নিখাদ বার্তাকক্ষ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর চার দিনের ভারত সফরের প্রাক্কালে বলেন, তাঁর বাবা বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীরা যাতে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে জানতে না পারে- সেজন্য পরিচয় গোপন করে দিল্লীর পান্দারা রোডে তাঁকে তাঁর শিশু সন্তানদের নিয়ে থাকতে হয়েছিল।
ওই ঘটনার প্রায় পাঁচ দশক পর, দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষস্থানীয় মাল্টিমিডিয়া সংবাদ সংস্থা এএনআই’কে দেয়া এক আবেগময় সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওই হত্যাকা-ের পর কয়েক বছর তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে শেখ হাসিনা ১৯৭৫ সালের ওই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বর্ণনা করেন। হত্যাকান্ডের আগে তিনি তাঁর পরমাণু বিজ্ঞানী স্বামীর সাথে জার্মানীতে ছিলেন।
১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই তাঁর পরিবারের সদস্যরা শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানার সাথে দেখা করতে বিমানবন্দরে আসেন। এটা ছিল একটি খুবই আনন্দঘন বিদায় এবং ওই সময় শেখ হাসিনা ভাবতেই পারেননি যে, এটাই তাঁর বাবা-মায়ের সাথে তাঁর শেষ দেখা। পরিবারের সদস্যদের বিদায় জানানোর প্রায় পক্ষকাল পর, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেক হাসিনা তাঁর বাবা বাঙ্গালী জাতির পিতা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি এবং কিংবদন্তী মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার খবরটি পান।
পরিবারের অন্যান্য সদস্যের মৃত্যুর খবর পেয়ে তাঁর দুঃখ ও আতঙ্কের মাত্রা আরো বেড়ে যায়।
অশ্রুসিক্ত চোখে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এটি একদম অবিশ্বাস্য ছিল। এতই অবিশ্বাস্য যে- কোন বাঙালি এমনটা করতে পারে, এমনটা কল্পনাও করা যায় না। তখনও আমরা জানতে পারিনি যে, আসলে কি ঘটেছে। তখন আমরা শুধু শুনেছিলাম যে, সেনা অভ্যুত্থানে আমার বাবা নিহত হয়েছেন। কিন্তু তখনও জানতে পারিনি যে, আমার পরিবারের সকল সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে।’ ওই হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনার পরিবারের ১৮ জন সদস্য ও আত্মীয় নিহত হন, যার মধ্যে তাঁর ১০ বছরের ভাই শেখ রাসেলও ছিল।
প্রধানমন্ত্রীর মতে, ওই ঘটনার পর প্রথম দেশ হিসেবে ভারত তাঁর দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। তিনি বলেন, ‘মিসেস ইন্দিরা গান্ধী তাৎক্ষণিকভাবে খবর পাঠান যে, তিনি আমাদের নিরাপত্তা ও আশ্রয় দিতে চান। তাই আমরা দিল্লী ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেই, কারণ আমরা শুনেছিলাম যে, আমরা দিল্লী গেলে, সেখান থেকে আমাদের দেশে ফিরে যেতে পারব এবং তখন আমাদের পরিবারের কতজন সদস্য বেঁচে আছেন- তা জানতে পারব।’ ওই হত্যাকা-ের ৫০ বছর পরও ঘটনা বর্ণনা করার সময় অত্যন্ত দুঃখ ও আবেগআব্লুত কণ্ঠে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ওই সময়টা আমাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন ছিল।’
জার্মানীতে নিযুক্ত তৎকালীন অ্যাম্বাসেডর হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী তাঁকে প্রথম তাঁর বাবার মৃত্যুর খবর জানান। শেখ হাসিনা বলেন, ‘কয়েক মুহূর্তের জন্য আমি জানতেই পারিনি আমি কোথায় ছিলাম। কিন্তু আমি তখন আমার বোনের ব্যাপারে চিন্তা করছিলাম, সে আমার ১০ বছরের ছোট। তাই, আমি ভাবলাম এই ঘটনাটি শুনার পর তার কি প্রতিক্রিয়া হবে। তারপর আমরা যখন দিল্লীতে ফিরে যাই, তারা প্রথমে আমাদের অত্যন্ত সুরক্ষিত একটি বাড়িতে রাখলেন। কারণ তারাও আমাদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিলেন।’
শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারকে কঠোর নিরাপত্তায় পান্দারা রোডের একটি গোপন বাড়িতে রাখা হয় এবং তাঁদের প্রয়োজন মেটাতে তাঁর স্বামীকে একটি চাকরীও দেয়া হয়। তিনি বলেন, ‘একদিকে আমরা সবাইকে হারাই এবং অন্যদিকে আমি বিচারও চাইতে পারিনি। বিচারকে তখন প্রত্যাখ্যান করা হয়।’
তিনিও নিজেকে সম্ভাব্য টার্গেট বলে মনে করেন কিনা জানতে চাইলে শেখ হাসিনা বলেন, যে দুর্বৃত্তরা তাঁর বাবার ওপর হামলা করেছে তারা তাঁর অন্য আত্মীয়দের বাড়ীতেও হামলা চালিয়েছে এবং তার আত্মীয়দের কয়েকজনকে হত্যা করেছে।
‘মোট ১৮ জন সদস্য এবং অন্যান্য, যাদের বেশিরভাগই আমার আত্মীয় এবং কয়েকজন গৃহকর্মী এবং তাদের সন্তান এবং কিছু অতিথি ও আমার চাচা,’ নিহতদের মধ্যে ছিল, বলেন তিনি। ষড়যন্ত্রকারীদের স্পষ্ট লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউ যেন আর ক্ষমতায় ফিরে না আসে।
‘আমার ছোট ভাইয়ের বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর, কিন্তু তারা তাকেও রেহাই দেয়নি। তাই, আমরা যখন দিল্লিতে ফিরে আসি, তখন সম্ভবত ২৪ আগস্ট, তখন আমি প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধীর সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাদেরকে ডেকেছিলেন এবং আমরা সেখানে যাই। আমরা জেনে গেছি কেউ বেঁচে নেই। তারপর তিনি আমাদের জন্য সব ব্যবস্থা করে দিলেন। আমার স্বামীর জন্য একটা চাকরি আর পান্ডারা রোডের এই বাড়িটা, আমরা ওখানেই থাকলাম, সেই প্রথম ২-৩ বছর। আসলে এটা মেনে নেওয়া খুব কঠিন ছিল, আমার সন্তান, আমার ছেলের বয়স ছিল মাত্র ৪ বছর আর মেয়ে খুব ছোট, তারা দুজনেই কান্নাকাটি করত।
অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও, শেখ হাসিনাও কোথাও না কোথাও বুঝতে পেরেছিলেন যে তাকে আগামীর কথা ভাবতে হবে। ‘তাই, তিনি তারপর ধীরে ধীরে, আমাদের এখনো ভাল কিছু আছে, কারণ আমার সন্তান আছে। আমার বোন আছে, তাই এই দুঃখ, ব্যথা, খুব কঠিন কিন্তু তারপরও আমাদের আছে, আমাদের কি করতে হবে তা ভাবতে হবে? আমাদের কিছু একটা করা উচিত…আমাদের উচিত, আমরা এভাবে বাঁচতে পারি না,’ তিনি বলেন।
যদিও এই ব্যথা দূর হবে না, ‘তারা শুধু আমার বাবাকে হত্যা করেনি, তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকেও পাল্টে দিয়েছে, এই অপরাধ তাদের। সব কিছু, শুধু একটি রাতে, সবকিছুই বদলে গেছে এবং সেই খুনিরা… তারা আসলে এখনও আমাদের তাড়া করছে। আমরা কোথায় আছি তা জানার জন্য তারা চেষ্টা করছে। তাই, আমরা যখন পান্ডারা রোডে থাকতাম; এমনকি আমরাও করেছি… আমরা পারিনি, আমাদের নাম পরিবর্তন করতে হয়েছে,’ বলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।
বাবা-মাকে হারিয়ে শেখ হাসিনা তার পরিচয় গোপন করতে বাধ্য হন।
‘ভিন্ন নাম এবং এটি এতই বেদনাদায়ক যে আপনি নিজের নাম, নিজের পরিচয় ব্যবহার করতে পারবেন না… নিরাপত্তার কারণে তারা আমাদের অনুমতি দেয়নি,’ শেখ হাসিনা বলেন যে তিনি দুঃখজনক সময়টি বর্ণনা করার জন্য শক্তি সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের সদস্যদের ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ তারিখে একদল বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে, যা বাংলাদেশকে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে নিমজ্জিত করে এবং ফলস্বরূপ সামরিক শাসন একটি স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কয়েক বছরের জন্য থামিয়ে দেয়।
পরবর্তী ছয় বছর, ১৯৮১ সাল পর্যন্ত, শেখ হাসিনা ভিন্ন নামে ও পরিচয়ে দিল্লিতে বসবাস করেন।
যাই হোক, অনেকেই চেয়েছিলেন যে বাংলাদেশে ফিরে এসে তিনি তার বাবার মতো আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দেবেন।
তিনি বলেন, ‘অবশ্যই আমি আমার দেশে ফিরে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এত বড় দলের দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে কখনো ভাবিনি।’
যাইহোক, হাসিনা এই সময়ে বিভিন্ন দেশে যান এবং এমনকি ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্ট লন্ডনের ইয়র্ক হলে তার পিতার হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে একটি জনসভায় ভাষণ দেন।
‘তাদের বিচারের আওতায় আনতে বা তাদের আইনের আওতায় আনতে, বিচার হওয়া উচিত, কারণ তাদের ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছিল। একটি অধ্যাদেশ ছিল, তারা গুলি করে, তাই, আপনি খুনিদের বিরুদ্ধে কোনও মামলা করতে বা করতে পারবেন না। খুনিরা সব ধরণের সযোগ সুবিধা পেয়েছে এবং ইনডেমনিটি ক্ষেত্রে, এটা খুবই বেআইনি। হত্যাকারী এবং তারা হত্যা করেছে এবং এটি প্রকাশ্যে বলছে এবং তারা দাবি করেছে যে হ্যাঁ, তারা এই অপরাধ করেছে এবং তারা খুব সোচ্চার ছিল। কারণ, তারা ভেবেছিল তারা খুব শক্তিশালী,’ বলেন শেখ হাসিনা।
বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রচারণা চালিয়ে যান। ‘একদিকে আমরা সবাইকে হারিয়েছি, অন্যদিকে আমি বিচার চাইতে পারি না। বিচার অস্বীকার করা হয়েছিল। এই ছিল সেই সময় পরিস্থিতি । তারপর আবার আমি দিল্লিতে ফিরে আসি, ৮০ বা ৮১ সালের শেষের দিকে,’ তিনি বলেন।
যাইহোক, এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছিল।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, সেই সময় এবং আমার অনুপস্থিতিতে, তারা আমাকে দলের সভাপতি হিসাবে ঘোষণা করে।’ তিনি অবশেষে বাংলাদেশে চলে আসেন এবং আবার দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে শীর্ষস্থানে পৌঁছে যান।
‘তারা বেশ কয়েকবার আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করে, হ্যাঁ, কিন্তু আমি বেঁচে গিয়েছি। যদিও প্রকাশ্যে গ্রেনেড হামলা হয়েছিল। আমি জানি না কিভাবে আমি বেঁচে গেছি। আমাদের দলের নেতাকর্মীরা আমাকে ঢেকে রেখেছে, মানব ঢাল বানিয়েছে। তাই, তাদেও গায়ে সব সমস্ত স্পিøন্টার লাগে কিন্তু আমি… আমি সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিলাম। তারপর আমার সভায় গুলি করা হয়েছিল, আমি বেঁচে গিয়েছি। তারা আমার সভাস্থলে একটি বিশাল বোমা রেখেছিল। কোনোভাবে একজন সাধারণ মানুষ এটি আবিষ্কার করেন। তাই, আমি বেঁচে গেছি। আমি জানি না… আপনি আল্লাহকে এই ব্যাপাওে জিজ্ঞেস করতে পারে, আল্লাহ। আল্লাহ হয়তো আমাকে সাহায্য করছেন, হয়তো আল্লাহ আমাকে কিছু কাজ দিয়েছেন,’ বলেন শেখ হাসিনা।