শেখ আবু নেহাল : সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, দূরদর্শিতা এবং অভিজ্ঞতা যথেষ্ট থাকা সত্তেও স্থানীয় জামায়াত -শিবিব চক্র এবং বিভিন্ন গোষ্টী উপগোষ্টী ও আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের চাদাবাজী, মাদক পাচারকারী চক্র, বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্টির উপদ্রপ এবং নানা সংকটে দিনের পর দিন কমেছে চট্টগ্রামের ট্যানারি। স্বাধীনতা পরবর্তীতে চট্টগ্রামে ২২টি ট্যানারি থাকলেও বর্তমানে তা নেমে এসেছে মাত্র দুইটিতে। তাও একটি কোনোরকমে চলছে ধুঁকে ধুঁকে। গত প্রায় ত্রিশ বছরে চট্টগ্রামে ট্যানারিখাতে নতুন কোনো কারখানা গড়ে ওঠেনি, হয়নি বড় কোন বিনিয়োগও। বিভিন্ন ধরনের শিল্প কারখানা স্থাপিত হলেও ট্যানারি শিল্প না হওয়ায় ঐতিহ্যবাহী চামড়াখাতে বেহাল দশা তৈরি হয়েছে। অপরদিকে প্রায় সব ট্যানারিই ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় চট্টগ্রামের এই খাতের ব্যবসায়ীদের ফি বছরই জিম্মি হওয়ার ঘটনা ঘটছে।
ট্যানারি শিল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, পাট, চা এবং চামড়া দেশের রপ্তানি পণ্যের শীর্ষ তালিকায় ছিল বহু বছর ধরে।
চামড়া শিল্পে চট্টগ্রামের ভূমিকা ছিল বেশ গৌরবোজ্জ্বল। ব্যক্তিগত ভাবে অনেক বিদেশীরা কাচাচামড়ার সহজলভ্যতার ও অল্পমূল্যে শ্রমিক পাওয়ায় আশাবাদী হয়ে বহু ব্যবসায়ী চট্টগ্রামে ট্যানারি শিল্প গড়ে তুলেছিলেন। তারা এখানে সস্তা শ্রমসহ নানা সুবিধা নিয়ে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রপ্তানি করতেন। অনেক বিদেশী ব্যবসায়ীরা বংশপরম্পরায় এখানে ট্যানারি শিল্পের সাথে জড়িত থেকে ব্যবসা করতেন। ট্যানারি শিল্পের প্রায় পুরো নিয়ন্ত্রণই ছিল তাদের হাতে। ওই সময় চট্টগ্রামে বাঙ্গালীদের মালিকানাধীন শুধুমাত্র একটি ট্যানারি ছিল। মন্টি ট্যানারি (পরবর্তীতে এইচআরসি) নামের এই ট্যানারিটিও শেষ পর্যন্ত টিকে থাকেনি আন্তজার্তিক চক্রতের কারণে। স্বাধীনতার পরে অবাঙ্গালী, মারোয়ারী ও বিহারী ব্যবসায়ীরা চলে যায় এবং যাবার আগে পাকহানাদার বাহিনীর সহযোগিতায় স্থানীয় রাজাকার আলবদর ও আলশামস বাহিনী মিলে সবগুলো ট্যানারীকে বিদ্ধস্ত ও ধংসস্তুপে পরিনত করে গেলে পুরো শিল্পখাতটি বিনষ্ট হয়ে যায়।ঔ অবস্থায় যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশটির তদানিন্তন বঙ্গবন্ধুর সরকারের কাছে চলে যায়। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে বাংলাদেশের বহু ব্যবসায়ী ট্যানারিগুলো কিনে নিয়ে চালানোর উদ্যোগ নেন। এই সময় নতুন নতুন বেশ কিছু ট্যানারিও গড়ে ওঠে। চট্টগ্রামের হিলটন লেদার ছিল বাংলাদেশের প্রথম সর্বাধুনিক একটি ট্যানারি। এরই ধারাবাহিকতায় ওরিয়েন্ট ট্যানারি, মেঘনা ট্যানারি, জামান রহমান ট্যানারি, জুবিলি ট্যানারি, সিকো লেদার, চিটাগাং লেদার, কর্ণফুলী লেদার, মদিনা ট্যানারি, মেট্রোপলিটন লেদার, রিফ লেদারসহ ২২টি ট্যানারি গড়ে ওঠে চট্টগ্রামে। এরমধ্যে চট্টগ্রাম থেকে ব্যবসা গুটিয়ে মেট্রোপলিটন লেদার ঢাকায় চলে যায়। বাকিগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র রিফ লেদার পুরোদমে চলছে। মদিনা ট্যানারি চলছে আংশিক। অন্যান্য ট্যানারিগুলো পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছরে সোনার বাংলার গড়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছনোর প্রাক্কালে ঠিক তখনই দেশীয় মিরজাফরদের সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক চক্র পচাত্তরের পনের আগষ্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে এই বাংলাকে পাকিস্তানের কলোনী বানিয়ে ফেলে। দেশরত্ন শেখ হাসিনা এসে দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের পর নব্বইতে তদানিন্তন স্বৈরচারী সরকারকে উৎখাতের মাধ্যমে আবার দেশে গণতান্তিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রামে ট্যানারি খাতে সর্বশেষ বিনিয়োগ করা হয় ১৯৯১ সালে। কালুরঘাট শিল্প এলাকায় গড়ে ওঠা রিফ লেদার নামের ওই ট্যানারিই বর্তমানে চট্টগ্রামে সর্বাঙ্গিক সফল একমাত্র ট্যানারি বলেও সূত্র মন্তব্য করেছে।
চট্টগ্রামে কোরবানিতে প্রায় ছয় লাখ গরুসহ আট লাখের মতো চামড়া হয়ে থাকে। এর বাইরে কক্সবাজারসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে এই সংখ্যা বিশ লাখেরও বেশি। এছাড়া পুরো বছরে চট্টগ্রামে আরো অন্তত বিশ লাখ চামড়া পাওয়া যায়। বৃহত্তর চট্টগ্রামে বছরজুড়ে পাওয়া গরু মহিষ এবং ছাগলের অন্তত চল্লিশ লাখ চামড়ার উপর অনায়াসে চল্লিশটি কারখানা চালু রাখা সম্ভব। কিন্তু চট্টগ্রামে দিনে দিনে সব কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই চট্টগ্রামের হাটবাজার থেকে চামড়া সংগৃহীত হলেও গত ত্রিশ বছরে এই খাতে কোন শিল্প বৃহত্তম চট্টগ্রমে গড়ে ওঠেনি।
চট্টগ্রামে ট্যানারি শিল্পের দুরবস্থায় এখানে সংগৃহীত চামড়ার বাজারটি পুরোপুরি ঢাকা নির্ভর হয়ে রয়েছে। ঢাকার ট্যানারি মালিকেরা এক দুই বছরের বাকিতে চট্টগ্রামের আড়তদারদের কাছ থেকে চামড়া কিনেন। এই চামড়া বাকিতে বিক্রি করা ছাড়া আড়তদারদের আর কোনো উপায় থাকে না মর্মে ভৃক্তভূগিদের দাবী। এক বছরের চামড়ার দাম পরবর্তী বছরেও না পাওয়ার ঘটনা পুরো ব্যবসাটির জৌলুস হারিয়েছে।
চট্টগ্রামের কাঁচা চামড়া আড়তদার সমিতির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ মুসলিমউদ্দিন দৈনিক নিখাদ খবরের বিশেষ প্রতিনিধিকে বলেন, চট্টগ্রামের ১১২জন আড়তদার রয়েছেন। যাদের অন্তত চল্লিশ কোটি টাকা বহুদিন ধরে ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে আটকা পড়ে রয়েছে। এই বছর কিছু টাকা পরিশোধ করলে আবারো বাকিতে চামড়া দিতে হয়। এতে আটকা পড়া টাকার পরিমাণ আরো বেড়ে যায়। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে যদি আরও কয়েকটি ট্যানারি থাকত তাহলে এই ধরনের দুরবস্থার মুখে পড়তে হত না। চামড়া নিয়ে এমন বেহাল অবস্থা অব্যাহত থাকলে এই খাতের ভবিষ্যত বড় অন্ধকার বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
চট্টগ্রামে চামড়া শিল্পের সাথে জড়িত ব্যবসায়ীরা বলেছেন, দিনে দিনে ২০টি ট্যানারি বন্ধ হয়ে গেছে। আরো একটি যায় যায় করছে। অত্যন্ত মারাত্মক এই অবস্থা তৈরি হয়েছে শুধুমাত্র অভিজ্ঞতা এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে। তারা বলেন, ট্যানারি এমন একটি ব্যবসা যেটি শুধু পুঁজি বিনিয়োগ করেই করা যায় না। কারখানার প্রতিটি ধাপের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে হয়। প্রতিটি কাজেই চোখ রাখতে হয়। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের অভিজ্ঞতা না থাকায় এই কাজটি করতে পারেননি। অপরদিকে চামড়া বাজারজাতকরণের জন্য মার্কেটিং বিভাগের গুরুত্ব অপরিসীম। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা এই খাতেও সফলতা দেখাতে পারেননি। সংশ্লিষ্ট একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সব সরকারের আমলেই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার বড় অভাব ছিল। চট্টগ্রামের ট্যানারি মালিকদের ঋণসুবিধাসহ নানা ক্ষেত্রে বিমাতাসুলভ আচরণের শিকার হতে হয়েছিল আনেক ক্ষেত্রে। এতে করে অনেক সম্ভাবনা থাকলেও চট্টগ্রামের ট্যানারি শিল্পের বিকাশ ঘটেনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন ব্যবসায়ী বলেন,ঔসব বন্ধ হওয়া ট্যানারী এখন তলা ভাঙ্গা ঝুড়ির মত। সরকার কেন বিশ্ব ব্যাংক ও যদি সুদ ছাড়া লোনও দেয়, তবুও এগুলো আর জীবিত হবেনা। শুধু কিছুদিনের জন্য তাজা হবে ট্যানারীর মালিকরা।
তাছাড়া, ভিন্নমত পোষণকারী অন্য আরেকজন বলেন যে,সরকারী পৃষ্টপোষকতার ব্যাপারে চট্টগ্রামের ট্যানারি শিল্পের বিশেষজ্ঞ রিফ লেদারের পরিচালক (অপারেশনস এন্ড মার্কেটিং) মুখলেসুর রহমান দৈনিক নিখাদ খবরের বিশেষ প্রতিনিধিকে বলেন, চামড়া শিল্পটি আসলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সেক্টর। অথচ সেক্টরটি সেভাবে গুরুত্ব পায়নি।
সত্তর দশকের মাঝামাঝি ও আশির দশক থেকে চামড়া শিল্পে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার হতে শুরু করে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, একই সাথে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনা এবং মার্কেটিংয়ে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। চট্টগ্রামের ট্যানারিগুলোতে ওই সময় উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার হয়নি। এতে করে প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজার থেকে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা ছিটকে পড়েন। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবের কথাও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, কাঁচা চামড়া কেনা থেকে ফিনিশিং পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই অভিজ্ঞতা একটি বড় ফ্যাক্টর এই সেক্টরে। কোথাও অভিজ্ঞতার ঘাটতি পড়লেই সেখানেই ধস নামবে। আর এই ধস ঠেকিয়ে ব্যবসাটিতে সফল হওয়া খুবই কঠিন বলেও মুখলেসুর রহমান মন্তব্য করেন। যথাযথ অভিজ্ঞতা এবং বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে আসার মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তিতে ট্যানারি গড়ে তোলা সম্ভব হলে এই শিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
অপর একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চট্টগ্রামে যে পরিমাণ কাঁচা চামড়া হয় তাতে খুবই স্বাচ্ছন্দ্যে চল্লিশটি ট্যানারি চলতে পারে। অথচ এখানে পুরোদমে একটি এবং অপরটি আংশিক চলছে। একটি অত্যাধুনিক ট্যানারি বছরে সর্বোচ্চ এক লাখের মতো চামড়া প্রসেস করতে পারে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।