মঞ্চে চরমপত্র রাজপথে রণেভঙ্গ -সরকার পতনে অভিলাষ পশ্চিমা অনুষঙ্গ: নজরুল ইসলাম

প্রচ্ছদ

মঞ্চে বিএনপি নেতারা হাঁক-ডাকে যতটা পারঙ্গম, রাজপথের আন্দোলনে ঠিক ততটাই ব্যর্থ। ২০১৩ সাল থেকেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে বারবার আল্টিমেটাম দিয়ে আসছে। অতীতে নির্দিষ্ট মাস, তারিখ এবং সময় বেঁধে দিয়ে সরকার পতনের আল্টিমেটাম দিয়েছে বারবার। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মানবতাবিরোধী মামলার প্রথম রায়ে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় এবং ২৮ শে ফেব্রুয়ারী মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে দেশব্যাপী জামায়াত-বিএনপির নজিরবিহীন তান্ডব, সহিংসতায় পুলিশসহ প্রায় ৫০ জনের প্রাণহানি ঘটে। দেশের বেশকিছু জেলায় রাস্তাঘাট কেটে ফেলা, গাছ কেটে রাস্তাঘাট অবরোধ করা, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িতে হামলা, দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করা ইত্যাদির মাধ্যমে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল।

কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায়ের প্রতিবাদে এবং ফাঁসির দাবিতে ঢাকার শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের টানা অবস্থান কর্মসূচির প্রতিবাদে ১৩ দফা দাবিতে সে বছরের ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলাম মহাসমাবেশের ডাক দেয়। তাদের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে বিএনপি-জামায়াতের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমর্থন ছিল। ৫ মে সন্ধ্যার আগে সমাবেশ শেষ হলে শর্তানুযায়ী সমাবেশস্থল ত্যাগ না করে লাখো হেফাজত নেতাকর্মী আইন লঙ্ঘন করে শাপলা চত্বরে অবস্থান গ্রহণ করে। সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বারবার অনুরোধ সত্বেও সমাবেশস্থল ত্যাগ না করে তারা সরকারের পতন ঘটাতে ঢাকা শহরে নাশকতা, অগ্নিসংযোগ এবং ব্যাপক তান্ডব চালায়। সেদিন বেগম খালেদা জিয়া বিএনপি এবং জোট নেতাকর্মীদের হেফাজতের পাশে থাকার আহবান জানান। তাদের ধারণা ছিল সেদিন রাতেই হয়ত সরকার পড়ে যাবে। সরকার কে ফেলে দিতে তারা হেফাজতের মত অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন কে ইন্ধন দিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে সরকার পতনের সুসংবাদ শোনার আকাশকুসুম স্বপ্ন নিয়ে তারা রাতে ঘুমাতে গিয়েছিল। তাদের সে স্বপ্ন সরকার রাতেই এমনভাবে চুরমার করে দিবে তা তাদের কল্পনাতেও ছিল না।

রাত ১২ টার কিছু পরে সরকারের নির্দেশে পুলিশ, র‍্যাব এবং বিজিবির সমন্বয়ে অভিযান শুরু হয়েছিল। সাউন্ড গ্রেনেড এবং ফাঁকা গুলির শব্দে আতংকিত অবস্থানকারীরা পালিয়ে গিয়েছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই শাপলা চত্বর ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। পুলিশের দাবী অনুসারে শাপলা চত্বরের সেদিনের অভিযানে মোট ১১ জন নিহত হয়। তবে হেফাজতে ইসলাম প্রাথমিকভাবে তাদের কয়েক’শ কর্মীর মৃত্যুর দাবী করে। বিএনপি-জামায়াত সহ বিরোধী দলের অনেকেই টিভি টকশোতে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হেফাজতের হাজার হাজার নেতাকর্মী নিহত হওয়ার বায়বীয় অভিযোগ উত্থাপন করে। পরবর্তীতে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার ঐ সহিংসতায় ৬১ জন নিহতের একটি তালিকা তৈরী করে। তবে সেই তালিকার পর সরকারের পক্ষ থেকে তার স্বপক্ষে তথ্য, প্রমাণ উপস্থাপন করতে বলা হলে তারা ব্যর্থ হয়। ফলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ঐ মামলায় সম্প্রতি আদালতের রায়ে অধিকার সম্পাদক সহ অভিযুক্তরা দন্ডিত হয়।

সে বছর ২৫শে অক্টোবরের পর থেকে, সংবিধান অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ শেষ ৯০ দিনে পৌঁছানোর পর থেকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের আন্দোলন জোরদার হয়। নভেম্বরের মাঝামাঝি গঠিত হয় নির্বাচনকালীন মন্ত্রীসভা। ২৫শে নভেম্বর ঘোষণা করা হয় নির্বাচনী তফসিল। ৫ই জানুয়ারী, ২০১৪ তারিখে নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হলে নির্বাচন প্রতিহত করতে শুরু হয় বিএনপি-জামায়াতের টানা হরতাল, অবরোধ। অবরোধকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক নাশকতা সংঘটিত হয়। যানবাহনে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। বাসে দেয়া আগুনে পুড়ে মারা যায় অন্তত ১০ জন। ব্যাহত হয় সারাদেশের রেল এবং সড়ক যোগাযোগ। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়কে ঘিরে যেমন একটি উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বছর শুরু হয়েছিল তেমনি বছর শেষেও উত্তাপ ছড়িয়েছিল ১২ই ডিসেম্বর তার ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার মধ্য দিয়ে।

৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করতে ভোট গ্রহণের আগের রাতেই সারাদেশে পাঁচশ’র মতো ভোটকেন্দ্রে হামলা এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছিল। এসব কিছু করেও তারা নির্বাচন বানচাল করতে ব্যর্থ হয়েছিল সরকার এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগের দৃঢ়তায়। বিএনপির সহিংস আন্দোলন জনমনে আবেদন সৃষ্টির পরিবর্তে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে। অবরোধের নামে নাশকতা, সহিংসতা করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট দেশ এবং দেশের বাইরে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। নির্বাচনের আগের দিন থেকে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়া পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক সহিংসতায় কমপক্ষে ১৯ জন নিহত এবং অনেক মানুষ আহত হন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের নির্বাচন বয়কট এবং দেশব্যাপী চরম রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতিও ছিল কম। নির্বাচন বানচালে ব্যর্থ হয়ে সরকার বিরোধী জোটের নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়ে। আন্দোলনে সক্রিয় বেশিরভাগ নেতাকর্মী আত্মগোপনে চলে যান। ফলে সরকার বিরোধী আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ে।

নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে জোরেসোরে পালনের সিদ্ধান নেয় বিএনপি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দিনটিকে ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ হিসেবে জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালন করার লক্ষ্যে কর্মসূচি ঘোষণা করে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ৩ জানুয়ারি রাতে গুলশান কার্যালয় থেকে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের উদ্দেশে রওনা দিলে কার্যালয়ের সামনে ১৩টি বালু ও মাটিভর্তি ট্রাক দিয়ে তার পথ রুদ্ধ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নয়াপল্টনের কার্যালয়ে গিয়ে সরকার পতনের লক্ষ্যে খালেদা জিয়া দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালাতে পারেন বলে গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তথ্য থাকায় এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

৫ জানুয়ারি বেগম জিয়া সেখান থেকে বেরিয়ে দলীয় কার্যালয়ের সামনে আহূত সমাবেশে যাওয়ার চেষ্টা করলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বাধায় যেতে পারেননি। বাধা পেয়ে ৬ জানুয়ারি থেকে টানা অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দেন তিনি। সরকারের পতন না ঘটিয়ে ঘরে ফিরবেন না বলে ঘোষণা দেন বিএনপি চেয়ারপার্সন।
২০ দলীয় জোটের এই অবরোধ কর্মসূচির সময় নজিরবিহীন জ্বালাও-পোড়াও এবং সহিংসতায় দুঃসহ হয়ে ওঠে জনজীবন। বিপর্যস্ত হয় শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন। পেট্রোল বোমা ও ককটেল বিস্ফোরণে দগ্ধ হন শত শত সাধারণ মানুষ। পথঘাট ও হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পেট্রোল বোমায় দগ্ধ, ঝলসানো মানুষ এবং তাদের স্বজনদের করুণ আর্তনাদ এবং হাহাকারে ভারী হয়ে ওঠে বাতাস।

টানা ৯২ দিনের ‘অবরোধে’ প্রায় ১৩৮ জনের মৃত্যু ঘটে। এদের মধ্যে ১০২ জন পেট্রলবোমার শিকার হন। বাকিদের কেউ ককটেল বিস্ফোরণে, কেউ সংঘর্ষে, কেউ পুলিশের গুলিতে এবং কেউবা বোমা বানাতে গিয়ে বিস্ফোরণে মারা যান। ‘আগুনসন্ত্রাসে’ নিহত ১০২ জন সাধারণ মানুষের মধ্যে ৪৩ জন ছিলেন বাস বা অন্য কোনো বাহনের যাত্রী। চালক ছিলেন ১০ জন এবং চালকের সহকারী ১২ জন। নয়জন শ্রমিক বা দিনমজুর, একজন পথচারী, পাঁচজন ছাত্র, দুজন প্রবাসী, সাতজন শিশু, নয়জন নারী ও একজন পুলিশ সদস্য। টানা ৯২ দিনের ব্যর্থ অবরোধ এবং হরতাল শেষে ৯৫ দিন পর ২০১৫ সালের ০৫ ই এপ্রিল বকশিবাজার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী আদালতে দুর্নীতির মামলায় হাজিরা দিয়ে সরকারের পতন ঘটাতে ব্যর্থ বেগম জিয়া এক বুক বেদনা নিয়ে গুলশানের ভাড়া বাসায় ফেরেন।

১/১১ সরকারের সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে ২০১৮ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি ৫ বছরের কারাদন্ড দেয় ঢাকার একটি বিশেষ আদালত। দন্ডপ্রাপ্ত হওয়ার পর তাকে আদালত থেকে কারাগারে নেওয়া হলে খালেদা জিয়াকে ছেড়ে দিতে বিএনপি আল্টিমেটাম দেয়। অন্যথায় দেশ অচল করে দেওয়ার হুমকি দেয়। তবে কোনো আল্টিমেটাম কিংবা হুমকিতে কাজ হয়নি। এরপর ৩০শে অক্টোবর একই মামলায় খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড ৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ১০ বছর করে হাইকোর্ট। অন্যদিকে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় আরেকটি বিশেষ আদালত তাকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়। খালেদা জিয়ার দণ্ডাদেশের পর বিএনপি ঢিলেঢালা কর্মসূচি দিলেও তা গতি পায়নি। ঐ বছরের এপ্রিলে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে দেশের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে বিএনপি চাকরি প্রার্থী ছাত্রদের অরাজনৈতিক আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন দিয়ে তাদের উপর ভর করে সরকার পতনের দিবাস্বপ্ন দেখতে থাকে। তবে তা স্বপ্নই রয়ে যায়। বাস চাপায় দু’জন স্কুল ছাত্রের ২৯ শে জুলাই মর্মান্তিক মৃত্যুর পর আগস্ট মাসের শুরু থেকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশব্যাপী স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের আন্দোলনের সময় গুজব ছড়িয়ে আন্দোলন কে জোরদার করে আরেকবার সরকার পতনের স্বপ্ন দেখলে তাও হতাশায় রুপ নেয়।

বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে থাকা অবস্থায় অসুস্থ হলে মানবিক বিবেচনায় সরকারের নির্বাহী আদেশে নিজের বাড়িতে থাকার সুযোগ পান। তিনি নিজের পছন্দ মতো হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে তাকে বার বার চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর আবেদন জানানো হয়েছে। এমনকি সরকার কে আল্টিমেটাম ও দেওয়া হয়েছে কয়েকবার। ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর বিএনপি ঢাকা বিভাগীয় মহাসমাবেশ ডেকেছিল। মহাসমাবেশের আগে ১০ ডিসেম্বরের পর থেকে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম জিয়ার কথায় দেশ চলবে, ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফিরে আসবেন, ঐ দিনই হবে শেখ হাসিনার জন্য শেষ দিন বলে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছিলেন বিএনপি নেতা আমান উল্লাহ্ আমান। শেখ হাসিনা সহ আওয়ামী লীগের নেতারা পালানোর পথ খুঁজছে, তাদের প্লেনের টিকিট রেডি- এরুপ হাঁক-ডাক ছাড়লেও বিএনপি রাজপথে কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে বার বার ব্যর্থ হয়েছে। তারা গত ২৪ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে সরকার কে ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়েছিল। তবে সরকার বিএনপির আল্টিমেটাম কে আমলেই নেয়নি। আবার আল্টিমেটাম শেষে বিএনপিও ছিল প্রতিক্রিয়াহীন।

সরকার বিএনপির এই চরমপত্র এবং হুংকার কে এখন অনেকটাই নখদন্তহীন বাঘের গর্জনের মতই মনে করে। অক্টোবর মাসের প্রথম থেকেই বিএনপি নেতারা সরকারের সময় শেষ, মেয়াদ এই মাস ও পার হবে না ইত্যাদি বক্তব্য দিয়েছিল। ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের ঘোষণা দেওয়ার পর তারা মঞ্চে চরমপত্র ঘোষণা করে, ২৮ অক্টোবরই সরকারের শেষ দিন। তবে অতীতের মতই ভুল রাজনৈতিক কৌশল এবং নেতৃত্বের ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে ২৮ অক্টোবর। তারা বক্তব্যে ঘোষণা দিয়েছিল সমাবেশ শেষে সমাবেশস্থলে বসে পড়বে। বড় সমাবেশের আয়োজন ও করেছিল তারা। তবে এবারও তাদের হুংকার কাজে আসেনি।

সারা মাস হাঁক-ডাক দিয়ে, মহাসমাবেশের দিন সরকারের সাথে ফাইনাল খেলার চরমপত্র ঘোষণা করে নেতাকর্মীদের দূরদূরান্ত থেকে ঢাকায় জড়ো করে খেলা শুরুর আগেই অধিক উত্তেজনায় ফাউল করে বসলেন। ফলে যা হবার তাই হলো, খেলা শুরুর বাঁশি বাজার আগেই মাঠ থেকে বিদায় নিল বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। যেকোনো মূল্যে ঢাকা শহর অবরোধ করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে সমাবেশে আসা নেতাকর্মীরা নেতৃত্বের ব্যর্থতায় দু’হাত উঁচিয়ে অসহায় আত্মসমর্পণ করে সমাবেশস্থল ত্যাগ করলেন মনোকষ্ট নিয়ে। শীর্ষ নেতৃত্বের অপরিপক্ক সিদ্ধান্তে এক মাস ধরে স্বপ্ন দেখা তৃণমূলের লাখো উচ্ছ্বসিত নেতাকর্মী এখন মনোবল হারিয়ে হতাশায় ভুগছেন। বিএনপির নেতা এবং কর্মীদের সেদিনের সমাবেশস্থল ত্যাগের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের দৃঢ়তা, সাহস ও সক্ষমতা নিয়ে রাজনীতি সচেতন সাধারণ মানুষ ও এখন প্রশ্ন তুলছেন।

সতেরো বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা এসব নেতাকর্মী শত মাইল দূর থেকে সকল বাধা, বিপত্তি অতিক্রম করে কত স্বপ্ন আর আশা নিয়েই না ঢাকা গিয়েছিল। নেতৃত্বের ভুলে এক নিমিষেই তাদের সব স্বপ্ন, আশা চুরমার হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের মত দক্ষ, কৌশলী, বারবার চ্যাম্পিয়ন দলের সাথে ফাইনাল খেলা কতোটা দূরুহ তা বিএনপি নেতারা নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারছেন এখন। এক ভুলে চাঙ্গা বিএনপি এখন পুরোপুরি ব্যাকফুটে। ফাইনাল খেলা তো দূরের কথা তাদের এখন মাঠে প্রবেশই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। নিজেদের ভুল শুধরে নেতাকর্মীদের মনোবল ফেরাতে বিএনপি তৎক্ষনাৎ কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। নয়াপল্টনের সমাবেশ শেষে মিয়ান আরেফি নামে বাংলাদেশী বংশদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক কে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টা সাজিয়ে তার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলকে নয়াপল্টনে বিএনপির কার্যালয় পরিদর্শন করান এবং তাকে দিয়ে সেখানে প্রেস ব্রিফিং করান।

বিএনপি নেতাদের পরামর্শে প্রেস ব্রিফিংয়ে মিয়ান আরেফি নামে পরিচয় দেওয়া ঐ ব্যক্তি নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টা হিসেবে পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সহ কোন কোন ব্যক্তিকে কি বার্তা পাঠিয়েছেন তার ফিরিস্তি দেন। প্রেস ব্রিফিংয়ে তার পাশে ছিলেন বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন এবং নারী কেলেঙ্কারিসহ সেনা শৃঙ্খলা পরিপন্থী কর্মকাণ্ডের জন্য ২০১৯ সালের মার্চ মাসে দেশের সকল সেনানিবাসে ‘অবাঞ্চিত’ ঘোষিত সেনা বাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায় বর্তমান সরকারের সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী সেনা কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী।

বিষয়টি ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের নজরে এলে দূতাবাসের মুখপাত্র তাকে একজন বেসরকারি ব্যক্তি হিসেবে অভিহিত করে মার্কিন সরকার কিংবা মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেন। এমনকি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এবং বিএনপি নেতা ইশরাক ও তার পরিচয় সম্পর্কে অবগত নন বলে দাবি করেন। তাদের এই দাবি কি যৌক্তিক? বিএনপি নেতারা তাকে না চিনলে তিনি কিভাবে বিএনপি অফিসে ঢুকে প্রেস ব্রিফিং করেন। এই ঘটনা আসলে বিএনপির দেউলিয়াপনা এবং অপরাজনীতির-ই বহিঃপ্রকাশ।

বিএনপি বুঝতে পেরেছে কর্মীদের উজ্জীবিত করতে মঞ্চে তারা যতই চরমপত্র দিক না কেন, রাজপথের আন্দোলন, সংগ্রামের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের মত শক্তিশালী সরকারের পতন ঘটানোর শক্তি এবং সামর্থ্য কোনোটিই তাদের নেই। তাই সরকার পতনে তাদের একমাত্র অভিলাষ এখন পশ্চিমা শক্তির দয়া এবং অনুকম্পা।

লেখক: মোঃ নজরুল ইসলাম, কলামিস্ট এবং তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, ১৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ, খুলনা মহানগর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *