেই সরকার এসব কাজ করে যাচ্ছে,বলেন তিনি। তিনি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের দ্বিতীয় দফা আগ্রাসন থেকে দেশবাসীর মুক্তির জন্য সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার এবং মাস্ক পরে ঘরের বের হওয়ার আহ্বান ও পুনর্ব্যক্ত করেন।