দুবাইয়ে নারী পাচার চক্রের মূলহোতাসহ গ্রেপ্তার ৩

অপরাধ

দুবাইয়ে নারী পাচার করে ‘যৌনকর্মে বাধ্য করার’ অভিযোগে দেশে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে দুবাইয়ের চারটি হোটেলের মালিক এই চক্রের মূলহোতা মো. আজম খান রয়েছেন। রোববার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সদর দপ্তরে এ বিষয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ডিআইজি ইমতিয়াজ আহমেদ এসব তথ্য জানান। এর বাইরে পাচারকৃত নারীদের ভয়েস রেকর্ড পাওয়া গেছে। যাতে আর্তনাদের ভয়াবহ বিষয় সামনে এসেছে। দুবাইয়ে পাচার হওয়া স্বপ্না নামের এক তরুণীর ১৬ সেকেন্ডের এই ভয়েজ রেকর্ড থেকে জানা যায়, ‘ভাইয়া দেশে আমার মা একা। আমি ছাড়া আমার মাকে দেখার কেউ নেই। আমার মা খুব অসুস্থ। আমাকে দেশে পাঠিয়ে দেন’। একইভাবে পাচার হওয়া মনি নামের অপর এক তরুণীর ভয়েজে উঠে এসেছে আরও হৃদয় বিদারক ঘটনা। ১৮ সেকেন্ডের রেকর্ডে বলতে শোনা যায়, দেখেন ভাইয়া আপনার পায়ে ধরি, আমার বাবা স্ট্রোক করেছে। ৭ মাসে আমি বেতনের ৩ লাখ টাকা পাই। সেখান থেকে আমাকে কিছু টাকা দেন। আমি বাবার চিকিৎসা করাব।’ এত আর্তনাদের পরও মন গলেনি দুবাইয়ে নারী পাচারকারী চক্রের মূল হোতা আজম খানের। এমন পরিস্থিতিতে আজমের নামে দায়েরকৃত একটি মামলায় দুই সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এর পরেই বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। গত আট বছরে সে হাজারেরও বেশি তরুণীকে পাচার করে দুবাইয়ে গড়ে তুলেছেন ৪টি হোটেল। সংবাদ সম্মেলনে ডিআইজি ইমতিয়াজ আহমেদ জানান, সহস্রাধিক নারীকে কাজ দেওয়ার নামে যৌনকর্মে বাধ্য করায় আজম খান ও তার দুই সহযোগী ১ আল আমিন হোসেন ওরফে ডায়ামন্ড ও আনোয়ার হোসেন ওরফে ময়নাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই আজম খানের নামে দুবাইতে চার তারকাযুক্ত তিনটি ও তিন তারকাবিশিষ্ট একটি হোটেল রয়েছে। হোটেলগুলো হচ্ছে ফরচুন পার্ল হোটেল অ্যান্ড ড্যান্স ক্লাব, হোটেল রয়েল ফরচুন, হোটেল ফরচুন গ্র্যান্ড ও হোটেল সিটি টাওয়ার। সম্প্রতি দুবাই পুলিশ আজম খানের ব্যাপারে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশ দূতাবাসে জানা?য় এবং তার পাসপোর্ট বাতিল করে দেয়। এরপর এক্সিট পাস নিয়ে আজম দেশে চলে আসেন। তারপর থেকে আত্মগোপনে যান। ইমতিয়াজ আহমেদ জানান, প্রথমে হোটেলে চাকরি দেয়ার কথা বলে ২০-২২ বছরের তরুণী কিশোরীদের প্রলুব্ধ করা হতো। বিশ্বস্ততা অর্জনে বেতন হিসেবে ২০-৩০ হাজার টাকা নগদ পরিশোধও করা হতো। শুধু তাই নয়, দুবাইয়ে যাওয়া-আসা বাবদ সব ধরনের খরচও দিত দালাল চক্র। কিন্তু দুবাই যাওয়ার পর তাদেরকে হোটেলে জিম্মি করে জোরপূর্বক দেহ ব্যবসাসহ ডান্স ক্লাবে নাচতে বাধ্য করা হতো। গত আট বছরে এভাবে প্রলুব্ধ করে চাকরির নামে দেশের হাজারেরও বেশি তরুণী-কিশোরীকে দুবাইয়ে পাচার এবং তাদের দেহ ব্যবসায় জড়াতে বাধ্য করেছে আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী এই চক্রের সদস্যরা। দালালরা মেয়েদের প্রলুব্ধ করে নির্ধারিত দুটি বিদেশি এয়ারলাইন্স এজেন্সির মাধ্যমে দুবাই পাঠাত। দুবাই যাওয়ার পরে তাদের প্রথমে ছোটোখাট কাজ দেয়া হতো। এরপর জোরপূর্বক ড্যান্স ক্লাবে নাচতে বাধ্য করা হতো। আটকে রাখা হতো, খাবার দেয়া হতো না, শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হতো। বৈদু্যতিক শক পর্যন্ত দেয়া হতো। দেহ ব্যবসায় বাধ্য করা হতো। এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুবাই সরকার দূতাবাসকে জানিয়ে চক্রের গডফাদার আজমের পাসপোর্ট জব্দ করে দেশে ফেরত পাঠায়। দেশে ফেরার পর আজম আত্মগোপনে যায়। বারবার নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে। নতুন পাসপোর্ট করে সে সীমান্ত দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পালানোর চেষ্টা করে। তবে তার আগেই দুই সহযোগীসহ সিআইডির চৌকস দল তাকে আটক করে। এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে ১৫টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। যার মধ্যে ছয়টি হত্যা মামলার। এক প্রশ্নের জবাবে ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, দেশের দালালরা প্রতিটি মেয়ের জন্য ১০ হাজার করে টাকা পায়। তরুণীদের অগ্রিম বেতন দেয়ার কথা বলে প্রলুব্ধ করা হতো। দুবাই পর্যন্ত ভিকটিমদের যাওয়া খাওয়া থাকার সব খরচ দালালচক্র পরিশোধ করত। অগ্রিম বেতন হিসেবে ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত আগাম পরিশোধ করা হতো। কিন্তু দুবাই ড্যান্সবারে হোটেলে নেওয়ার পর তাদের আর বেতন দেয়া হতো না। এসব ঘটনায় আসামিদের জড়িত থাকার অডিও ক্লিপ ইতোমধ্যে সিআইডি উদ্ধার করছে। ‘অডিও ক্লিপে অনেক নারীর আর্তনাদ শোনা গেছে। এরমধ্যে আলেয়া নামের এক তরুণীকে বলতে শোনা গেছে, আমাকে ৫০ হাজার টাকা বেতনের চাকরির কথা বলে আনা হয়েছে। আমার মা অসুস্থ। নাজিম ভাইকে বলেছি। আমাকে এখানে মারধর করা হচ্ছে’। আরেকটা ভয়েজে জনৈক ব্যক্তি আজম খানকে বলছেন, ‘আজকে মেয়েটি যাচ্ছে না। ওকে কি করব’?। এর পরের নির্দেশনার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ডিআইজি বলেন, দুবাইয়ে আজমের আরও দুই ভাই রয়েছে। তারাও একই ব্যবসা করেন। দেশে দালালদের তালিকায় রয়েছে, নিজাম, স্বপন, জিলস্নু, তানভীরসহ আরও অনেকে। তারাই মূলত দেশ থেকে তরুণীদের সংগ্রহ করার কাজে নিয়োজিত ছিল। এসব দালালদের গ্রেপ্তারেও কাজ করে যাচ্ছে সিআইডি। গ্রেপ্তার আজমের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে। ধারণা করা হচ্ছে, বেশিরভাগ তরুণী চট্টগ্রাম নোয়াখালী ও কুমিলস্না জেলার। এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তদন্ত শেষে প্রকাশ করা হবে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আজম গত আট বছরে হাজারেরও বেশি তরুণীকে দুবাই পাচার করেছে বলে স্বীকার করেছে। এ ঘটনায় সিআইডি বাদী হয়ে গত ২ জুলাই রাজধানীর লালবাগ থানায় একটি মামলা করেছে। ওই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *