স্বাস্থ্যবিধি সুনিশ্চিত করে ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকা বাদ দিয়ে রাজধানীতে স্বল্প পরিসরে স্বল্পসংখ্যক পশুর হাট বসানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, ঈদুল আজহায় পশু কোরবানি একদিকে যেমন ধর্মীয় রীতি পালনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে, অন্যদিকে অনেক খামারির জীবিকার প্রশ্নও রয়েছে। সার্বিক দিক বিবেচনা নিয়ে ডিজিটাল এবং ফিজিক্যাল উভয় হাটের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে তার আগে হাটগুলোয় পশুর চাহিদা এবং স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতকরণে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
আসন্ন ঈদুল আজহায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে অস্থায়ী পশুর হাট না বসানোর সুপারিশ রয়েছে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির। কিন্তু এই সুপারিশের আগেই শুক্রবার স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়নে বিশেষ পদক্ষেপসহ বেশকিছু হাটের ইজারা চূড়ান্ত করেছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। এমতাবস্থায় হাট বসবে না বন্ধ করা হবে, তা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে ঢাকার দুই নগর সংস্থার সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য হল, কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সুপারিশের কারণে পশুর হাটের সংখ্যা কিছুটা কমলেও হাট বসবে। এবারের হাটে অন্যবারের মতো বিশৃঙ্খল হবে না। স্বাস্থ্যবিধি সুনিশ্চিত করে হাট পরিচালনা করতে ইজারাদার, ক্রেতা এবং বিক্রেতাদের বাধ্য করবে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, ‘কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি কোরবানির পশুর হাট বসানোর ব্যাপারে কঠোরতর সুপারিশ করেছে। তবে সেখান থেকে সরে আসা দরকার। কেননা কোরবানির সঙ্গে অর্থনীতির বড় সম্পর্ক রয়েছে। বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য কোরাবানির পশুর হাট বন্ধ নয়, স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে গুরুত্ব দিতে হবে।’
এ বিষয়ে নগর বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হক বলেন, গরুর মাধ্যমে করোনা ছড়ায় না। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে গরুর হাট বন্ধ করার কোনো কারণ দেখি না। তবে এবার সব পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, ‘দেশের কৃষক গরু উৎপন্ন করছে। তাদের গরু বিক্রির মোক্ষম সময় কোরবানির পশুর হাট। এটা নিশ্চিত করা না গেলে তারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি যে সুরারিশ করেছে, সেটা এক দৃষ্টিকোণ থেকে। এক্ষেত্রে সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সাধারণ ছুটি বাতিল করার পর থেকে ধীরে ধীরে জনজীবন স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত করে দিয়ে কী লাভ। মানুষ যেহেতু সাহস করে বাঁচতে চাচ্ছে, তাদের ঘরবন্দি করে ফেলার উদ্যোগ নেয়া ঠিক হবে না। এজন্য সরকার বা সংশ্লিষ্টদের বলব, শুধু এক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।’
জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর এবং চট্টগ্রামে পশুর হাট না বসানোর ব্যাপারে যে সুপারিশ করেছে- নিশ্চিয়ই তার বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তি রয়েছে। সে দিক বিবেচনা করে ওই পরামর্শ মেনে চলার প্রতি সংশ্লিষ্টদের গুরুত্বারোপ করতে হবে। তবে কৃষক, খামারি, মুসলমানদের ধর্মীয় রীতি পালন বিবেচনা করে এসব শহরেও পশু সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ডিজিটাল হাট বিকল্প হতে পারত। কিন্তু এ সময় ডিএনসিসি বা বেসরকারি উদ্যোগে হাট প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কমসংখ্যক চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। এজন্য ডিজিটাল এবং ফিজিক্যাল দুই ধরনের হাটই বসাতে হবে।’
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে লোকসমাগম কমিয়ে পশুর আয়োজন করতে হবে। আর এটা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের স্বাস্থ্যবিধিসহ শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সক্রিয় থাকতে হবে।’
হাটের বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে এবার ডিএনসিসি এলাকার হাট সংখ্যা কমানো হয়েছে। আর যেসব এলাকায় হাট বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, সেসব এলাকা ঘন জনবসিতপূর্ণ নয়।’ তিনি বলেন, ‘কোরবানির পশুর হাট থেকে যেন করোনা সংক্রমণ না ঘটে, সেজন্য সব হাটে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। একই সঙ্গে আমরা অসুস্থ, শিশু এবং বয়স্কদের কোরবানির পশুর হাটে না আসার অনুরোধ করেছি।’
এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন বলেন, ‘পশুর হাট বসানোর ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, সেটা এখনও বহাল রয়েছে। আগামীকাল (আজ) এ সংক্রান্ত একটি সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে আলোচনা হবে। যদি কোনো সিদ্ধান্ত হয় পরে জানাতে পারব।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) ১১টি হাট বসানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে ৬টি বসানোর প্রস্তুতি চলছে। ইতোমধ্যে ৩টির জায়গা চূড়ান্ত করা হয়েছে। বাকি তিনটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এর বাইরে দেশের সর্ববৃহৎ গাবতলী পশুর হাট যথারীতি বসবে। এদিকে শনিবার ডিজিটাল কোরবানির পশুর হাটের উদ্বোধন করেছে ডিএনসিসি। ডিএনসিসির সংশোধিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হাট বসবে ডুমনি, উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টর, উত্তরা ময়নারটেক, কাওলা শিয়ালকান্দা, বছিলা, ভাটারা সাঈদনগরে।
অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) ১৮টি পশুর হাট বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এগুলো হল- উত্তর শাহজাহানপুর খিলগাঁও রেলগেট বাজারের মৈত্রী সংঘের মাঠ সংলগ্ন খালি জায়গা, ইনস্টিটিউট অব লেদার টেকনোলজির মাঠ সংলগ্ন খালি জায়গা, কামরাঙ্গীরচর ইসলাম চেয়ারম্যানের বাড়ি সংলগ্ন খালি জায়গা, পোস্তগোলা শ্মশানঘাট সংলগ্ন খালি জায়গা, শ্যামপুর বালুর মাঠ সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, মেরাদিয়া বাজার সংলগ্ন খালি জায়গা, আরমানিটোলা মাঠ সংলগ্ন খালি জায়গা, লিটল ফ্রেন্ডস ক্লাব সংলগ্ন গোপীবাগ বালুর মাঠ ও কমলাপুর স্টেডিয়াম সংলগ্ন বিশ্বরোডের আশপাশের খালি জায়গা, দনিয়া কলেজ মাঠ সংলগ্ন পাশের খালি জায়গা, ধুপখোলা মাঠ সংলগ্ন পাশের খালি জায়গা, সাদেক হোসেন খোকা মাঠের পাশের ধোলাইখাল ট্রাকটার্মিনাল সংলগ্ন উন্মুক্ত জায়গা, ডিএসসিসির আফতাবনগর ইস্টার্ন হাউজিংয়ের খালি জায়গা, আমুলিয়া মডেল টাউনের খালি জায়গা, রহমতগঞ্জ খেলার মাঠ সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, সারুলিয়া পশুর হাট, সারুলিয়া কাঁচাবাজার, ডেমরা বাজার এবং কায়েতপাড়া বাজার সংলগ্ন এলাকা।