ফ্রান্স থেকে চরফ্যাশনে এসে মা-বাবা’র কোলে মৃত্যু।
মিজান ফারহান , চরফ্যাশন (ভোলা)
ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার মো. ইব্রাহীম। স্বপ্ন ছিল উচ্চ শিক্ষা অর্জন শেষে বড় চাকরি করে দাঁড়াবেন পরিবারের পাশে। আর সেই আশায় ফ্রান্সে যাওয়া। ছেলের স্বপ্ন পূরণে পরিবারও বাধা দেয়নি। এনজিও এবং স্থানীয়দের কাছ থেকে প্রায় ৩০ লাখ টাকা ধার-দেনা করে ২০২২ সালে ইব্রাহীমকে ফ্রান্সে পাঠায় পরিবার। কিন্তু ফ্রান্সে যাওয়ার মাত্র সাত মাসের মাথায় তিনি আক্রান্ত হন মারণব্যাধি ক্যানসারে।
ফ্রান্সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিজ মাটিতে বাবা-মায়ের কোলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন। এমন ইচ্ছা থাকলেও তাকে দেশে নিয়ে আসার মতো ছিল না কেউ। তার এ ইচ্ছা পূরণে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তাকে দেশে নিয়ে আসেন ফ্রান্সের চিকিৎসক ড. ম্যাথিউ জামেলট।
ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার হাজারীগঞ্জ ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের হাজারীগঞ্জ গ্রামের হাওলাদার বাড়ির কাঞ্চন হাওলাদারের ছেলে মো. ইব্রাহীম।
তিনি জানান, অনেক স্বপ্ন নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য ফ্রান্সে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে বেশ কয়েক মাস ক্লাসও করেছেন। কিন্তু ফ্রান্সে যাওয়ার পাঁচ মাস পর তার পেটে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হলে তিনি ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খান। কিন্তু কিছুতেই কমছিল না ব্যথা। দুই মাসের মাথায় ধরা পড়ে তার লিভার ক্যানসার। এরপর তিনি ফ্রান্সের ড. ম্যাথিউ জামেলটের অধীনে প্রায় এক বছর চিকিৎসা নিয়েছেন। কিন্তু রোগ সারছিল না কিছুতেই। দিন দিন শরীরের অবনতি হতে থাকে। চিকিৎসকও হাল ছেড়ে দেন। একটা সময় সরাসরি তাকে বলে দেন তিনি আর বেশি দিন বাঁচবেন না। এমন অবস্থায় অসুস্থ হয়ে সারা দিন গ্রামের বাড়ি, বাবা-মা এবং আত্মীয়-স্বজনদের কথা ভাবতেন। এরপর তিনি চিকিৎসক ম্যাথিউ জামেলটকে বলেন, তিনি তার বাবা-মায়ের কোলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চান। কিন্তু ইচ্ছা করলেই তো আর হয় না। ফ্রান্স থেকে বাংলাদেশে তাকে নিয়ে আসার মতো ছিল না কেউ। এই পরিস্থিতিতে ইব্রাহীমের শেষ ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানিয়ে ম্যাথিউ জামেলটই এই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। প্রায় ৫ হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে গত ২০ ডিসেম্বর ইব্রাহীমকে বাংলাদেশে তার পরিবারের কাছে দিয়ে যান এই চিকিৎসক। ২২ ডিসেম্বর শুক্রবার তিনি গ্রামের বাড়ি হাজারীগঞ্জে আসেন।
ইব্রাহীমের সহপাঠী মামুন বলেন, ইব্রাহীম আমার সহপাঠী। আমরা ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই একসঙ্গে পড়াশোনা করেছি। ইব্রাহীম যখন উচ্চ শিক্ষার জন্য ফ্রান্সে যায় তখন আমরা বন্ধুরা সবাই অনেক খুশি হয়েছিলাম। ইব্রাহীমকে বিদায় দিতে আমরা প্রায় ২০ বন্ধু ঢাকা এয়ারপোর্টে গিয়েছিলাম। সে ফ্রান্সে থেকেও আমাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখত। কিন্তু প্রিয় বন্ধুর ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার খবরে আমাদের বন্ধুমহলে হতাশা নেমে এসেছে। ইব্রাহীম নিজ বাড়িতে ফেরার পর থেকে প্রতিদিনই তার সঙ্গে দেখা করি। তাকে সাহস দেই।
ইব্রাহীমের বাবা কাঞ্চন হাওলাদার বলেন, ছেলের ইচ্ছা পূরণে ধার-দেনা করে ফ্রান্সে পাঠাই। আশা ছিল ছেলে আমার বিদেশ গিয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ করে বড় চাকরি করে ধার-দেনা সব শোধ করবে। কিন্তু আমাদের সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। ইব্রাহীম আর বাঁচবে না। এই কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না। ধার-দেনা কীভাবে শোধ করব সেটাও জানি না। যদি ফ্রান্স ও বাংলাদেশ সরকার আমাদের পাশে দাঁড়ায় তাহলে আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারব।
ভোলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ইব্রাহীমের ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। পরিবারের পক্ষ থেকে চিকিৎসার জন্য আবেদন করলে আমরা সরকারিভাবে সব ধরনের সহযোগিতা করব।