জিয়াউর রহমানকে অনেকে অনেকভাবে উপস্থাপন করেন। নিরপেক্ষভাবে যদি জিয়াউর রহমানকে উপস্থাপন করা হয় তাহলে আমরা সুবিধাবাদী, তোষামোদকারী, হিংস্র এবং সেনা আইন ও দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করা এক জিয়াকে খুঁজে পাই। বঙ্গবন্ধুর তোষামোদী করে, বঙ্গবন্ধুকে বুলেটবিদ্ধ করার আগে তার গায়ে বুলেট লাগবে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে, এমন কি বাকশালে যোগ দিয়ে বাকশালের সকল গভর্ণরকে শুভেচ্ছাবাণী পাঠিয়ে ১৫ই আগস্ট যে বিশ্বাসঘাতকতা জিয়া করেন তা কোনো কল্পকাহিনীকেও হার মানায়।
জিয়া তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার বাস্তুবায়ন ঘটাতেই বিপরীত আদর্শ, নিষিদ্ধ দল, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ পোষণ করে এমন সব মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। এই সূত্রেই যোগাযোগ হয় ঘাতক ফারুক রশীদের সাথেও।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বেনিফেসিয়ারি হিসেবে জিয়া প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পান। এরপর নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সায়েমের কাছ থেকে বলপূর্বক প্রথমে মুখ্য সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ছিনিয়ে নেন, তারপর প্রেসিডেন্টের পদটিও। পৃথিবীতে জিয়াউর রহমানই একমাত্র ব্যক্তি,যিনি একই সময়ে রাষ্ট্রপতি, সামরিক আইন প্রশাসক, সেনাপ্রধান এবং মুখ্য সামরিক আইন প্রশাসক —- এই চার পদ দখলে রাখেন।
মেজর থেকে রাষ্ট্রপতি হওয়া পর্যন্ত জিয়ার জীবনকাল ষড়যন্ত্র, নৃশংসতা, বর্বরতা ও আইনের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাশীল না হওয়ার এক নিষ্ঠুর ইতিহাস। জিয়ার সাফাই দিয়ে অনেকে এক লৌহমানব জিয়ার প্রতিকৃতি আঁকতে চেয়েছেন। কিন্তু একজন সুনাগরিক ও সুবিবেচক হিসেবে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন নি কখনোই।
১. ৭১ সনের মেজর জিয়াউর রহমান ৭২ সনের ফেব্রুয়ারিতেই কর্নেল পদ লাভ করেন। এরপর ৭৩ সালের মাঝামাঝিতে ব্রিগেডিয়ার,এই সনেই অক্টোবর মাসে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। ৭২ সনেই তাকে করা হয়েছিল সেনাবাহিনীর উপাধ্যক্ষ। সকল সুবিধা ভোগ করেও তিনি রাষ্ট্র বিরোধিতায় শামিল ছিলেন। সেনা আইনের ৩১ ধারা অনুসারে বিদ্রোহে যুক্ত থাকলে বা বিদ্রোহ সম্পর্কে জেনেও নীরব থাকার শাস্তি কোর্ট মার্শালে মৃত্যুদণ্ড। জিয়া রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত থেকে, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বেতন ভাতা ও সুবিধা গ্রহণ করে, রাষ্ট্রের অনুগত থাকার অঙ্গিকার করা সত্ত্বেও সে দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছেন, বিদ্রোহীদের উৎসাহিত করেছেন। তার এ কর্ম না ন্যায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য না ধর্মের কাছে।
২. মোশতাক সরকারের কোনো বৈধতা ছিল না। অবৈধভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করা সরকারের মাধ্যমে জিয়া সেনা প্রধান হন।
৩. জিয়াউর রহমান একমাত্র ব্যক্তি যে শপথগ্রহণ না করে রাষ্ট্রপতি হয়েছে। সেনাপ্রধান কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন না, তিনি কোনো লাভজনক পদেও অধিষ্ঠিত হতে পারেন না। অথচ জিয়া একই সঙ্গে রাষ্ট্রপ্রধান ও সামরিক বাহিনীর প্রধান হয়েছিলেন।
৪. অবৈধভাবে সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় জিয়া রাজনৈতিক দল গঠন করে যা সম্পূর্ণরূপে অবৈধ ও আইনের শাসনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শণ।
৫. খুনিদের রক্ষার জন্য আইন করার দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে নেই। বলা হয় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের রক্ষায় প্রণীত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জিয়ার ঘোষণা করেন নি। প্রকৃতপক্ষে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে সংসদে বৈধতা দিয়ে ইনডেমনিটি এক্টে রূপান্তর করে জিয়া। এর ফলে বাংলাদেশের সংসদকে কলঙ্কিত করা হয়।
৬. জিয়ার সততার গান গাওয়া সুবিধাবাদীরা কখনো প্রশ্ন তুলেছেন, একটি দল গঠন করতে যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয় তা কোথা থেকে এসেছিল? জিয়া অনৈতিক সুবিধাদানের মাধ্যমে নেতাবাচক ভাবমূর্তির ব্যক্তিদের ক্ষমতার অংশীদার করেছিলেন।
সব দেশের সব মানুষের মধ্যে লোভ, লালসা, প্রতিহিংসা আছে। কিন্তু একমাত্র সভ্যতা বিরোধী অমানবিক পৈশাচিক উল্লাস মুহূর্তেই ধরা পড়ে। ১৫ আগস্ট থেকে মধ্য নভেম্বর পর্যন্ত এবং ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখতে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত সৈন্যদের রক্ত পায়ে পায়ে রক্তাক্ত প্রান্তরে পরিণত হয়েছিল। থকথকে রক্ত মাড়িয়ে যারা শুধু ক্ষমতা কুক্ষিগত করার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়, তাদের দ্বারা আর যাই হোক মানবতার কল্যাণ হওয়ার কথা নয়।