দলের প্রতি বিশ্বস্ততার উদাহরণ তৈরি করে দেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নেওয়া সাহারা খাতুন আর নেই।
থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার রাতে তার মৃত্যু হয়েছে।
তৃণমূল থেকে লড়াই করে রাজনীতির শীর্ষ পর্যায়ে উঠে আসা চিরকুমারী সাহারা খাতুনের বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সাহারা ঢাকা-১৮ আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন। ২০০৯ সালের আওয়ামী লীগ সরকারে তিন বছরের বেশি সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
দলে দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত কর্মী সাহারা খাতুনের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, “আমি হারালাম এক পরীক্ষিত ও বিশ্বস্ত সহযোদ্ধাকে।
একজন নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিক হিসেবে সাহারা খাতুনের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদও।
নানা জটিলতা নিয়ে অসুস্থ সাহারাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য গত সোমবার ব্যাংককে নেওয়া হয়েছিল, ভর্তি করা হয়েছিল বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে।
ব্যাংককে সাহারার সঙ্গে যাওয়া তার ব্যক্তিগত সহকারী ও ভাস্তে মোহাম্মদ আনিসুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১১টার দিকে তার মৃত্যু ঘটে।
“বাংলাদেশ সময় রাত ১১.২৬ এ আমার ফুপু (সাহারা খাতুন) মারা গেছেন।”
সাহারা খাতুন জ্বর, অ্যালার্জির সমস্যাসহ বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে গত ২ জুন ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এরপর অবস্থার অবনতি হলে গত ১৯ জুন তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়েছিল। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে কয়েকদিন পর তাকে আইসিইউ থেকে ফিরিয়ে আনা হলেও অবনতি ঘটলে আবার নিতে হয়।
এর মধ্যেই পরিবারের সদস্যরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে চাইছিল, যদিও করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে তাতে দেরি হয়। সবশেষে গত সোমবার এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে থাইল্যান্ড নেওয়া হয়েছিল।
দেশ একজন নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিককে হারাল: রাষ্ট্রপতি
পরীক্ষিত ও বিশ্বস্ত সহযোদ্ধাকে হারালাম: প্রধানমন্ত্রী
সাহারা খাতুন ছিলেন দেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমানসাহারা খাতুন ছিলেন দেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করে সাহারা খাতুনকে যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করেছিলেন, তখন তা ছিল চমকের মতোই। কিন্তু তার ঠিক আগে কঠিন সময়ে বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েই দলীয় সভানেত্রীর আস্থা অর্জন করেছিলেন তিনি।
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হলে আওয়ামী লীগের যে কজন নেতা দলীয় সভানেত্রীর প্রতি আনুগত্য ধরে রেখে ছিলেন সক্রিয়, তাদেরই একজন সাহারা।
দীর্ঘদিন রাজনীতিতে থাকলেও শেখ হাসিনার পক্ষে তখন আইনজীবী হিসেবে দাঁড়িয়েই ব্যাপক পরিচিতি পান তিনি।
বিনা পারিশ্রমিকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নামে করা মামলা পরিচালনায় ভূমিকা রেখেও দলের নেতা-কর্মীদের কাছাকাছি ছিলেন সাহারা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার দুই মাসের মাথায় বিডিআর বিদ্রোহের মতো ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল সাহারাকে। ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি সামাল দিতে বিদ্রোহীদের মাঝেও যেতে হয়েছিল সেখানে। সেজন্য তার সাহসের যেমন প্রশংসা হয়েছিল, তেমনি অর্ধ শতাধিক সেনা কর্মর্তা হত্যার ঘটনাটি ঠেকাতে না পারার ব্যর্থতার জন্য সমালোচনাও শুনতে হয়েছিল।
আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির খুনিদের গ্রেপ্তারের ঘোষণা দিয়েও তা করতে না পারায় আবার সমালোচনায় পড়েছিলেন তিনি, যদিও প্রায় এক দশকেও ওই খুনি ধরা পড়েনি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পর টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছিলেন সাহারা খাতুন।স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পর টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছিলেন সাহারা খাতুন।
ওই সরকারের শেষ পর্যায়ে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সাহারাকে।
এরপর মন্ত্রীর দায়িত্ব আর না পেলেও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য করা হয়েছিল সাহারা খাতুনকে। ২০০৮ সালের পর দুটি নির্বাচনেই ঢাকা-১৮ থেকে তাকে নৌকার প্রার্থী করা হয়েছিল।
সাহারা খাতুনের জন্ম ১৯৪৩ সনের ১ মার্চ ঢাকায়। তার বাবার নাম আবদুল আজিজ মাস্টার ও মায়ের নাম তুরজান নেছা।
এলএলবি পাস করে সাহারা খাতুন ১৯৮১ সালে আইন পেশায় নিজেকে যুক্ত করেন। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের জুনিয়র হিসেবে তার কাজ শুরু হয়।
আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা ২০০১ সালের ভোটের পর বিএনপির শাসনামলে মামলা পরিচালনায় সাহারার ভূমিকার কথা এখনও স্মরণ করেন।
তৃণমূল থেকে লড়াই করে রাজনীতির শীর্ষ পর্যায়ে উঠে আসা সাহারা খাতুন ছিলেন চিরকুমারী।তৃণমূল থেকে লড়াই করে রাজনীতির শীর্ষ পর্যায়ে উঠে আসা সাহারা খাতুন ছিলেন চিরকুমারী।
সাহারা খাতুন বাংলাদেশ আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ফিন্যান্স কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান তিনি।
আইন পেশায় থেকেই আওয়ামী লীগে সক্রিয় ছিলেন সাহারা; আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক হয়ে আন্দোলনের মাঠে যেমন ছিলেন, তেমনি নির্যাতিত হয়েছেন, জেলও খেটেছেন। ২০০৪ সালের ১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলায়ও আহত হয়েছিলেন তিনি।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে সাহারার সাহসী ভূমিকায় থাকতেন সাহারা। মাঠের কর্মী সাহারাকে ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৫ আসনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে প্রার্থী করেছিল আওয়ামী লীগ। সেবার হারের পর পরবর্তী দুটি নির্বাচনে আর তাকে প্রার্থী করা হয়নি।
তবে জরুরি অবস্থা জারির পর দলের দুঃসময়ে আনুগত্যর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে হারানো আসন পুনরুদ্ধার করেন সাহারা।