(বাসস) : ছবিগুলোতে চোখ রাখতেই মনে হয় যেন, কোন ইতিহাসের পাতা খুলে বসেছি। যেখানে একজন মহান নেতা, এক আত্মত্যাগী দেশপ্রেমিক, একজন স্বপ্নদ্রষ্টা রাষ্ট্রনায়কের জীবন ও কর্মের অনবদ্য দলিল ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাত বার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে তাঁর জীবন ও কর্মের ওপর তথ্য অধিদফতরের ক্লিনিক ভবন প্রাঙ্গনে আয়োজন করা হয়েছে আলোকচিত্র, ডিজিটাল ডিসপ্লে এবং সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক সপ্তাহব্যাপী প্রদর্শনী। প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক ও রাজনৈতিক জীবনের দূর্লভ ছবি এবং সংবাদপত্রের ক্লিপিং।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে যখন মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটানোই কঠিন হয়ে পড়েছিলো। তার উপর যোগাযোগ,পরিবহন, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ প্রতিটি খাতের ব্যাপক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতেও সরকারের প্রয়োজন ছিলো অর্থ সাহায্যের।এমন পরিস্থিতিতে বিদেশী সাহায্যের কোনো বিকল্প ছিলো না। তখন বঙ্গবন্ধু একজন রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকায় থেকে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সর্বাধিক জোর দিয়েছেন। “বিদেশী সাহায্য নেবো- কিন্তু স্বাধীনতা বিকিয়ে নয়” (দৈনিক বাংলা, ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩, বুধবার)। প্রথম পাতায় আট কলাম ব্যানারে ছাপানো এই শীর্ষ খবর তাঁর অনমনীয় মনোবলেরই ইঙ্গিত দেয়।
“পররাষ্ট্রনীতি থাকবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ” ( রোববারের দৈনিক বাংলা, ১৮ মার্চ ১৯৭৩, রোববার)। বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী রাষ্ট্রপরিচালনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো পররাষ্ট্র নীতি। এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। বাংলাদেশের বর্তমান পররাষ্ট্রনীতিতেও বঙ্গবন্ধুর সেই নীতির অনুশীলন আমরা দেখতে পাই।
“লেখনির মাধ্যমে দেশ সেবা করুন”; “বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসন জাতীয় দায়িত্ব” ; “বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর আরো নিকটতর প্রতিবেশি হলো”; “বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধিদের বিচার হবেই” ;“ ৮৫ টি শিল্প ইউনিটের দায়িত্ব গ্রহণ”; ইত্যাদি শিরোনামের মধ্যে জাতির পিতার দূরদর্শী রাষ্ট্র চিন্তার প্রতিফলন দেখা যায়।
বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহিত আলোকচিত্রে একজন রাষ্ট্রনায়ক ও কূটনীতিক বঙ্গবন্ধুকে যেমন দেখা যায়, তেমনি একজন ¯েœহময় ও কর্তব্য পরায়ন পিতাকেও আমরা দেখতে পাই।
বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের পরতে পরতে রয়েছে নানা ঐতিহাসিক ঘটনা ও মুহূর্ত। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রভাত ফেরিতে অগ্রগামী মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৭ সালে রাষ্ট্রীয় সফরকালে নয়াদিল্লীতে ভারতের রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের সাথে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান এবং মন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ছয় দফার প্রতি সমর্থন জানিয়ে শপথ গ্রহণের জন্য রেসকোর্স ময়দানের পথে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সদস্যগণসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ছবি কালের সাক্ষী হয়ে আছে।
এছাড়াও রয়েছে বহুল ব্যবহৃত প্রকাশিত অনেক ছবি। যার মধ্যে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস, বাংলাদেশের খসড়া সংবিধানে সাক্ষর, ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন রাঙ্গামাটি জেলার কাউখালী উপজেলার বেতবুনিয়ায় দেশের প্রথম ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন, রাষ্ট্রীয় সফরে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপতিদের সাথে বৈঠক, আলোচনা ও বক্তৃতায় অংশ নেয়ার ছবি।
যাঁর ৫৫ বছরের জীবনের প্রায় ১২ বছরই কেটেছে কারাগারে তার পারিবারিক জীবনের প্রতিটি ছবিই এক একটা ইতিহাস। এক একেকটা দূর্লভ মুহূর্ত। এই প্রদর্শনীতে দেয়া অনেক ছবিই আগে কোথাও না কোথাও প্রকাশিত হয়েছে । তবুও যেন চোখ আটকে যায়। কখনো মায়ের আদরে, কখনো অসুস্থ বাবার পাশে , কিংবা বাবা মায়ের পাশে বসা শেখ মুজিবের প্রতিটি ছবিই তো আজ বেদনাবিধূর স্মৃতি।
বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সবচেয়ে আনন্দঘন মুহুর্তের দুটি ছবি যেন ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকান্ডকে ধীক্কার জানাচ্ছে! একটি ছবিতে বর বেশে শেখ জামাল ও তার স্ত্রী পারভিন রোজীকে বরণ করে নিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা। পাশে দাঁড়ানো সদ্য বিবাহিত শেখ কামাল ও সুলতানা কামাল । এটি ১৯৭৫ সালের ১৭ জুলাইতে তোলা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সচিব এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সবচেয়ে আনন্দঘন সময় ছিলো জুলাই ১৯৭৫। তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই বঙ্গবন্ধু পারিবারিকভাবে শেখ কামাল ও সুলতানা কামালের বিয়ে দেন। তার তিন দিন পর ১৭ জুলাই মেজ ছেলে শেখ জামালের সাথে পারভিন জামাল রোজির বিয়ে দেন।
মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষ পারিবারিক উৎসব ছিল ’৭৫-এর ২৭ জুলাই দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়-এর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যোগদান। খুবই সাদামাটা এই অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব সজিব ওয়াজেদ জয়ের সাথে ছবি তোলেন। শিশু জয়ও সেদিন নানার টুপি মাথায় নিয়ে পোজ দেন।
প্রদর্শনীর ছবির পরতে পরতে এমনই ইতিহাস ও আনন্দ- বেদনার উপলব্ধী দর্শক মাত্রকেই ইতিহাসরে সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়।
তথ্য অধিদফতরের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা সুরথ কুমার সরকার জানান, জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে তথ্য অধিদফতর গত চার বছর ধরে নিয়মিত এ প্রদর্শনীর আয়োজন করছে।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে এবছর এই প্রদর্শনী আরো বৃহত্তর পরিসরে আয়োজন করার পরিকল্পনা ছিলো। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে কোভিড-১৯ এর প্রভাব মোকাবেলায় সকল পরিকল্পনাই সীমিত আকারে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তবে আগামীতে চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় এই প্রদর্শনীর আয়োজন করার পরিকল্পনা রয়েছে।
তিনি জানান, প্রদর্শিত নিউজ পেপারের ক্লিপিংগুলো তথ্য অধিদফতরের নিজস্ব সংগ্রহ থেকে নেয়া হয়েছে। তবে বেশিরভাগ ছবি বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করা। আগামীতে এই প্রদর্শনীতে ছবি ও ক্লিপিং এর সংখ্যা আরো বাড়ানো হবে।