বাংলাদেশে রাইড শেয়ারিং সার্ভিস পাঠাও এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহকে হত্যার রহস্য এখনো উদঘাটন হয়নি। হ্যাসপিল নামে ফাহিমের এক সহকারীকে গ্রেফতার করা হলেও তিনি এখনো মুখ খোলেননি। মাত্র ৯০ হাজার ডলার চুরি করে ধরা পড়ার কারণে ফাহিমের মতো একজন স্বপ্নবাজ মানুষকে হ্যাসপিল এভাবে হত্যা করতে পারে এটা অনেকের বিশ্বাস হচ্ছে না। ফলে এখন সন্দেহের তীর আন্ডার ওয়ার্ল্ড মাফিয়া গ্রুপের দিকে।
এ হত্যা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হ্যাসপিল নামে যাকে গ্রেফতার করা হয়েছে তিনি ছিলেন ফাহিমের সহকারী। তার কাছ থেকে ফাহিম ডলার পাওনা ছিল কিন্তু বিষয়টি ছিল আপসের। কারণ ৯০ হাজার ডলার চুরি করার পরও হ্যাপসিলকে সুযোগ দিয়েছিল ফাহিম। এক্ষেত্রে হ্যাসপিলের সঙ্গে ফাহিমের কোনো শত্রুতা থাকতে পারে না। হ্যাসপিলকে দিয়ে হত্যা করিয়েছে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের মাফিয়া কোনো গ্রুপ। এর পক্ষে দুটি যুক্তি তুলে ধরা যায়, প্রথমত-হত্যাকাণ্ডের ধরণ, দ্বিতীয়ত-ব্যবসায়িক লেনদেন।
হত্যাকাণ্ডের ধরণ:
ফাহিমকে হত্যার ধরণ বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দেয়। কাউকে হত্যা করতে চাইলে গুলি করে বা আঘাত করে হত্যা করা যায়। কিন্তু তা না করে খুনি ফাহিমকে ছুরিকাঘাতে হত্যার পর করাত দিয়ে কেটে টুকরা টুকরা করেন। ফাহিমের মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে টুকরো করা ছিল। কিছু টুকরো বড় আকারের গার্বেজ ব্যাগেও ভরে রাখা হয়েছিল। পাশেই পড়ে ছিল একটি বৈদ্যুতিক করাত, তখনও সেটির তার ছিল সকেটের সঙ্গে যুক্ত।
এখানে উল্লেখ্য যে, প্রথমদিন হত্যার পর দ্বিতীয়দিন ফাহিমের লাশ গুম করার জন্য খুনি দোকান থেকে করাত, ভেক্যুয়াম মেশিনসহ অন্যান্য সামগ্রী ক্রয় করে নিয়ে আসেন। কিন্তু ফাহিমের কাজিন চলে আসায় লাশটি আর সরাতে পারেনি খুনি। খুনি যদি ব্যক্তিগত কারণে খুন করত তাহলে খুনি দ্বিতীয়বার লাশ নেয়ার জন্য আসত না। এক্ষেত্রে এই খুনের পিছনে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের কোনো যোগসূত্র রয়েছে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞের।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হত্যাকণ্ডের ধরণ বলছে শুধু হত্যার জন্য নয়, মেসেজ দেয়ার চেষ্টা করেছে হত্যাকারীরা। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড কোনো স্বাভাবিক হত্যাকাণ্ড নয়। এর পিছনে রয়েছে কোনো লম্বা হাত। এ হত্যাকাণ্ড হতে পারে ব্যবসায়িক লেনদেন বা ফাহিমের উঠে আসাকে রুদ্ধ করার জন্য আন্ডার ওয়ার্ল্ডের যোগসূত্র।
ব্যবসায়িক লেনদেন:
বাংলাদেশ, নেপাল, মালয়েশিয়া, কলম্বিয়ায় ‘পাঠাও’ রাইড শেয়ারিং প্রথার প্রচলন ঘটিয়ে ২০১৮ সালে নাইজেরিয়ার রাজধানী লাসগোতে ফাহিম চালু করেছিলেন ‘গোকাডা’। অর্থাৎ উন্নয়নশীল বিশ্বের যুব সমাজের কর্মসংস্থানে সামগ্রিক উন্নয়নের আইকন হয়ে উঠছিলেন ফাহিম। তার এই উঠে আসাকে হয়ত সহ্য করতে পারেনি বিরোধীরা। এটিও হতে পারে তার মৃত্যুর কারণ।
আবার কেউ কেউ অভিমত পোষণ করেছেন, ফাহিমের মাধ্যমে শেয়ার রাইডিংয়ের দিগন্ত বিশ্বব্যাপী প্রসারিত হওয়ায় ট্যাক্সি শিল্পে অচলাবস্থার আতঙ্কে বিশেষ একটি মাফিয়া গ্রুপ এমন হত্যাযজ্ঞে হ্যাসপিলকে মদদ দিতে পারে।
এছাড়া ফাহিমকে হত্যার পেছনে নাইজেরিয়ার শত্রুদের সন্দেহ করা হচ্ছে। মৃত্যুর আগে ফাহিমের বিরুদ্ধে নিউ জার্সির এক কারাকর্মীর করা মামলা চলমান ছিল। ফাহিমের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে করা মামলায় ক্রিক ইডি নামে ওই ব্যক্তি প্রতারণার অভিযোগ আনেন।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বড় ধরনের কোনো ব্যবসায়িক লেনদেনের জেরেই ফাহিম সালেহকে হত্যা করা হয়েছে।
মা’মলার বিবরণে প্রকাশ, ৫ বছর আগে ১৬ বছর বয়সে হ্যাসপিলকে ব্যক্তিগত সহকারীর চাকরি দেন ফাহিম। ফাহিমের বিশাল এই ব্যবসার আয়-ব্যয়ের হিসাব এবং ব্যাংক পরিচালনার দায়িত্ব ছিল হ্যাসপিলের ও’পর। সে সুবাদে ফাহিমের একাউন্ট থেকে ৯০ হাজার ডলার চু’রি করেছে হ্যাসপিল। এ তথ্য জানার পর ফাহিম তাকে পুলিশে না দিয়ে চু’রিকৃত অর্থ কিস্তিতে ফেরৎ দেওয়ার সুযোগ দেন। এমনি অবস্থায়ই হ্যাসপিলের নৃ’শংসতার নিষ্ঠুর বলি হলেন ফাহিম।
পুলিশ জানায়, সোমবার দুপুরে ফাহিমকে ছু’রিকাঘাতে হ’ত্যার পর হ্যাসপিল ওই এপার্টমেন্ট ত্যাগ করে পরদিন করাত, ভেক্যুয়াম মেশিনসহ অন্যান্য সামগ্রী ক্রয় করে সেখানে ফেরে। স্যুটকেসে ভরার জন্যই সে ফাহিমের দেহকে টুকরা টুকরা করেছিল। সে পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়েছে ফাহিমের কাজিন চলে আসায়। পুরো একদিন ফাহিমের কোনও সাড়া না পেয়ে মঙ্গলবার ওই অ্যাপার্টমেন্টে গিয়েছিলেন তার বোন। ভেতরে ঢুকে তিনি ভ’য়ঙ্কর এক দৃশ্য দেখতে পান।
পুলিশ আরও জানায়, ব্রুকলিনের প্রসপেক্ট পার্ক এলাকার একটি ভবনের বাসিন্দা হ্যাসপিল বুধবার থেকেই ম্যানহাটনের ১৭২ ক্রসবি স্টিটে এয়ারবিএনবি এপার্টমেন্টে অবস্থান করছিল। সেটির ভাড়া পরিশোধ করা হচ্ছিল ক্রেডিট কার্ডে। সেই সূত্রেই তাকে পাকড়াও করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে ৩৩ বছর বয়সী ফাহিম সালেহের খণ্ড-বিখণ্ড লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঐ অ্যাপার্টমেন্টটি ফাহিম সালেহ’র মালিকানাধীন ছিল।
জানা যায়, সোমবার (১৩ জুলাই) দুপুর প্রায় পৌনে দুইটার দিকে লিফটে করে ফাহিমের পিছু নেয় মাস্ক পরা হাসপিল। লিফটটি ফাহিমের ফ্ল্যাটে পৌঁছানোর পর পরই তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয় এবং তার ঘাড়ে ছুরিকাঘাত করা হয়। এরপর মরদেহ অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে রেখে সেখান থেকে চলে যায় হ্যাসপিল। পরদিন গাড়ি ভাড়া করে ম্যানহাটনের একটি দোকানে যান হ্যাসপিল, যেখান থেকে তিনি অ্যাপার্টমেন্ট পরিষ্কার করার জিনিসপত্র কেনেন। এই সময় হ্যাসপিল ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে গাড়ি ভাড়া দেন।
মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) হ্যাসপিল ফাহিম সালেহের অ্যাপার্টমেন্টে যান হত্যার আলামত মুছে ফেলার উদ্দেশ্যে। মঙ্গলবার দুপুরে ফাহিম সালেহের বোন যখন অ্যাপার্টমেন্টে যাচ্ছিলেন তখন হত্যাকারী মরদেহ টুকরো টুকরো করছিলেন। ফাহিম সালেহের বোন উপরে উঠে আসার আগে পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যান। ফাহিমের মরদেহ টুকরো করা শেষে সেগুলো ব্যাগে ভরে ফেলার পরিকল্পনা ছিল হ্যাসপিলের। তবে তার আগেই ফাহিমের খালাতো বোন এসে কলিংবেল চাপতে থাকলে ভয়ে সিঁড়ি দিয়ে পালিয়ে যায় সে।
এদিকে ফাহিম সালেহকে নিউইয়র্কে দাফন করা হয়েছে। স্থানীয় সময় গত রোববার দুপুরে (বাংলাদেশ সময় সোমবার) জানাজা শেষে নিউইয়র্ক শহরের উপকণ্ঠে অরেঞ্জ কাউন্টির প্রাচীন কবরস্থান পোকেসপি রূরাল সেমেট্রিতে তাকে দাফন করা হয়। জানাজা নামাজে ইামামতি করেন ওয়াপিংগার ফলসের আল নূর মসজিদের ইমাম ওসমানী। তবে এতে সাংবাদিকদের উপস্থিত থাকার অনুমতি দেওয়া হয়নি। দেশটির আইনশৃখংলা বাহিনী ও গোয়েন্দা বিভাগ থেকে নিহত ফাহিমের পরিবারকে মিডিয়ার সঙ্গে কথা না বলারও উপদেশ দেয়া হয়েছে। এ জন্য ফাহিম সালেহর জানাজা ও সমাহিত করার আয়োজনে সাংবাদিকদের উপস্থিত থাকতে দেওয়া হয়নি।
নিহত ফাহিম সালেহ ২০১৫ সালে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করেন রাইড শেয়ারিং অ্যাপ ‘পাঠাও’। এই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় পরে নাইজেরিয়ায় চালু করেন রাইড শেয়ারিং অ্যাপ ‘গোকাডা’। সরকার সেটি বন্ধ করে দিলে চালু করেন পার্সেল সার্ভিস। সেটিও জনপ্রিয়তা পায় দেশটিতে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ও কলম্বিয়ায় আরো একাধিক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত টেক জায়ান্ট ফাহিম সালেহ।