অবশেষে দেশের ৮৩টি হাসপাতালে লিকুইড অক্সিজেন ট্যাংক বসানোর কাজ শুরু করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। ৬টিতে বাসানো হয়ে গেছে, বাকিগুলোতে পর্যায়ক্রমে বসবে। কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের সুচিকিৎসায় জুন ও জুলাইয়ে বিভিন্ন স্তরের হাসপাতালে অক্সিজেন ট্যাংক বসানোর সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ৩০টি হাসপাতালে এ সংক্রান্ত কাজের জন্য আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে ইউনিসেফ। বাকিগুলো হচ্ছে সরকারি অর্থায়নে। এ কাজে ১৬৬ কোটি টাকা বেশি ব্যয়ের আশঙ্কা আছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, ২৩টি হাসপাতালে সেন্ট্রাল গ্যাস পাইপলাইন এবং লিকুইড অক্সিজেন ট্যাংক স্থাপনে সরাসরি ক্রয়ের অনুমতি দেয়া হয়েছে। ৩৯টি সরকারি হাসপাতালে জরুরিভিত্তিতে লিকুইড অক্সিজেন ট্যাংক স্থাপনের ব্যবস্থা নেয়ার জন্য গণপূর্ত বিভাগকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। অবশিষ্ট ২১টিরও প্রক্রিয়া চলছে। এগুলো কেনাকাটার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে দর যাচাই কমিটি করা হয়নি। যান্ত্রিক বিষয়গুলো দেখভালের জন্য বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীদের নিয়ে গঠন করা হয়নি কোনো কমিটি। এ অবস্থায় ৬টি হাসপাতালে এ সংক্রান্ত কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে দুটির বিল স্বাস্থ্য অধিদফতরে পাঠানো হয়েছে। এতে দেখা গেছে, একটিতে ব্যয় হয়েছে ৪ কোটি টাকা অন্যটিতে ৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা। সংশ্লিষ্ট সংস্থার হিসাব অনুযায়ী প্রতিটিতে দুই কোটি টাকা করে বেশি ব্যয় হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত নিতে অনেক দেরি হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের অভাবে করোনা আক্রান্ত অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আবার ট্যাংক স্থাপনে ব্যয়ও অনেক বেশি হচ্ছে। তারপরেও বিপুল ব্যয়ে যেসব হাসপাতালে ট্যাংক স্থাপন করা হচ্ছে সেগুলো যেন রোগীদের কাজে আসে- অযত্ন, অবহেলায়, অকর্যকর হয়ে যেন পড়ে না থাকে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনা রোগীদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের অভাব। কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে দেশে এ পর্যন্ত ২ হাজার ৩০৫ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। যাদের ৮০ ভাগেরই মৃত্যু হয়েছে অক্সিজেন ঘাটতিজনিত কারণে। কারণ হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া এসব রোগীদের লক্ষণ অনুযায়ী সব ধরনের ওষুধ দেয়া হয়। কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুযায়ী হাইফ্লো অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। ফলে তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ঘটে।
এ প্রসঙ্গে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিনের (নিপসম) ভাইরোলজিস্ট ডা. জামালউদ্দিন সাইফ যুগান্তরকে বলেন, করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর প্রধান কারণ হাইপক্সিয়া। অর্থাৎ প্রয়োজনের সময়ে হাই ফ্লো অক্সিজেন না পাওয়া বা যতটা হাইফ্লো অক্সিজেন রোগীর দরকার ছিল ততটা সবরাহ না করা। অথবা যতটা অক্সিজেন রোগী পেয়েছিল সেটা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তিনি বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীর লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দেয়া হয়। কিন্তু অক্সিজেনের সরবরাহ না থাকলে সেটি দেয়া সম্ভব হয় না।
মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে ৪টি হাসপাতালে অক্সিজেন ট্যাংক স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে। এগুলো হল- রাজধানীর বসুন্ধরা হাসপাতাল, কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ ৩শ’ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল এবং কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ট্যাংক স্থাপনের কাজ প্রায় শেষের দিকে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের বিল ইতোমধ্যে অধিদফতরে পাঠানো হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, একটিতে স্থাপন ব্যয় ৪ কোটি টাকা, অন্যটিতে ৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান ‘হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট’ সূত্রে জানা গেছে, ২৫০ শয্যার একটি হাসপাতালে ট্যাংক ও অক্সিজেন লাইন স্থাপনসহ সব ধরনের ব্যয় মিটিয়ে ঠিকাদারের লভ্যাংশসহ আড়াই কোটি টাকার মধ্যে কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব। অর্থৎ এক্ষেত্রে প্রতিটি হাসপাতালে ট্যাংক স্থাপনের ক্ষেত্রে দেড় থেকে দুই কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করা হচ্ছে। এ হিসাবে ৮৩টি হাসপাতালে ট্যাংক স্থাপনে অতিরিক্ত ব্যয় হবে প্রায় ১৬৬ কোটি টাকা।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক দেশের বৃহৎ একটি অক্সিজেন উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, অক্সেজেন ট্যাংক স্থাপনে এত টাকার প্রয়োজন হয় না। কারণ অক্সিজেন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ট্যাংক ভাড়া দেয়া হয়ে থাকে। যদিও নিজেরা স্থাপন করে সেখানে এত টাকার প্রয়োজন হয় না।
জানা গেছে, কোভিড-১৯ রোগীদের সুচিকিৎসায় দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের ৮৩টি হাসপাতালে বসানো হচ্ছে লিকুইড অক্সিজেন ট্যাংক। করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিরবচ্ছিন্ন ও অব্যাহত রাখতে এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। গত ১ জুলাই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ড. বিলকিস বেগম স্বাক্ষরিত এক স্মারকে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ সংক্রমিত রোগী ব্যবস্থাপনার ২৩টি হাসপাতালে সেন্ট্রাল গ্যাস পাইপলাইন এবং লিকুইড অক্সিজেন ট্যাংক স্থাপনে সরাসরি ক্রয়ের অনুমতি দেয়া হল।
এদিকে ২ জুন অপর এক স্মারকে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম, কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা নিরবচ্ছিন্ন রাখতে গণপূর্ত বিভাগকে ৩৯টি সরকারি হাসপাতালে জরুরিভিত্তিতে লিকুইড অক্সিজেন ট্যাংক স্থাপনের ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান। এ ৬২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২০টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ২৫টি ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল, ৫টি বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং ১২টি ১০০ শয্যার হাসপাতাল রয়েছে। আরও ২১টি হাসপাতালে অক্সিজেন ট্যাংক স্থাপনের কাজ করবে মন্ত্রণালয়।
দুটি স্মারকে যেসব হাসপাতালে ট্যাংক স্থাপনের নির্দেশনা রয়েছে সেই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো হল- ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, টাঙ্গাইল শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, এমএজে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিরাজগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
বিশেষায়িত হাসপাতালগুলো হল- শেখ আবু নাসের স্পেশালাইজড হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র, শেখ রসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল, কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল
২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালগুলো হল- সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল, কক্সবাজার জেলা হাসপাতাল, গোপালগঞ্জ জেলা হাসপাতাল, মানিকগঞ্জ জেলা হাসপাতাল, মুন্সীগঞ্জ জেলা হাসপাতাল, জামালপুর জেলা হাসপাতাল, হবিগঞ্জ জেলা হাসপাতাল, শেরপুর জেলা হাসপাতাল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতাল, সুনামগঞ্জ জেলা হাসপাতাল, নীলফামারী জেলা হাসপাতাল, বাগেরহাট জেলা হাসপাতাল, বরগুনা জেলা হাসপাতাল, চুয়াডাঙ্গা জেলা হাসপাতাল, ভোলা জেলা হাসপাতাল, মাগুরা জেলা হাসপাতাল, খুলনা জেনারেল হাসপাতাল, টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতাল, কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল, বগুড়া মোহাম্মদ আলী জেনারেল হাসপাতাল, গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতাল, দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতাল, ঠাকুরগাঁও জেনারেল হাসপাতাল ও বরিশাল জেনারেল হাসপাতাল।
১০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালগুলো হল- রাজবাড়ী, নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুর, পিরোজপুর, নড়াইল, লক্ষ্মীপুর, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কুমিল্লা, ঝালকাঠি, ঝিনাইদহ এবং লালমনিরহাট।
এছাড়া ইউনিসেফের সহযোগিতায় আরও ৩০টি হাসপাতালে গ্যাস পাইপলাইন ও অক্সিজেন ট্যাংক বসানো হচ্ছে- পটুয়াখালী, বি. বাড়িয়া, চাঁদপুর, ফেনী, নেয়াখালী, রাঙ্গামাটি, নরসিংদী, শরীয়তপুর, যশোর, সাতক্ষীরা, নেত্রকোনা, জয়পুরহাট, নওগাঁ, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতাল। পাবনা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল এবং খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এ তালিকায় আরও ৯টি হাসপাতাল রয়েছে যেগুলো অন্যান্য তালিকায় বিদ্যমান।
এসব বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, অক্সিজেন ট্যাংক স্থাপনের উদ্যোগ আরও আগেই নেয়া উচিত ছিল। দেরিতে হলেও যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এটি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি দেখতে হবে, যেখানে প্রয়োজন নেই এমন স্থানে যেন না বসানো হয়। তবে সেগুলো অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট হবে। স্থাপন ব্যয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ট্যাংক স্থাপন ব্যয় নির্বাহের জন্য একটি বাজার দর যাচাই কমিটি করা উচিত ছিল। বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে সেটি করা যেত। যারা ইতোমধ্যে বিল জমা দিয়েছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেয়া উচিত। কেউ যদি অতিরিক্ত বিল দাখিল করে এবং কেউ যদি সেটি প্রদান করে তাহলে উভয়ের শাস্তি হওয়া দরকার। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, তিনি এ সম্পর্কে কিছু জানেন না।