প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুক্রবার নারায়ণগঞ্জে মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণের কারণ উদঘাটনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন। ওই বিস্ফোরণে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়েছেন।
আজ সংসদে সদ্য প্রয়াত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী এবং একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য এডভোকেট সাহারা খাতুন ও ইসরাফিল আলমসহ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মৃত্যুতে জাতীয় সংসদে শোক প্রস্তাবের উপর আলোচনায় অংশগ্রহণকালে সংসদ নেতা একথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি নারায়ণগঞ্জের মসজিদে ওই বিস্ফোরণের কারণ উদঘাটনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে নির্দেশ দিয়েছি।’
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী আজ একাদশ জাতীয় সংসদের নবম অধিবেশনে এই শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
নারায়ণগঞ্জ মসজিদে বিস্ফোরণের কারণ উদঘাটনে ইতোমধ্যেই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং তদন্ত শুরু হয়ে যাওয়ায় খুব শিগগিরই কি কারণে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে তা বেরিয়ে আসবে বলে প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করছেন।
তিনি আরো বলেন, ‘বিশেষজ্ঞরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন এবং আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে।’
এ সময় সংসদ নেতা একটি গ্যাসের পাইপলাইনের উপর মসজিদ নির্মাণের অনুমোদন অথবা এমন একটি ছোট জায়গায় ছয়টি এয়ার কন্ডিশনারে বিদ্যুৎ সংযোগের অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে কোন অনিয়ম হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি আরো বলেন, ‘এমন একটি ছোট জায়গায় ছয়টি এয়ার কন্ডিশনার স্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি মসজিদটি একটি পাইপলাইনের উপর নির্মিত হয়েছে বলে জানা গেছে। সাধারণত গ্যাস পাইপের উপর কোন ধরনের স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি নেই। রাজউক কি এই অনুমোদন দিয়েছে? কোন প্রতিষ্ঠানই এই অনুমোদন দিতে পারে না। কারণ, তাহলে এ ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকেই যায়। এখন এই ব্যাপারে তদন্ত করা হবে।’
প্রধানমন্ত্রী দেশব্যাপী অবৈধ স্থানে নির্মিত মসজিদ এবং এসব মসজিদে অপরিকল্পিতভাবে এয়ার কন্ডিশনার স্থাপনের বিষয়ে ভালভাবে খোঁজ নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া অত্যন্ত জরুরী। অন্যথায়, যে কোন সময় এমন আরো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।’
মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনাকে অনাকাক্সিক্ষত ও দুঃখজনক হিসেবে অভিহিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার এই ঘটনায় দগ্ধদের উন্নত চিকিৎসা দেয়ার জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
তিনি আরো বলেন, শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেনের সাথে তাঁর সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে এবং আহতদের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী এই ঘটনায় নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা ও তাদের শোক-সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। এছাড়াও, তিনি এই ঘটনায় আহতদের আশু আরোগ্য কামনা করেন।
এখন পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার বায়তুস সালাহ জামে মসজিদে শুক্রবার রাতের ওই বিস্ফোরণে আহত ৫০ জনের মধ্যে ২৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এরা গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় রাজধানীর শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারিতে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
শোকপ্রস্তাবের ওপর বক্তব্যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান সংসদের দুই সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন ও মো. ইস্রাফিল আলমের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
‘দুঃখের বিষয় যে বিশেষ করে করোনভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পরে আমরা একের পর এক সংসদে সহকর্মীদের হারিয়েছি। আর এই সময়ের মধ্যে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং নেতাকর্মীও মারা গেছেন।’
প্রধানমন্ত্রী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতদের জন্যও শোক প্রকাশ করেন এবং কোভিড-১৯ রোগীদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন।
তিনি দেশের প্রথম মহিলা স্বরাষ্ট্র্রমন্ত্রী ও আ. লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাহারা খাতুনের মৃত্যুকে দল ও জাতির জন্যও অপূরণীয় ক্ষতি হিসাবে বর্ণনা করেন।
তিনি বলেন, ‘তিনি (সাহারা খাতুন) একজন সৎ, সাহসী ও নিবেদিত রাজনীতিবিদ ছিলেন এবং এইচ এম এরশাদ ও খালেদা জিয়া সরকারের অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েও সম্মুখ সারি থেকে সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন।’ সাহারা খাতুনের সাহসিকতার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদ্রোহ হওয়ার পরে তিনি বিডিআর সদর দফতরে যান (২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি) এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেক লোককে (বিডিআর বন্দীদশা থেকে) বাঁচান।
শেখ হাসিনা যোগ করেন, ‘সাহারা আপা আমাকে বলেছিলেন যে তিনি কোনো রকমে বিডিআর (সদর দফতর) থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। কারণ তারা (বিডিআর বিদ্রোহীরা) তাকে আক্রমণ করতে চেয়েছিল। সাধারণ কারো পক্ষে এটা সম্ভব হতে পারে না।’
এই সময় যারা ক্ষমতায় আসতে পারেনি তারা এই হত্যাযজ্ঞের সাথে জড়িত থাকতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একদিন এর সাথে জড়িতদের নাম (বিডিআর বিদ্রোহ) অবশ্যই প্রকাশিত হবে।’
ছয় বছরের প্রবাস জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে তিনি সবসময় সাহারা খাতুনকে তার পাশে পেয়েছিলেন স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সাহারা খাতুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর জনগণকে নিরাপদ জীবন দিয়েছিলেন।’ সভায় প্রধানমন্ত্রী ই¯্রাফিল আলমের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, তার মৃত্যুতে দেশ একজন দক্ষ সংসদ সদস্যকে হারিয়েছে।
ভারতের সদ্যপ্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট হত্যাকা-ের পরে তাদের খারাপ সময়ে সর্বদা তাদের পাশে ছিলেন। শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৫ সালের হত্যাযজ্ঞে সবকিছু হারিয়ে শরণার্থী হিসাবে ভারতে আশ্রয় নেয়ার পর তিনি উপমহাদেশের এই প্রবীণ রাজনীতিবিদ এবং তাঁর পরিবারকে তাদের নিকটতম ও প্রিয়জন হিসাবে পেয়েছিলেন।
তিনি বলেন, দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগে পদ্মাসেতু নির্মাণে তহবিল যোগান স্থগিত করার পর তিনি (প্রণব মুখার্জি) বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের পক্ষে লড়াই করেছেন।
প্রণব মুখার্জি অত্যন্ত মেধাবী ও প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ ছিলেন এবং কংগ্রেসের নেতা হওয়া সত্ত্বেও সবাই তাকে সম্মান করত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর মৃত্যুতে উপমহাদেশ একজন সত্যিকারের নেতাকে হারিয়েছে।
জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের বড় মেয়ে শেখ হাসিনা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের দুই সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) চিত্তরঞ্জন দত্ত (সিআর দত্ত নামে পরিচিত), বীর উত্তম এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরীর অবদানের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘সিআর দত্ত ও আবু ওসমান চৌধুরী দুজনেই দেশের স্বাধীনতা অর্জনে সাহসিকতার সাথে বিরাট ভূমিকা পালন করেছিলেন।’
আলোচনায় অংশ নেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, রেলমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মুন্নুজন সুফিয়ান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, এমপি। এছাড়া বেগম মতিয়া চৌধুরী, এমপি, শাজাহান খান, এমপি, আবদুল মতিন খসরু, এমপি, বিরোধী দলের নেতা গোলাম মুহাম্মদ কাদের, এমপি, বিরোধী দলের চিফ হুইপ মো. মশিউর রহমান রাঙ্গা, এমপি, মো. শহীদুজ্জামান সরকার, এমপি, শামসুল আলম দুদু, এমপি, বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশিদ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।