গত চার দশক ধরে বাঙালি জাতির গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। দলের দায়িত্ব গ্রহণ, নেতৃত্বদান, ক্ষমতায় আরোহণ এবং দেশ সেবার বন্ধুর পথ অতিক্রম করে আজ তিনি নন্দিত প্রধানমন্ত্রী। গণতন্ত্রকামী জনগণের পক্ষে কথা বলার অপরাধে তাকে বিভিন্ন সময়ে গৃহে অন্তরীণ, গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া গত ৪০ বছরে তাকে অন্তত ২১ বার হত্যা ও প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে দীর্ঘ সময় কারাজীবন ভোগ করতে হয় ওয়ান ইলেভেন-পরবর্তী সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই গ্রেপ্তার হয়ে ৩৩১ দিন শেরেবাংলা নগর সাবজেলে বন্দি থাকেন তিনি। বন্দিদশার প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত বঙ্গবন্ধুকন্যার জন্য ছিল বিভীষিকাময়। দেশকে বিরাজনীতিকরণের হীন উদ্দেশ্যেই সেদিন শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে দেশকে নেতৃত্বহীন করা হয়েছিল। জেনারেল জিয়ার শাসনামলেই দেশকে অরাজনীতি করণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। পরবর্তী সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ ও গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে স্বৈরাচারী শাসকরা এ প্রক্রিয়াকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান। দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের ওপর চরম আঘাত আসে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের ঘটনায়। শুধু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছেই নয়, ১৬ জুলাই শেখ হাসিনার কারাবরণ দিবস জাতীয় জীবনের আজ এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দেশের গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে জননেত্রী শেখ হাসিনার সাহসী ভূমিকা আজও আমাদের প্রেরণা জোগায়।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হতে পারেন- এ রকম একটি আশঙ্কা দেশবাসী আগে থেকেই করছিল। অবশেষে আশঙ্কা সত্যে পরিণত হয়। ১৬ জুলাই ২০০৭ সালে সোমবার ভোর ৬টায় শ্রাবণের প্রবল বর্ষণের মধ্যে সুধা সদনে প্রবেশ করে যৌথবাহিনী। সকাল ৭টা ৩২ মিনিটে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করে সুধা সদন থেকে বের করে নিয়ে আসে। সুধা সদনের বাইরে দুই সহস্রাধিক বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য ঘিরে রাখে। বঙ্গবন্ধুকন্যা এর মধ্যে ফজরের নামাজ আদায় করেন। সাদা শাড়ি পরিহিত বঙ্গবন্ধুকন্যা সেনাবাহিনীর কাছে জানতে চান, কেন তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে? দেশে কি সামরিক শাসন জারি হয়েছে? তেমন কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি যৌথ বাহিনী। শেখ হাসিনার মতো একজন মর্যাদাসম্পন্ন জাতীয় নেত্রীকে গ্রেপ্তার করা থেকে জেল হাজতে প্রেরণ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যৌথ বাহিনী কোনো সংযমের পরিচয় দেয়নি। সিএমএম গেটে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা সরকারের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে সাহসী ভাষায় ৩৬ মিনিট বক্তব্য রাখেন। অবশ্য তিনি গ্রেপ্তারের পূর্বমুহূর্তে দেশবাসীর উদ্দেশে একটি চিঠি লিখে যান। দেশ-জাতির সংকট মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুকন্যার ওই চিঠি গণতন্ত্রকামী মানুষের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করে। উজ্জীবিত হন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। সমসাময়িক কালের রাজনীতির ইতিহাসে শেখ হাসিনার সেদিনের চিঠি একটি ঐতিহাসিক দলিল। চিঠিতে শেখ হাসিনা দেশবাসীর প্রতি তার আস্থার কথা যেমন ব্যক্ত করেন, তেমনি গণতন্ত্রের ওই দুঃসময়ে নেতাকর্মীদের কী করণীয় তাও উল্লেখ করেন।
আজ বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে সেদিনের ষড়যন্ত্রের রাজনীতি বুঝতে হলে ১৬ জুলাইয়ের পূর্বাপর ঘটনা বিশ্নেষণের প্রয়োজন রয়েছে। ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়াসহ অর্থনীতি এবং সামাজিক ক্ষেত্রে যুগান্তকারী সাফল্য অর্জন করে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যে বাংলাদেশকে অমিত সম্ভাবনার দেশ হিসেবে বিশ্বসভায় পরিচিত করেছিলেন, খালেদা জিয়া সেই বাংলাদেশকে দুর্নীতি, দুঃশাসন ও দুর্বৃত্তায়নের দেশে পরিণত করেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট চারদলীয় সরকারের মদদে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত গ্রেনেড হামলায় নারী নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ নেতাকর্মী নিহত হন। আওয়ামী লীগের ২১ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়। হাওয়া ভবনকে রাষ্ট্রক্ষমতার সমান্তরাল কেন্দ্রে পরিণত করা হয়। সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে আজ্ঞাবহ করা হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য তাদের নীলনকশা অনুযায়ী দলীয় রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিনকে প্রধান উপদেষ্টা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে। ড. ইয়াজউদ্দিনের পুতুল তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিএনপি-জামায়াতের নির্দেশনা মানতে গিয়ে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের সব সম্ভাবনা নস্যাৎ করে। এরপর গণআন্দোলনে নীলনকশার নির্বাচন প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়। ড. ফখরুদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে এদেশের মানুষ প্রথম দিকে সমর্থন জানিয়েছিল। একপর্যায়ে যখন রাজনৈতিক নেতাদের গণহারে গ্রেপ্তার করাসহ নিজেদের এখতিয়ার-বহির্ভূত রাষ্ট্রের অন্যান্য বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা হয়, তখন তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষ ভিন্ন বার্তার আভাস পায়।
সরকারের পক্ষ থেকে এ সময় শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ নির্যাতনের শিকার হন। জরুরি আইনের জাঁতাকলে মানুষের অধিকার, বাক ও বিবেকের স্বাধীনতা যখন খর্ব হচ্ছিল, তখন বাঙালির সুখ-দুঃখ, আশা-ভরসার সর্বশেষ আশ্রয়স্থল শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান গ্রহণ করেন। এরই একপর্যায়ে শেখ হাসিনা অসুস্থ মেয়েকে দেখতে যুক্তরাষ্ট্রে যান। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে শেখ হাসিনার ওপর হুলিয়া জারি করা হয়। তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। সরকারের এই হীন চক্রান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে আলজাজিরা টেলিভিশনে এক আবেগঘন সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন ‘বাংলাদেশের মাটিতে আমার জন্ম ওই মাটিতেই আমার মৃত্যু হবে। প্রবল জনমত এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলে সরকার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। কোনো কিছু করেই যখন শেখ হাসিনাকে দমানো যাচ্ছিল না, তখন তাকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য শুরু হয় নতুন ষড়যন্ত্র। এর অংশ হিসেবেই গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। প্রায় এক বছর কারাবরণের পর জনগণের মাঝে ফিরে আসেন শেখ হাসিনা। ২০০৮ সাল থেকে পর পর তিনবার জনগণের সমর্থনে সরকার পরিচালনা করে দেশকে নিয়ে গেছেন উন্নয়নের মহাসড়কে।
আজ আমরা এক মহাদুর্যোগকালে দিনাতিপাত করছি। করোনাকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাহসের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। জীবন-জীবিকার সমন্বয় করে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন। দুর্যোগ- দুর্বিপাকে বাঙালির ‘আস্থার বাতিঘর’ শেখ হাসিনা। ভয়কে জয় করার অমোঘ বাণী এখনও জাতি তার কাছ থেকেই শুনতে পায়।
লেখকঃ সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
সৌজন্যেঃ দৈনিক সমকাল