মায়ের কবরে চির নিদ্রায় শায়িত হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সাহারা খাতুন। আজ শনিবার বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর বনানীতে মায়ের কবরে তাঁকে দাফন করা হয়েছে।
এর আগে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারে পক্ষ থেকে সাহারা খাতুনকে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে একে একে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠন।
গত বৃহস্পতিবার রাতে থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাহারা খাতুন শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি জ্বর, অ্যালার্জিসহ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে অসুস্থ অবস্থায় রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হন। উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ৬ জুলাই তিনি থাইল্যান্ডে যান।
অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন ছিলেন দেশের জন্য একজন নিবেদিতপ্রাণ, তেমনি আওয়ামী লীগের ছিলেন বিশ্বস্ত বন্ধু।
সাহারা খাতুনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এক শোকবার্তায় বলেন, ‘সাহারা খাতুন ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন পরীক্ষিত নেতা। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে তিনি গণতন্ত্রের বিকাশসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে অপরিসীম অবদান রেখেছেন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশ একজন নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিককে হারাল।’
আর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বার্তায় শোক প্রকাশ করে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসেবে সাহারা খাতুন গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আজীবন কাজ করে গেছেন এবং দলের দুঃসময়ে নেতাকর্মীদের পাশে থেকে আইনিসহ সব সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করেছেন। সাহারা খাতুনের মৃত্যুতে দেশ ও জাতি একজন দক্ষ নারীনেত্রী এবং সৎ জননেতাকে হারাল। আমি হারালাম এক পরীক্ষিত ও বিশ্বস্ত সহযোদ্ধাকে।’
১৯৪৩ সালের ১ মার্চ ঢাকার কুর্মিটোলা গ্রামে বাবার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন সাহারা খাতুন। তাঁর বাবার নাম আবদুল আজিজ ও মায়ের নাম তুরজান নেছা। সিদ্ধেশ্বরী গার্লস হাই স্কুল থেকে ১৯৬০ সালে ইস্ট-পাকিস্তান বোর্ডের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন সাহারা খাতুন। সিটি নাইট কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তারপর জগন্নাথ কলেজে বিএ কোর্সে ভর্তি হন। পরে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি মাধ্যমে দ্বিতীয় শ্রেণিতে বিএ (ডিগ্রি) অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হলেও তিনি কোর্স শেষ করেননি। ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ১৯৮১ সালে আইন পেশায় নিজেকে যুক্ত করেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের জুনিয়র হিসেবে।
১৯৬৭ সালে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন সাহারা খাতুন। ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্রদের মধ্যে একটি নির্বাচনে তিনি ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেন। সেটি ছিল তাঁর জীবনের প্রথম নির্বাচন। ১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগের মহিলা শাখা যখন গঠিত হয়, তাতে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের দিনও তিনি সরাসরি উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন ১৯৭১ সালে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের সময় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।
সাহারা খাতুন প্রথম সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন ১৯৯১ সালে তৎকালীন ঢাকা-৫ আসনে। তিনি প্রথমবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে। নির্বাচনে হেরে যান তিনি।
এরপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১৮ আসন থেকে প্রথমবারের মতো সাংসদ নির্বাচিত হন সাহারা খাতুন। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। আর ওই সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয় সাহারা খাতুনকে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার দুই মাসের মাথায় বিডিআর বিদ্রোহের মতো ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল সাহারা খাতুনকে। ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি সামাল দিতে বিদ্রোহীদের মধ্যেও যেতে হয়েছিল সেখানে। সে জন্য তাঁর সাহসের যেমন প্রশংসা হয়েছিল, তেমনি অর্ধশতাধিক সেনা কর্মকর্তা হত্যার ঘটনা ঠেকাতে না পারার ব্যর্থতার জন্য সমালোচনাও শুনতে হয়েছিল।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির খুনিদের গ্রেপ্তারের ঘোষণা দিয়েও তা করতে না পারায় আবার সমালোচনায় পড়েছিলেন তিনি। এখনো সাগর-রুনির খুনিরা ধরা পড়েনি।
এরপর ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয় সাহারা খাতুনকে। ওই সরকারের মেয়াদ শেষে পরপর আরো দুবার আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেও মন্ত্রিপরিষদে স্থান পাননি সাহারা খাতুন। তবে ঢাকা-১৮ আসন থেকে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য হিসেবে জয়ী হন তিনি।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ২০০১ সালের ভোটের পর বিএনপির শাসনামলে মামলা পরিচালনায় অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের ভূমিকার কথা এখনো স্মরণ করেন।
সাহারা খাতুন বাংলাদেশ আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ফিন্যান্স কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান তিনি। এর পাশাপাশি তিনি আন্তর্জাতিক মহিলা আইনজীবী সমিতি ও আন্তর্জাতিক মহিলা জোটের সদস্য ছিলেন। আইন পেশায় থেকেই আওয়ামী লীগে সক্রিয় ছিলেন সাহারা খাতুন। আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক হয়ে আন্দোলনের মাঠে যেমন ছিলেন, তেমনি নির্যাতিত হয়েছেন, জেলও খেটেছেন। ২০০৪ সালের ১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায়ও আহত হয়েছিলেন তিনি।
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হলে আওয়ামী লীগের যে কজন নেতা দলীয় সভানেত্রীর প্রতি আনুগত্য ধরে রেখে সক্রিয় ছিলেন, তাঁদেরই একজন সাহারা খাতুন। দীর্ঘদিন রাজনীতিতে থাকলেও শেখ হাসিনার পক্ষে তখন আইনজীবী হিসেবে দাঁড়িয়েই ব্যাপক পরিচিতি পান তিনি।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নামে করা মামলা বিনা পারিশ্রমিকে পরিচালনা করে দলের নেতাকর্মীদের কাছাকাছি ছিলেন সাহারা। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে সাহসী ভূমিকায় থাকতেন তিনি। মাঠের কর্মী সাহারাকে ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৫ আসনে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে প্রার্থী করেছিল আওয়ামী লীগ। সেবার হারের পর পরবর্তী দুটি নির্বাচনে আর তাঁকে প্রার্থী করা হয়নি। তবে জরুরি অবস্থা জারির পর দলের দুঃসময়ে আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে হারানো আসন পুনরুদ্ধার করেন সাহারা খাতুন।