যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক) আব্দুর রাজ্জাক আমাদের বিশেষ প্রতিনিধিকে বলেন,আইজিপি মহোদয়ের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশে গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ রয়েছে ও থাকবে এবং এবিষয়ে ভবিষ্যতে আমরা আরো কঠোর হবো। পরিচালন ব্যয় বা সার্ভিস চার্জ আদায়ের প্রস্তাব কিছু মালিক ও শ্রমিক নেতাদের কাছ থেকে আসছে বলে উনি শুনেছেন।
তিনি বলেন,বর্তমানে এক মাসে মাত্র ১০ হাজারের মত মামলা হয়। কিন্তু আগে প্রতিমাসে এক লাখের বেশি মামলা হতো। তিনি অন্য এক প্রশ্নের জবাবে বলেন এতদিন পরিচলন ব্যয়ের জন্য গণপরিবহন থেকে যে চাঁদা তোলা হতো এখন তা হচ্ছে না। এতে সাধারণ মালিকরা উপকৃত হওয়ার কথা। অন্য দিকে মালিকদের অভিযোগ–কতিপয় অসাধু ট্রাফিক পুলিশের কারণে রাজধানীর গণপরিবহনে হয়রানি বেড়েছে। পুলিশের কিছু দুর্নীতিবাজ সদস্যরা কথায় কথায় মামলা দিচ্ছে ও হয়রানি করছে। নতুন আইনে মামলায় জরিমানার পরিমান অনেক বেশি। সেই জরিমানার টাকা দিতে গিয়ে মাস শেষে আর কিছুই থাকছে না। উক্ত পুলিশের দুর্নীতিবাজ সদস্যরা মামলা দেই দিচ্ছি করে করে ভয় দেখিয়ে বাঁ-হাতের কাজটি সেরে নেন। এদিকে পরিবহন সেক্টরের বন্ধ থাকা চাঁদাবাজির নাম বদলে পরিচালন ব্যয় বা সার্ভিস চার্জ আদায়ের প্রস্তাব দিয়েছেন শ্রমিক নেতারা। এ প্রস্তাব এরই মধ্যে সিদ্ধান্ত হিসেবে অনুমোদন করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি। সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান। মালিক সমিতির নেতারা অবশ্য এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নেতা বলেন, আইজিপি মহোদয়েরর নির্দেশে আমরা সব ধরণের চাঁদা তোলা বন্ধ রেখেছি। সুতরাং এ বিষয়ে আমাদের আর কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। শ্রমিক সংগঠনগুলো তাদের স্বার্থে কিছু করলে সেটা তাদের দায়িত্ব। তাদের দায়িত্ব আমাদের উপর বর্তায় না।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান, চাঁদা বন্ধ হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই পুলিশের কিছু দুর্নীতিবাজ সদস্য গণপরিবহনের উপর ক্ষুদ্ধ। উক্ত দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্যরা পরোক্ষভাবে মালিকদের উপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আবদুল্লাহপুর-বাবুবাজার রুটে চলাচলকারি এক পরিবহন কোম্পানীর পরিচালক বলেন, সারা ঢাকা শহরে ক’জন মানুষ মাস্ক পড়ে এখন? অথচ বাসের হেলপার, ড্রাইভারের মুখে মাস্ক নেই বলে প্রতিদিনই মামলা দেয়া হচ্ছে। মাস শেষে মামলার জরিমানা গুনতে হচ্ছে ২০-২৫ হাজার টাকা। গাড়ির খচর দিয়ে কিছুই বাকি থাকছে না। আমরা পথে বসতে চলেছি। এ প্রসঙ্গে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ গণমাধ্যমের কাছে বলেন, ঢাকা শহরে যে সব মালিকের বাস চলে তারা প্রতিদিনই আমাদের কাছে নানা অভিযোগ করছে। ট্রাফিক পুলিশ দিনে একটা গাড়ি বার বার আটকাচ্ছে, মামলা দিচ্ছে। নতুন আইনে মামলা দেয়ার কারণে জরিমানার অঙ্ক অনেক বেশি। সেই টাকা দিয়ে মালিকদের কিছুই থাকছে না।
যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক) আব্দুর রাজ্জাক আমাদের বিশেষ প্রতিনিধিকে পুনরায় ভিন্ন এক প্রশ্নের জবাবে বলেন,নতুন আইনে মাত্র কয়েকটি বিষয়ে মামলা করা হ্ছ। এছাড়াও জরিমানা ২৫ হাজার টাকা রয়েছে; কিন্তু তা কমিয়ে মাত্র ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হচ্ছে। যুগ্ম-কমিশনার সাহেব প্রশ্ন রেখে বলেন, তা হলে অতিরিক্ত মামলা দিয়ে হয়রানি করা হলো কিভাবে? তারপরও যদি কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসে; তা হলে তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দৈনিক নিখাদ খবরের বিশেষ প্রতিনিধি গাবতলী, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, মহাখালী বাস টার্মিনাল ঘুরে এবং বিভিন্ন রুটে চলাচলকারি সিটি সার্ভিসের বাসের মালিক শ্রমিকদের সাথে কথা বলে নিখাদ খবর ডেক্সকে জানান, রাজধানীতে কতিপয় ট্রাফিক পুলিশের রোষানলে পড়ছে সব রুটেরই বাস। সকালে রাস্তায় বের হলেও ট্রাফিক পুলিশ বাস আটকিয়ে অযথা পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করার মতো করে ও খামখেয়ালিপনায় বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে মামলা দিচ্ছে। গাজীপুর থেকে যাত্রাবাড়ী রুটে চলাচলকারি বলাকা পরিবহনের এক চালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একদিনেই ৬টা মামলা খেয়েছি। তার মানে নিজের সারাদিনেও উপার্জন শেষ। উপরন্তু মালিকের বকাঝকা তো আছেই। কি কারণে মামলা দিচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দোষ খুঁজলে অনেক কিছুই পাওয়া যাবে। তুই দেখতে খারাপ বা তোর চোখ কানা ইত্যাদি ইত্যাদি অবস্থা আর কি !! গুলিস্তান থেকে এয়ারপোর্ট রোড রুটের এক কন্ডাক্টর এই প্রতিবেদককে বলেন, আসল কথা হলো আগে মালিকরা সবাই মিলে একটা বরাদ্দ রাখতো। এখন সেটা রাখছে না। এসব কারণেই কতিপয় অসাধু পুলিশ সদস্যরা এতো ঝামেলা করছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আইজিপি মহোদয়ের কঠোর নির্দেশনার কারণেই এখন বিধিবাম- নির্দেশনার আগে ঢাকায় চলাচলরকত বাসগুলোর রুটভিত্তিক বিট ভাগ করা ছিল। বিট অনুসারে চাঁদার টাকা থেকে রাখা হতো বরাদ্দ। এ কারণে কোনো ঝামেলা ছিল না। বড় কোনো ঘটনা ছাড়া ট্রাফিক পুলিশ কোনা বাসই আটকাতো না। এখন যখন তখন এবং মোড়ে মোড়ে বাস থামানো হয়। এইসব কারণে যাত্রীরাও মহাবিরক্ত। মিরপুর থেকে মতিঝিলে বাসে চড়ে অফিস করেন এমন একজন ব্যাংকার আমাদেরকে জানান, সকালে বাসগুলোতে বেশ চাপ থাকে। যাত্রীর তুলনায় বাস থাকে কম।তার উপর একটা বাসকে যদি মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ দাঁড় করিয়ে কাগজপত্র চেকের নামে সময়ক্ষেপণ করে তখন এক ঘণ্টার রাস্তা দু’ঘণ্টায়ও শেষ হয় না। করোনার পরিস্থিতির উন্নতির সাথে সাথে এই প্রবণতা অনেকটাই বেড়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
গাজীপুর-মতিঝিল রুটের এক পরিবহন কোম্পানীর মালিক নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, চাঁদা বন্ধ থাকার কারণে আমরা সুপাইভাইজারকে খাটাতে পারছি না। এতে করে সঠিক হিসাব ও আমরা পাচ্ছিনা। তাছাড়া ঢাকার কোনো কোনো এলাকায় প্রভাবশালীদের ঠিকই চাঁদা দিতে হচ্ছে। তার উপর পুলিশ যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানায় মামলা দেয় তাহলে আমরা কোথায় যাব। উক্ত পরিবহন মালিক আরো বলেন, আগে চাঁদা আমরা মালিকরাই দিতাম। চাঁদা বন্ধ থাকাতেই আমাদের টাকা বাড়ার কথা- কিন্তু উল্টো আমাদের ইনকাম কমেছে। মামলা আর জরিমানা দিতে দিতে আমরা পথে বসতে চলেছি। মাঝখানে ৫ মাস করোনায় গাড়ি না চলায় অনেক গাড়িই বসে পড়েছে। এখন যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে আমাদের এই ব্যবসা ছেড়ে দিতে হবে। যাওয়ারও অন্য কোন উপায় নাই। কারণে আমাদের অধিকাংশ গাড়িই ঋণের টাকায় কেনা। তাহলে সশ্যের মধ্যেই কি ভুত?? তাহলে কতিপয় অসাধু পুলিশ ও পরিবহনের মালিক ও শ্রমিকরাই এইভাবে সিণ্ডিকেটের মাধ্যমে সোনার বাংলা তৈরির অন্তরায়?? দেশবাসীর কাছে দৈনিক নিখাদ খবর পরিবারের প্রশ্ন?!?!অপরদিকে সায়েদাবাদের এক মালিক বলেন, গত এক মাসে উনার ১২টি গাড়ি জব্দ করেছে ঋণদান অথরিটি, কিস্তির টাকা জমা না দেয়ায় কারনে যদিও উক্ত পরিবহন মালিক উনার এই বক্তব্যের বিপরীতে কোন প্রমাণ দেখাতে পারেন নাই।
আরেকটি পরিবহন মালিক ও শ্রমিক চক্র পাঁয়তারা করছে যে, বন্ধ হওয়া চাঁদাবাজি চালু করতে নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছে। পুলিশের কাঁধে বন্দুক রেখে বা মাথায় কাঁঠাল ভেঙে পুনরায় চাঁদাবাজি শুরু করার জন্য অণ্ডার ওয়ার্ল্ড গডফাদারা ও ঐ দুষ্ট চক্রের সাথে জড়িত বলে আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি এরূপ প্রতিবেদন জমা দেন। উল্লেখ্য যে, পরিবহন শ্রমিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন কৌশলে তারা চাঁদাবাজি নাম বাদ দিয়ে এটাকে পরিচালন ব্যয় বা সার্ভিস চার্জ আদায়ের প্রস্তাব করেছে। ভুক্তভোগি কিছু মালিকদের মতে, পরিচালন ব্যয় বা সার্ভিস চার্জ অনুমোদন হলে পরিবহন সেক্টরে অরাজকতা আগের তুলনায় অনেক বেশি হবে ।
সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। দেশে শুধু ফেডারেশনের আওতায় রয়েছে ২৪৯টি শ্রমিক ইউনিয়ন। ঢাকায় বাস ও ট্রাক টার্মিনালকেন্দ্রিক শ্রমিক ইউনিয়ন ছাড়াও প্রতি জেলায় অন্তত দুটি করে বাস ও ট্রাকের শ্রমিক ইউনিয়ন আছে। অন্যদিকে শ্রম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তথ্য মতে, সড়ক পরিবহন সেক্টরে মালিক ও শ্রমিকদের সংগঠনের সংখ্যা ৯৩২। এসব সংগঠনের আয়ের প্রধান উৎস যানবাহন থেকে দৈনিক যে চাঁদা তোলা হয় সেই টাকা।। অধিকাংশ পরিবহন যাত্রী ও পরিবহনের চাঁদাবাজদের কাছে জিম্মি ভুক্তভোগিরা বলেন, আইজিপি মহোদয়ের চাঁদাবাজি বন্ধের যে নির্দেশ দিয়েছেন এটা একটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত উনি নিয়েছেন। আইজিপির কাছে আমাদের বিনীত নিবেদন উনি যেন উনার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। তাহলে দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্ম-মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে উনি চিরস্বরণীয় হয়ে থাকবেন।