ড. জেবউননেছাঃ
প্রখ্যাত বাঙালি কবি ও লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় বঙ্গবন্ধু স্মরণে লিখেছিলেন, “নরহত্যা মহাপাপ, তার চেয়ে পাপ আরো বড়ো করে যদি তাঁর পুত্রসম বিশ্বাসভাজন জাতির জনক যিনি অতর্কিতে তারই নিধন। নিধন সবংশে হলে সেই পাপ আরো গুরুতর।” ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ২৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন। তার মধ্যে ছিলেন ছয়জন নারী। ঘাতকের বুলেট ছয়জন নারীর জীবনের সকল স্বপ্নকে তছনছ করে দিয়েছিল। সেই ছয়জন নারীর শোকগাঁথা নিয়ে আলোচ্য প্রবন্ধটি গ্রথিত হয়েছে।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব : বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ৮ আগস্ট ১৯৩০ সালে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম শেখ জহুরুল হক এবং মায়ের নাম হোসনে আরা বেগম। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতা সায়েরা খাতুন তাকে স্নেহে আগলে রাখেন। স্থানীয় মিশনারি স্কুলে তিনি লেখাপড়া করেন। বঙ্গবন্ধু এন্ট্রান্স উত্তীর্ণ হওয়ার পর ১৯৪২ সালে তাদের সংসার-জীবন শুরু হয়। জাতির পিতা যাকে সম্বোধন করতেন রেণু নামে। ‘রেণু’ শব্দের অর্থ উদার। বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকার সময়গুলো একাকী যন্ত্রণা সয়ে বঙ্গবন্ধুকে সাহস জুগিয়েছেন, মানসিকভাবে সমর্থন দিয়েছেন। একজন বঙ্গমাতা যিনি বহতা নদী। যাকে নিয়ে লিখতে হলে একটি গ্রন্থ লেখা যায়। বঙ্গমাতা দেশের জন্য কতটা অন্তঃপ্রাণ ছিলেন, তার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।
তিনি একজন রাজনৈতিক সচেতন নারী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতকালে ছাত্রলীগের নেতারা বেগম মুজিবের কাছে পরামর্শ নিতেন এবং নেতাদের তিনি বুদ্ধি পরামর্শ দান করতেন এবং অনেক সময় নেতাদের ডাকতেন দলের সমস্যা শোনার জন্য। দলের সংকটকালে অর্থ সাহায্য প্রদান করতেন। একটি ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়, ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেন। তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাবন্দি শেখ মুজিবকে গোলটেবিলে অংশগ্রহণ করার জন্য প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়। বেগম মুজিব প্যারোলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে জানান, “কোনোক্রমেই প্যারোলের প্রস্তাব গ্রহণ করা যাবে না। আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও নিঃশর্ত মুক্তি ছাড়া আর কিছুতে রাজি হবে না।” কারণ, বঙ্গমাতা বুঝতে পেরেছিলেন আইয়ুব খানের পতন আসন্ন। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বেগম মুজিবকে রাজি করানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বেগম মুজিব প্যারোলে মুক্তি না নেওয়ার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুকে অনুপ্রাণিত করেছেন। তার এই বিস্ময়কর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে বেগবান করে।
শুধু কী তাই, ১৯৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকে তিনি একটি কথাই বলেছিলেন, “তোমার যেটি মনে আসে তুমি সেটিই বলবে।” বেগম মুজিব গান শুনতেন, বই পড়তে ভালোবাসেন। বেগম মুজিব বার্ট্র্রান্ড রাসেলের জীবনী পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরবর্তীকালে তাই তার পুত্রসন্তানের নাম রেখেছিলেন রাসেল। সাদাসিধে সহজ-সরল জীবন ছিল বেগম মুজিবের। সেটির প্রমাণ পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর আসবাবপত্র এবং ডাইনিং টেবিলে রাখা তৈজসপত্রের মাধ্যমে এবং তার পরিধানকৃত শাড়ি-কাপড়ে। ফার্স্টলেডি হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রীয় সফরে তাকে দেখা যেত না। ছেলে-মেয়েদের কাপড় নিজে সেলাই করতেন। তার নিরাভরণ জীবনের শেষ উদাহরণ, মৃত্যুর সময় তার পায়ে ছিল বাথরুম স্লিপার। এমন একজন গুণসম্পন্ন নারীর উৎসাহ-প্রেরণায় বঙ্গবন্ধু রাজনীতিতে নিশ্চিন্তে নিজেকে নিবেদিত করেছেন।
বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে বেগম মুজিবকে নিয়ে মাঝে মাঝেই স্মৃতিচারণ করেছেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ৭ পৃষ্ঠায় বেগম মুজিবের আগমন একজন বধূ হিসেবে, যার নাম রেণু। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “একটা ঘটনা লেখা দরকার, নিশ্চয়ই অনেকে আশ্চর্য হবেন। আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বারো বা তেরো বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব।’ রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বীর হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হলো। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন তার মা মারা যান। একমাত্র রইল তার দাদা। দাদাও রেণুর সাত বছর বয়সে মারা যান। তারপর সে আমার মা’র কাছে চলে আসে। আমার ভাই-বোনদের সাথেই রেণু বড় হয়। রেণুর বড় বোনের ও আমার আর এক চাচাতো ভাইয়ের সাথে বিবাহ হয়। রেণু আমার শ্বশুরবাড়িতে থাকল, কারণ আমার ও রেণুর বাড়ির দরকার নেই। রেণুদের ঘর আমাদের ঘর পাশাপশি ছিল, মধ্যে মাত্র দুই হাত ব্যবধান। অন্যান্য ঘটনা আমার জীবনের ঘটনার মধ্যেই পাওয়া যাবে।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ৭-৮)। এই হলো রেণুর জীবন।
অপর আর এক স্মৃতিকথায় দেখা যায়, “রেণু কয়েকদিন আমাকে খুব সেবা করল। যদিও আমাদের বিবাহ হয়েছে ছোটবেলায়। ১৯৪২ সালে আমাদের ফুলশয্যা হয়।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২১)। বঙ্গবন্ধু যখন কলেজে ভর্তি হলেন, তখন থেকেই ফজিলাতুন্নেছা মানসিক সাহায্য প্রদান করেছেন। “আব্বা, মা, ভাই-বোনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেণুর ঘরে এলাম বিদায় নিতে। দেখি কিছু টাকা হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। ‘অমঙ্গল অশ্রুজল’ বোধহয় অনেক কষ্টে বন্ধ করে রেখেছে। বলল, ‘একবার কলকাতা দেখলে আর আসতে চাও না। এবার কলেজ ছুটি হলেই বাড়ি এসো।’” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ৬১)।
বঙ্গবন্ধু ইসলামিয়া কলেজে যখন পড়তে গেলেন। কলেজ প্রিন্সিপাল ডেকে বললেন, তুমি কলকাতা শহরে থাকতে পারবে না। অতঃপর তিনি শহরের বাইরে উল্টোডাঙ্গাতে তার বোনের বাড়িতে থাকলেন। বঙ্গবন্ধু যেন নিরবচ্ছিন্নভাবে লেখাপড়া করতে পারেন, এজন্য তাকে উৎসাহ দেওয়ার লক্ষ্যে তিনি উল্টোডাঙ্গা গিয়েছেন। এই স্মৃতিকথাটিতে তারই প্রমাণ পাওয়া যায়, “কিছুদিন পর রেণুও কলকাতায় এসে হাজির। রেণুর ধারণা, পরীক্ষার সময় আমার কাছে থাকলে আমি নিশ্চয়ই পাস করব। বিএ পরীক্ষা দিয়ে পাস করলাম।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ৭২)। “টাকা পয়সা নাও থাকতে পারে। টাকার দরকার হলে লিখতে বলেছিল।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১১৮)।
নীরবে নিভৃতে বঙ্গবন্ধুর পাশে তিনি সৌভাগ্যের প্রতীক হয়ে ছিলেন। মাঝে মাঝে তার অভিমানের বাঁধ ভেঙে যেত। কিন্তু কিছুই প্রকাশ করতেন না। “রেণু বলল, ‘এভাবে তোমার কতকাল চলবে।’ আমি বুঝতে পারলাম, যখন আমি ওর কাছে এলাম। রেণু আড়াল থেকে সব কথা শুনছিল। রেণু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্যে টাকা পয়সা জোগাড় করে রাখত যাতে আমার কষ্ট না হয়।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১২৬)। “লাহোর থেকে রেণুকে চিঠি দিয়েছিলাম, বোধহয় পেয়ে থাকবে।” “লাহোর থেকে ফিরে নিশ্চয়ই একবার বাড়িতে আসব। রেণু তো নিশ্চয়ই পথ চেয়ে বসে আছে। সে তো নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করে, কিন্তু কিছু বলে না। কিছু বলে না বা বলতে চায় না, সেই জন্য আমার আরও বেশী ব্যথা লাগে।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১৪৫-১৪৬)। “গোপালগঞ্জ গিয়ে দেখি থানার ঘাটে আমাদের নৌকা। আব্বা, মা, রেণু, হাচিনা ও কামালকে নিয়ে হাজির। ঘাটেই দেখা হয়ে গেল।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১৮৩)।
ধৈর্যশীল রেণু বাচ্চাগুলোকে নিয়ে একাই দিনাতিপাত করেছেন। অপেক্ষা করেছেন কখন বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে ফিরবেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ভালোবাসা ছিল শান্ত নদীর মতো বয়ে যাওয়া স্রোত, মাঝে মাঝে সেই স্রোত খরস্রোতা হয়ে যেত। এই স্মৃতিকথাটুকু তাই প্রমাণ করে। “রেণু আমাকে যখন একাকী পেল, বলল, ‘জেলে থাকো আপত্তি নেই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। তোমাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে। তোমার বোঝা উচিত আমার দুনিয়ায় কেউ নাই। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা গেছেন, আমার কেউই নাই। তোমার কিছু হলে বাঁচব কি করে?” কেঁদেই ফেলল। আমি রেণুকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, তাতে ফল হয় উল্টা। আরও কাঁদতে শুরু করল।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১৯১)। রেণু মাঝে মাঝে রাগতস্বরে অভিমান নিয়ে কথা বলতেন। “কেন তুমি অনশন করতে গিয়েছিলে? এদের কি দয়ামায়া আছে? আমাদের কারও কথাও তোমার মনে ছিল না? কিছু একটা হলে কি উপায় হত? আমি এই দুইটা দুধের বাচ্চা নিয়ে কি করে বাঁচতাম? হাচিনা, কামালের অবস্থা কি হত? তুমি বলবা, খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট তো হত না? মানুষ কি শুধু খাওয়া পরা নিয়েই বেঁচে থাকতে চায়? আর মরে গেলে দেশের কাজই বা কিভাবে করতা?” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২০৭)। কতটুকু দেশপ্রেমিক হলে এমন প্রশ্নবানে জর্জরিত করতে পারেন বঙ্গবন্ধুকে।
এক সময় রেণু চিরচেনা গ্রাম ছেড়ে সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ভাড়া থাকেন ঢাকার বিভিন্ন স্থানে। এই স্মৃতিকথা থেকে তাই জানা যায়, “রেণু ঢাকায় এসেও শান্তিতে বাস করতে পারেন নি। ‘আমি সন্ধ্যার দিকে ঢাকায় ফিরে এলাম। বাসায় যেয়ে দেখি রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে গতকাল ঢাকায় এসেছে। সে এখন ঢাকায়ই থাকবে।’” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২৬২)। “আমার স্ত্রীও তখন নতুন ঢাকায় এসেছে। বাংলাদেশ ভাগ হওয়ার পূর্বে যদিও কলিকাতা গিয়াছে, কয়েকবার আমাকে দেখতে, কিন্তু ঢাকায় সে একবারে নতুন; সকলকে ভাল করে জানেও না। মহাবিপদে পড়লো। সরকার হুকুম দিয়েছে ১৪ দিনের মধ্যে বাড়ি ছাড়তে। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে মহাবিপদেই পড়ল আমার স্ত্রী।” (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ১২০)। “তাও হাল ছেড়ে দেননি রেণু। এক সময় রেণু বড় মেয়ের বিয়ের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। রেণু দেখা করতে এসেছিল। রেহানার জ্বর, আসে নাই। রাসেল জ্বর নিয়ে এসেছিল। হাচিনার বিবাহের প্রস্তাব এসেছে। রেণু ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।” (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ১৯৪)। “১৪ তারিখে রেণু বিশেষ অনুমতি নিয়ে দেখা করতে এসেছে। ঈদের জন্য এই অনুমতি দিয়েছে।” (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ২০৩)। কারাগারে বঙ্গবন্ধুর জন্য নিয়মিত খাবার পাঠাতেন রেণু। “যথারীতি রবিবার সকাল থেকে খিচুড়ি পাকের জোগাড়ে আত্মনিয়োগ করা হলো। রেণু কিছু ডিমও পাঠাইয়াছে।” (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ২৩৫)।
বঙ্গবন্ধুর ‘রেণু’ একজন রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন দূরদর্শী নারী ছিলেন বলেই তার স্মৃতিকথা লেখার জন্য খাতা তুলে দিতেন। নইলে কালের গর্ভে হারিয়ে যেত কত অজানা ইতিহাস। এই স্মৃতিকথাটি তারই উদাহরণ, “আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, ‘বসেই তো আছো, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২)। ‘কারাগারের রোজনামচা’র উপক্রমনিকায় বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা লিখেন, “আমার মা আমাকে বললেন, ‘একবার যেতে পারলে আর কিছু না হোক তোর আব্বার লেখা খাতাগুলো যেভাবে পারিস নিয়ে আসিস।’ খাতাগুলো মার ঘরে কোথায় রাখা আছে তাও বলে দিলেন। আব্বার লেখা এই খাতার উদ্ধার আমার মায়ের প্রেরণা ও অনুরোধের ফসল। আমার আব্বা যতবার জেলে যেতেন মা খাতা, কলম দিতেন লেখার জন্য। বারবার তাগাদা দিতেন। আমার আব্বা যখন জেল থেকে মুক্তি পেতেন মা সোজা জেলগেটে যেতেন, আব্বাকে আনতে আর আব্বার লেখাগুলো যেন আসে তা নিশ্চিত করতেন। সেগুলি অতি যত্নে সংরক্ষণ করতেন।” (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ৮-৯)। অপরদিকে, বেগম মুজিবের ছোট কন্যা শেখ রেহানা বলেন, “আমার মায়ের কাছ থেকে আমাদের যে জিনিসটি সবার আগে শেখা উচিত, তা হলো ধৈর্য আর সাহস।” বেগম মুজিব দশগুণে গুণান্বিতা যেন দশভূজ নারী, তার মধ্যে যে ১০টি গুণ দেখা যায়, তা হলো- তিনি একাধারে আদর্শ মাতা, বুদ্ধিমতী স্ত্রী, ধৈর্যশীল, বিচক্ষণ, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, ধীশক্তিসম্পন্ন, রাঁধুনী, দূরদর্শী এবং সাহসী নারী।
বেগম মুজিবের মাঝে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়া যায়। বেগম রোকেয়া স্বপ্ন দেখেছিলেন বৈষম্যমুক্ত সমাজের। বেগম মুজিব স্বপ্ন দেখেছিলেন বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্রের। তিনি ‘বঙ্গমাতা’ হয়ে বেঁচে থাকবেন ইতিহাসের পাতায়। কবি মু. জালাল উদ্দিন নলুয়া তার বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে ‘বঙ্গমাতা’ স্মরণে তার কবিতায় বলেছেন, “ডানা মেলে মুক্ত বলাকা/রক্তে ভিজে পতাকা/অম্লান তুমি বঙ্গমাতা/আছো হৃদয়ে আঁকা।” বনানী গোরস্তানে ১৫ আগস্টের শহিদের সাথে বঙ্গবন্ধুর রেণু বাঙালির বঙ্গমাতা বেগম মুজিব বুকের সব কষ্ট চাপা দিয়ে নীরবে শায়িত আছেন।
শহিদ বেগম সামসুন নেছা আরজু সেরনিয়াবাত (আরজু মণি) : শহিদ বেগম সামসুন নেছা আরজু সেরনিয়াবাত ১৯৪৭ সালের ১৫ মার্চ অবিভক্ত ভারতের কলকাতা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস বরিশালের আগৈলঝারা থানার সেরাল গ্রামে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কৃষক নেতা শহিদ অ্যাডভোকেট আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং বঙ্গবন্ধুর সেজোবোন আমেনা বেগমের দ্বিতীয় সন্তান। বঙ্গবন্ধুর বড়বোন আছিয়া বেগমের ছেলে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শহিদ শেখ ফজলুল হক মণির সাথে ১৯৬৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। শহিদ আরজু মণি ১৯৬৪ সালে বরিশাল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হন এবং বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। বাবার কাছেই তার রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি। রাজনৈতিক সচেতন আরজু মণি ছাত্রাবস্থায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন এবং বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজ ছাত্রী সংসদের জিএস নির্বাচিত হন এবং ১৯৬৯ সালে গণ-আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে, ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দিয়েছিলেন এবং দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। কিন্তু পরীক্ষার ফলাফল দেখে যেতে পারেন নি। পাঁচ বছর বয়সী পুত্র শেখ ফজলে শামস পরশ বর্তমানে আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান এবং চার বছর বয়সী পুত্র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে রেখে শহিদ হন। ঢাকার ধানমন্ডির সড়ক নং-১৩/১-এ নিজ বাসভবনের সিঁড়িতে ঘাতকের গুলিতে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা আরজু বুকে ও পেটে গুলিবিদ্ধ হন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর সময় তিনি ফাতেমা সেলিমকে (শেখ সেলিম, এমপির সহধর্মিণী) বলেন, “আমার দুটো সন্তানকে দেখে রেখো।” তিনি একজন দানশীল নারী ছিলেন, ছিলেন মৃদুভাষী এবং মমতাময়ী। তিনি দুস্থ অসহায় এতিম ও বয়স্ক লোকদের দেখলে ব্যথিত ও বিচলিত হয়ে পড়তেন এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। আরজু নামের অর্থ ‘বাসনা’। একজন বাঙালি নারী হিসেবে তার বাসনা ছিল আর ৮-১০ জন নারীর মতো সংসার-ধর্ম পালন করবেন, দেশের সেবা করবেন এবং দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াবেন। কিন্তু তা আর হয়নি। ঢাকার বনানী গোরস্তানে ১৫ আগস্টের শহিদদের সাথে জীবনের সব ‘বাসনা’ বিসর্জন দিয়ে শহিদ বেগম সামসুন নেছা আরজু সেরনিয়াবাত নীরবে শুয়ে আছেন।
সুলতানা কামাল খুকু : সুলতানা কামাল খুকু ১৯৫২ সালের ১০ ডিসেম্বর ঢাকার বকশিবাজারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম দবিরউদ্দিন। ১৯৬৭ সালে মুসলিম গার্লস স্কুল থেকে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তৎকালীন গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট কলেজ বর্তমানে বদরুন্নেসা কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। সফলতার সাথে স্নাতক সম্পন্ন করেন এবং স্নাতকোত্তর মৌখিক পরীক্ষার কিছুদিন পূর্বে ঘাতকরা তার বুকে ও তলপেটে গুলি করে হত্যা করে। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই তিনি বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সুলতানা কামাল ১৯৬২-৬৩ সালে আন্তঃবিদ্যালয় অ্যাথলেট হিসেবে পুরস্কৃত হন। ১৬ বছর বয়সে ১৯৬৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে অলিম্পিকে নতুন রেকর্ড গড়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৭০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় হার্ডলসে স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে তিনি ১০০ মিটার হার্ডলস, হাইজাম্প এবং লংজাম্পে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ধারাবাহিকভাবে ১৯৭৪ এবং ১৯৭৫ সালেও ক্রীড়াক্ষেত্রে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।
সুলতানা কামাল একজন হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল তরুণী ছিলেন। ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল বন্ধুবৎসল এবং অতিথিবৎসল। বন্ধুদের সাথে তিনি পান খেতেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি বন্ধুদের সাথে একরকমের পোশাক পরতেন। রাজনৈতিক সচেতন সুলতানা কামাল ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। তিনি বেঁচে থাকলে ক্রীড়াক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে একজন অনুসরণীয় ক্রীড়াবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এমন জাতীয় সম্পদকে অসময়ে হারানো দেশের জন্য বেদনার। বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টের শহিদদের সাথে তিনি চিরতরে শায়িত আছেন।
পারভীন জামাল রোজী: বঙ্গবন্ধুর ছোট বোন খাদিজা হোসেন এবং তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সচিব এটিএম সৈয়দ হোসেনের মেয়ে পারভীন জামাল রোজী ১৯৫৬ সালে সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। গোলাপের মতো সুন্দর ছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধু ‘রোজী’ নামটি রেখেছিলেন। তিনি ধানমন্ডি গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি উত্তীর্ণ হন। মৃত্যুকালে বদরুন্নেসা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মেজোছেলে শেখ জামালের সাথে তার ১৯৭৫-এর ১৭ জুলাই বিবাহ হয়। মেহেদির রং না শুকাতে বিয়ের ২৮ দিনের সময় মৃত্যুবরণ করেন। যে-জীবন হতে পারত প্রজাপতির মতো। সে-জীবন ঝরে গেছে ঘাতকের বুলেটে। ঘাতকের গুলিতে তার মাথার একাংশ উড়ে গিয়েছিল, তার তলপেট, বুক ও মাথায় গুলি করা হয়েছিল। বনানী কবরস্থানে শহিদদের সাথে রোজী জামাল তার অসমাপ্ত জীবনের দুঃখ নিয়ে শুয়ে আছেন।
বেবী সেরনিয়াবাত: বঙ্গবন্ধুর সেজোবোন আমেনা বেগমের ছেলে এবং প্রাক্তন পানিসম্পদ ও বিদ্যুৎবিষয়ক মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের কন্যা বেবি সেরনিয়াবাত। ১৯৬০ সালে ২৪ এপ্রিল বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। ইউনিভার্সিটি অব ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে তিনি দশম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন। মৃত্যুর পূর্বের দিন তার দাদির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকার ৩৭ মিন্টো রোডে (বর্তমানে ঢাকা মেট্রোপলিটনের দপ্তর) তাদের বাড়িতে শেখ রাসেলও গিয়েছিলেন, একসাথে শেখ রাসেল, আরিফ আবদুল্লাহ, সুকান্ত বাবু, বেবী সেরনিয়াবাত মিন্টো রোডের বাসায় খেলাধুলা করেছেন। তার বোন হামিদা সেরনিয়াবাতের স্মৃতিকথায় দেখা যায়, “১৫/২০ জনের মতো সবাই সশস্ত্র। আমরা সবাই হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বললো ভয় পাবেন না, সবাই নিচে নেমে আসুন। ছোট বোন বেবী বলে উঠলো ভয় পাবো কেন? আল্লাহ ছাড়া কাউকেই ভয় পাই না। সবাইকেই একদিন মরতে হবে। ভীষণ সাহসী ও একরোখা ছিল বেবী চৌদ্দ বছরের এক চঞ্চল কিশোরী। ঘাতকের বুলেটে ঝাঁঝরা হয়েছেল ওর হৃৎপি-টা।” এমন একজন অকুতোভয় নারী বেঁচে থাকলে হতে পারতেন আদর্শ বধূ, মা এবং সমাজসেবক। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের শহীদদের সাথে বনানী গোরস্তানে বেবি সেরনিয়াবাত তার উচ্ছল কৈশোরকে সাথী করে চিরতরে শুয়ে আছেন।
লক্ষ্মীর মা : আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়ির গৃহপরিচারিকা লক্ষ্মীর মা নামে পরিচিত একজন নারী। তার বাড়ি ফরিদপুরে। তিনি একজন বিধবা নারী ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের গুলিতে তিনি প্রাণ হারান। বাকি নাম-পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। বনানী গোরস্তানে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট শহিদদের সাথে তিনি শুয়ে আছেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, বাংলা ১৩৮২ সালের ২৯ শ্রাবণ, আরবি ১৩৯৫ হিজরির ৮ শাবানের দিনটি ছিল শুক্রবার। ছুটির দিনটিতে সেদিন শ্রাবণের আকাশে বৃষ্টি হয়ে ঝরেছে ঘাতকের আঘাতে ঝরে যাওয়া ২৬টি প্রাণের প্রতিটি রক্তবিন্দু। সেদিন ডুবে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশের সূর্য। সেই ডুবন্ত সূর্য উঠতে শুরু করছে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যা কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাধ্যমে। স্বজন হারানো পরিবারের শোক যেন হয়েছে পরিশক্তি। লেখাটির শেষ পর্যায়ে মনে পড়ছে কবি নূহ-উল-আলম লেনিনের কবিতা- “আমরা আজ আর শোক করব না/আমাদের শোক এখন শক্তির দ্যোতনা। ওরা বলেছিল কেউ তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না/ওদের দম্ভ ও ঔদ্ধত্যের জবাব দিয়েছে বাংলাদেশ।” জয় বাংলা।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, লোক প্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণাবিষয়ক পরিষদ