ইতিহাস নির্মম। রসিক ও বটে কদাচিৎ।
ইতিহাস টিকে থাকে এবং সঠিকভাবে পথ দেখাতে পারে যোগ্য ‘লিগ্যাসি’ তথা উত্তরাধিকারের মাধ্যমে। ব্যক্তি হোক বা প্রতিষ্ঠান— যার বা যাদের লিগ্যাসি ঠিকভাবে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত হয়েছে, তারাই কেবল ইতিহাসের পাতায় টিকে রয়েছেন। লিগ্যাসির ব্যর্থতার দায়ে অনেক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হতে হয়েছে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা, বিশেষ করে তাজউদ্দীন আহমদের লিগ্যাসি কোনদিকে প্রবাহিত হচ্ছে— তা পর্যালোচনার দাবি রাখে।
খন্দকার মুশতাকের বিভিন্ন ‘অপ্রকাশ্য’ কার্যকলাপ এবং স্বল্প প্রকাশিত কার্যকলাপের পরও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে ত্যাগ করেননি। শেষ পর্যন্ত এর জন্য তাকে চরম মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে। এই মূল্যে পরিশোধের ‘অ্যানালিটিক’ তর্কের চেয়েও কেন তাজউদ্দীনের বদলে খন্দকার মোশতাককে বঙ্গবন্ধু ‘প্রেফার’ করেছিলেন— সেই নিয়ে আলোচনাটা এখন বেশি জমজমাট। আর এই আলোচনা জমজমাট হয়ে ওঠার পেছনে যে বিষয়টি ভূমিকা রেখেছে, তা হলো তাজউদ্দীনের বদলে মোশাতককে বঙ্গবন্ধুর ‘প্রেফার করা’র বিতর্কিত তত্ত্ব ও তথ্য। আমাদের খেয়াল করে দেখতে হবে, এগুলো কারা, কখন, কিভাবে শুরু করেছিলেন?
মজার বিষয়— বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার অবিসম্বাদিত ডান হাত মরহুম তাজউদ্দীন আহমদের কিছু ক্ষেত্রে প্রামাণিক মতবিরোধ ছিল। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে মতবিরোধ থাকা খুব স্বাভাবিক। ভিন্নমতের লোকদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু সবসময় একসঙ্গেই পথ হেঁটেছেন। নইলে এক দলে চার খলিফা, কাপালিক খান, আবার তাজউদ্দীন এবং খন্দকার মোশতাক— সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে ছিলেন কী করে!
কিন্ত এই মতবিরোধে বঙ্গবন্ধু থেকে তাজউদ্দীন কতটা দূরে সরে গিয়েছিলেন, আর কতটা বঙ্গবন্ধু তাকে ঠেলে দূরে সরিয়েছিলেন, তার সত্যানুসন্ধান হয়নি খুব একটা। না হওয়ার কারণও ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে। বিভিন্নভাবে প্রচারের চেষ্টা চলে— বঙ্গবন্ধুই চাননি তাজউদ্দীনকে কাছে রাখতে। তিনিই তাজউদ্দীনকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন। আরও নানা আলোচনা আছে। সব আলোচনার বটমলাইন— তাজউদ্দীনকে বঙ্গবন্ধু একতরফা ত্যাগ করেননি। কিন্তু এই আলোচনাতেও একটি ন্যারেটিভ প্রমাণের প্রাণান্ত চেষ্টা থাকে— বঙ্গবন্ধু (এবং সেই কারণেই আওয়ামী লীগ) ভিন্নমত সহ্য করেননি, সেকেন্ড ম্যান তৈরি হতে দেননি।
বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনায় আসি। ন্যারেটিভ অপরিবর্তিত থাকে। এ ক্ষেত্রে ন্যারেটিভ ২.১— বাপের মতো ‘বেটি’ও তাজউদ্দীন পরিবারকে ‘অচ্ছুৎ’ করে রেখেছেন!
এখন আমাদের দেখতে হবে— কারা-কখন-কিভাবে এই তর্কগুলো শুরু করেছিল এবং এই তর্কগুলো বছরের পর বছর ধরে জিইয়ে রেখেছে।
শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আগে জোহরা তাজউদ্দীন-ই আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ছিলেন। যেকোনো কারণেই হোক, দলকে দাঁড় করানো তো দূরের কথা, দলে ঐক্যই আনতে পারেননি তিনি। মালেক উকিলের যে আওয়ামী লীগ ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়, সেটা আওয়ামী লীগের এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় ভয়াবহ রাজনৈতিক বিপর্যয়। মাত্র ৩৯ আসনে জিতে (ইলেকশন যেমনই হোক না কেন) আওয়ামী লীগ তখন প্রায় অস্তিত্বের সংকটের মুখে। অনেকেই জানেন না বা ভুলে গেছেন— জোহরা তাজউদ্দীন তখনো আওয়ামী লীগের লিডিং ফ্রন্ট এবং শেখ হাসিনার তখনো এন্ট্রি-ই হয়নি। আর ওই সময়ে কেবল সংসদে নয়, দল আওয়ামী লীগেও ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে। প্রবীণ রাজনীতিবিদ মিজানুর রহমান চৌধুরী (পরবর্তীতে এরশাদের প্রধানমন্ত্রী হন জাতীয় পার্টি থেকে) আওয়ামী লীগ ছেড়ে নতুন আওয়ামী লীগ গঠন করেন। আব্দুর রাজ্জাকদের মতো বাকশাল বিলুপ্ত করে আবার আওয়ামী লীগে ফিরে আসার ঘটনা এটি নয়। এসব কিছু ঘটেছে তখন, যখন জোহরা তাজউদ্দীন পার্টির ফ্রন্ট ফেস এবং শেখ পরিবার আওয়ামী লীগের হাল ধরেননি।
জোহরা তাজউদ্দীন মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতা ছিলেন। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে একাধিকবার শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে বা বিদেশ সফরের সময় দলের ভারপ্রাপ্ত সভানেত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন। তার কাছাকাছি সংখ্যায় ‘ভারপ্রাপ্ত’ হিসেবে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছেন কেবল সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। অন্য কেউ নয়। এগুলো ২০০৮ সালের আগেই ঘটেছে, প্রাগৈতিহাসিক আমলের কথা নয়।
শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় তাজউদ্দীন পরিবারের সদস্যরা কখনোই কোনোভাবে উপেক্ষিত ছিলেন না। তার ভাই আফসারউদ্দিন আহমেদ হাসিনার প্রথম মন্ত্রিসভায় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। একটি অবৈধ বস্তি বুলডোজার দিয়ে উচ্ছেদের সময় তিনি রিপোর্টিং বস, অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রয়োজনীয় আলাপ না করার জন্য সমালোচিত হন। শেখ হাসিনা কেবল ‘তাজউদ্দীন কোটা’য় তাকে মন্ত্রী করেছিলেন বলেও মন্তব্য উঠে এসেছিল সেই সময় দৈনিক সংবাদে একজন স্বনামধন্য সাংবাদিকের লেখা কলামে। তারপরও তাজউদ্দীন পরিবারের প্রতি কোনো ধরনের বিরূপ প্রভাব দল আওয়ামী লীগ থেকে দেখা যায়নি অন্তত।
কিন্ত এতসব ঘটে যাওয়ার পরও শেখ হাসিনাকে তার জায়গায় দাঁড়িয়ে তাজউদ্দীন পরিবারকে ‘দূরে সরিয়ে রাখতে’ দেখা যায়নি। ‘কনস্ট্যান্ট রোটেশন থিওরি’তে বিশ্বাসী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদের আসনের ক্ষেত্রে তাজউদ্দীন পরিবারের কোনো বিকল্প ভেবেছেন— এমন লক্ষণও দেখা যায়নি কোনোদিন।
আজকের যে আলোচিত সোহেল তাজ, তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর পদে থেকে সোহেল তাজ কেমন ‘পারফর্ম’ করেছিলেন, সেই প্রশ্নটি উত্থাপন না করেই বলছি— অনেক গুঞ্জন-গুজবের পরও পরপর দুইটি কাউন্সিলে সজীব ওয়াজেদ জয় বা রাদওয়ান মুজিব ববিকে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা দেননি শেখ হাসিনা। সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকেও রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট হতে দেখা যায়নি। কিন্তু সোহেল তাজ বা নওফেল শুধু রাজনীতিতেই আসেননি, ঠাঁই পেয়েছেন মন্ত্রিসভাতেও। অন্যান্য জাতীয় তিন নেতার পরিবারের অনেকেই দলের প্রেসিডিয়াম সহ গুরুত্বপূর্ণ পদে এবং মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেয়েছেন। সবশেষ সৈয়দ আশরাফের বোনও সংসদ সদস্যের মর্যাদা পেয়েছেন। কাজেই তাজউদ্দীনসহ জাতীয় চার নেতাকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সাইড করা হচ্ছে— এই ন্যারেটিভ কারা, কখন, কিভাবে ছড়াচ্ছে— সেটি আমাদের বুঝতে হবে।
সোহেল তাজ প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থাতে নিজ পদ থেকে পদত্যাগ না করেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। তাকে ফিরিয়ে আনার বা বুঝিয়ে বলার চেষ্টাগুলো আমরা প্রকাশ্যে দেখেছি। দেশে ফেরার পর গণভবনে সোহেল তাজের কাঁধে হাত দিয়ে তোলা শেখ হাসিনার একটি ছবি বেশ ভাইরাল হয়। আমরা লিখেছিলাম— ‘আ হোপ রি কাইন্ডলড…… আবার আশার দ্বীপ জ্বেলেছে…….’। কিন্ত কোনো কিছুতেই কিছু হয়নি। সোহেল তাজ ফেরেননি। তার বোন সিমিন হোসেন রিমি এখনো গাজীপুরের ওই আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। অথচ ওই ন্যারেটিভ চলতেই থাকে— শেখ পরিবার তাজউদ্দীন পরিবারকে ‘সাইড’ করে ফেলেছেন। এমনকি ‘বঙ্গবন্ধুর মতোই শেখ হাসিনা ভিন্নমতকে সহ্য করেন না’— এমন বক্তব্যও প্রচার করা হয়।
আমাদের নিশ্চয়ই মনে থাকার কথা, নির্বাচনের আগেই সোহেল তাজ একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে সরকারের নির্বাচনি নীতিমালার কঠোর সমালোচনা করেন। পরে তিনি স্ট্যাটাসটি এডিট করেন। কিছু সময়ের জন্য ‘ওনলি মি’ও করে রাখেন। নির্বাচন নিয়ে সোহেল তাজের ভাবনা অপ্রাসঙ্গিক নয় এবং তিনি অবশ্যই সেখানে সরকারের নীতিমালা নিয়ে সমালোচনা করতেই পারেন। তার সমালোচনার ভাষাটি যেমনই হোক, সমালোচনার বেশকিছু জায়গা যৌক্তিক ছিল— তা নিয়ে বেশিরভাগ মানুষই দ্বিমত করবেন না। কিন্তু গোল বেঁধেছিল কিছু কথায়, যেখানে তিনি বেশ আক্রমণাত্মকভাবে শেখ হাসিনার সমালোচনা করেন। সমালোচনা খুবই স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনীয়। কিন্ত সমালোচনার জন্য যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ প্রয়োজন। সেটি না থাকলে সমালোচনা ব্যক্তিগত আক্রমণে রূপ নিতে পারে। আর প্রচ্ছন্ন দোষারোপ নিঃসন্দেহে তাজউদ্দীনের ছেলে হিসেবে সোহেল তাজের ব্যক্তিত্বকে খাটোও করে।
প্রশ্ন হচ্ছে, যদি বহুল প্রচারিত ন্যারেটিভটি সত্যই হয়ে থাকে, এতকিছুর পরও ‘ভিন্নমত’ এবং ‘তাজউদ্দীন পরিবারকে সহ্য করতে না পারা’ শেখ হাসিনার সংসদীয় দলে সিমিন হোসেন রিমি থাকেন কী করে? গত নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, যেকোনো আসনে যে কাউকেই শেখ হাসিনা মনোনয়ন দিতে পারতেন। কারণ রাজনীতির মাঠে তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। যদি ‘তাজউদ্দীন পরিবারকে রাজনীতি থেকে বিদায় করে দেওয়া’টাই লক্ষ্য হতো, এই নির্বাচন নিঃসন্দেহে ছিল সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের সেরা সুযোগ। তবে সেই সুযোগ শেখ হাসিনা কেন নিলেন না?
গত তিন-চার দিন ধরে এই ‘ন্যারেটিভ’ আর এই ‘বিতর্ক’ ফের সামনে এসেছে। এই লেখার প্রথমেই যে ‘লিগ্যাসি’র কথা বলছিলাম, সেই লিগ্যাসি নিয়ে কিছু প্রশ্নও সামনে এসেছে।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার অফিসে কাজ করেন— এমন একজন তার ব্যক্তিগত মতামত হিসেবে নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, তাজউদ্দীন আহমদের প্রশংসা করতে গিয়ে মাঝে মাঝে এমন সব রেফারেন্স চলে আসে যাতে করে তাজউদ্দীন আহমদ ও বঙ্গবন্ধু দু’জনকেই ছোট করা হয়।
খুব নির্মোহ আলোচনায় গেলে, এতক্ষণ যেসব আলাপ-আলোচনা হলো এবং যে ন্যারেটিভ নিয়ে কথা হলো, তাতে এই স্ট্যাটাসটির বক্তব্য উড়িয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বরং এটি নিয়ে আলোচনা হতেই পারত। আলোচনাই হওয়ার কথা ছিল। সামনাসামনি ‘বোল্ড’ ও ‘ওপেন’ আলোচনা কিংবা প্রয়োজনে বিতর্ক হতে পারত, যে আলোচনা বা বিতর্কে বছরের পর বছর ধরে চলা ন্যারেটিভের অস্পষ্ট অংশগুলো পরিষ্কার হয়ে যেতে পারত।
কিন্তু ওই স্ট্যাটাসের জবাব দিতে গিয়ে সোহেল তাজ প্রথমেই যে কাজটি করলেন— নিজের ভেরিফায়েড পেজ থেকে তিনি এক লাইনের খুব তীর্যক মন্তব্য দিয়ে স্ট্যাটাসটিকে খারিজ করে দিলেন, কোনো ধরনের কোনো যৌক্তিক আলোচনায় না গিয়েই।
পরবর্তী ঘটনা আরও দুঃখজনক। তিনি এবার পরিবারের পক্ষ থেকে ফেসবুক লাইভে এসে বললেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মরত ওই ব্যক্তির স্ট্যাটাসে যেভাবে বলা হয়েছে তাজউদ্দীন আহমদের প্রশংসা করা মানেই বঙ্গবন্ধুকে কটাক্ষ করা, উনি এর তীব্র নিন্দা জানান। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কেও বলা হয়েছে, যেন আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে এটা স্পষ্ট করা হয় যে এই বক্তব্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মকরত ওই ব্যক্তির ব্যক্তিগত নাকি এতে প্রতিষ্ঠানেরও সায় আছে।
ব্যাপার হলো— সোহেল তাজ যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে স্পষ্ট করতে বলেছেন, একইভাবে তিনি কি স্পষ্ট করে বলবেন একটু যে তার যে বক্তব্য তিনি তাজউদ্দীন আহমদ আর জোহরা তাজউদ্দীনের নামে দিয়েছেন, সেটা তারা এন্ডোর্স করেন কি না? তিনি কি একটু বলবেন, গত প্রায় দুই দশক ধরে তাজউদ্দীন আহমদের ব্র্যান্ড বিল্ডিং ইমেজের ছায়ার তলে বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনাকে জাতীয় চার নেতার লিগ্যসিকে ‘সাইড করা’র প্রচ্ছন্ন/প্রত্যক্ষ অভিযোগ আসছে, সেগুলো তাজউদ্দীন আহমদ আর জোহরা তাজউদ্দীন এন্ডোর্স করেন কি না?
তিনি কি স্পষ্ট করবেন তার বড় বোন ‘নেতা ও পিতা’ বইতে বিভিন্ন বয়ানে ‘বঙ্গবন্ধু ছিলেন আসলে জাতীয় চার নেতার একটা সাকসেসফুল প্রজেক্ট’ বলে যে ন্যারেটিভ জন্ম দিয়েছেন, সেটি প্রসঙ্গে বেঁচে থাকা তাজউদ্দীন একই মত পোষণ করতেন কি না? তিনি কি বলবেন, তার আরেক বোন, আওয়ামী লীগের সিটিং এমপি সিমিন হোসেন রিমির সম্পাদিত বইয়ে সারওয়ার মুর্শিদ বা অন্যান্যের বরাতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের যে ছবি আঁকা হয়েছে, বেঁচে থাকা তাজউদ্দীনও কি এগুলোর সঙ্গে একমত পোষণ করতেন?
ব্যাপারগুলো যদি এরকমই হয়ে থাকে, তাহলে জোহরা তাজউদ্দীন তো আরও দীর্ঘদিন বেঁচে ছিলেন। তিনি এগুলো নিয়ে মুখ খুললেন না কেন? বা কোনো জায়গায় এগুলো ডক্যুমেন্টেড রাখলেন না কেন? তার ছেলেমেয়েরা যে বিষয়গুলো তার স্বামী আর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে জানেন, সেগুলো তার তো আরও ভালো করে জানার কথা। তবে তিনি কথা বললেন না কেন?
সোহেল তাজের কাছে এই উত্তর কি আছে যে তার বড় বোনের পুরো বইটি আর মেজ বোনের সম্পাদিত কিছু বইয়ের কিছু অংশ জামায়াতিদের ওয়েবসাইট কেন প্রথম দিন থেকেই আপলোড করে রেখেছে? প্রায় সব ঘটনাই তো পঁচাত্তরের আগের। এসব নিয়ে বই এতদিন পরে কেন? আর বই বের না হলেও এসব কিছু জেনেও কেন তিনি ও তার বোন আওয়ামী লীগের রাজনীতির বাইরে অন্য কোনো কিছুতে ইন্টারেস্টেড ছিলেন না?
সোহেল তাজকে এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। তার লাইভটি স্ট্যাটাস আকারে ফেসবুকে এখনো আছে। সেখানে খুব সুস্পষ্ট করে বলা আছে—
‘উল্লেখ্য যে, আমাদের জানামতে, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত যেসব আলাপ-আলোচনা ও লেখালেখি হয়েছে, সেখানে জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কোনো ধরনের কটূক্তি দৃশ্যমান হয়নি।
বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির জনক, তিনি জাতির পিতা— এ নিয়ে কোনো সন্দেহ বা বিতর্ক থাকতে পারে না। অবকাশ নেই। বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু অবিচ্ছেদ্য। যতদিন পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি ও জাতির পিতা হিসেবে স্বর্ণোজ্জ্বল আলোয় তিনি আলোকিত থাকবেন।’
সোহেল তাজ কি বলবেন, তাহলে পরিবারের পক্ষে দেওয়া এই ফেসবুক বিবৃতি কি ‘নেতা ও পিতা’ বইটিকে পুরো খারিজ করে দিচ্ছে? যদি তা না হয়, তাহলে এই যে ‘বঙ্গবন্ধু বনাম তাজউদ্দীন বিতর্ক’, সেখানে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরাও কি ‘ইফেক্টিভ কন্ট্রিবিউট’ করেননি বা এখনো করে চলেছেন না? তাও সেটা বঙ্গবন্ধুর দলের আশ্রয়ে থেকেই?
তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে আমাদের মাঝে কোনো অস্পষ্টতা নেই। তার সম্পর্কে জানার জন্য তার পরিবারের বয়ানেরও প্রয়োজন নেই, ঠিক যেভাবে বঙ্গবন্ধুকে প্রমাণে শেখ হাসিনা বা শেখ রেহানার বই লিখে প্রমাণের কিছু নেই। তাজউদ্দীন আর বাংলাদেশ এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, ঠিক বঙ্গবন্ধুর মতোই। সব ধরনের ভিন্নমত নিয়েই তারা ‘বেস্ট পার্টনার’।
কিন্তু সমস্যা হলো সেই লিগ্যাসি নিয়ে, যেখান থেকে এই লেখাটা শুরু। তাজউদ্দীন আহমদ আমাদের মাঝে নেই। চলে গেছেন জোহরা তাজউদ্দীনও। যেই লিগ্যাসি তারা রেখে গেলেন, তারা ঠিক রাস্তায় আছেন তো? ইতিহাস বিকৃতির দায়কে ভুল বুঝে নিজেদের ঘাড়ে নিয়ে, নিজেদের বক্তব্য দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের সুযোগ করে দিয়ে, ভিন্নমতাবলম্বীদের নিজের ফেসবুক পেজে অকথ্য রেসিস্ট গালাগাল করে কোন দিকে যাচ্ছে তাজউদ্দীনের ব্লাড লাইন? তারাই কি তাজউদ্দীন জুনিয়র?
শেখ হাসিনা ২০০৫ সালের জেলহত্যা দিবসের স্মরণে অনুষ্ঠিত সভার প্রধান অতিথির ভাষণে বলেছিলেন, ‘যত দিন বেঁচে আছি, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জাতীয় চার নেতার সকল শিক্ষা বাস্তবায়ন করব। চার নেতার পরিবার আমারও পরিবার।’
একটা সময় শেখ হাসিনাও থাকবেন না। চার নেতার লিগ্যাসির কী হবে?
লেখক: ম্যানেজিং এডিটর, সারাবাংলা ডটনেট