আগস্ট: দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র, রক্তক্ষরণ ও জাতীয় শোকের মাতম

প্রচ্ছদ

নিখাদ বার্তাকক্ষ :: আগস্ট মাস বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায়, এক শোকাবহ মাস। হাজার বছরের দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছর পর- ১৯৭৫ সালের এই মাসেই সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় মুক্তির প্রবাদ পুরুষ, বাঙালি জাতির জনক ও বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এর ঠিক ১৪ বছর পর, আরেক আগস্টের রাতে সেই ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতেই বঙ্গবন্ধুকন্যা ও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাকে হত্যার মিশন চালায় বঙ্গবন্ধুর খুনিরা তথা ফ্রিডম পার্টির সন্ত্রাসীরা।

এরপর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিএনপি-জামায়াত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকায় আওয়ামী লীগের জনসভায় প্রকাশ্যে গ্রেনেড ও গুলি ছুড়ে হত্যার অপচেষ্টা চালানো হয় বঙ্গবন্ধুকন্যা ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে। পরের বছর, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারাদেশে একযোগে বোমা হামলা চালানোর মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে জিম্মি করে উগ্রবাদী মৌলবাদ গোষ্ঠী।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে যেভাবে বাঙালির শেকড় উপড়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল, তেমনি এসব হামলা ও হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জাতীয় চার নীতির আদর্শ বাস্তবায়ন থেকে বাঙালি জাতিকে দূরে সরিয়ে বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার সর্বোচ্চ অপচেষ্টা চালিয়েছে স্বৈরশাসক-শোষক ও তাদের মদতপুষ্ট উগ্রবাদী গোষ্ঠীরা।

১৫ আগস্ট ১৯৭৫, বাঙালি জাতির এতিম হওয়ার রাত:

হাজার বছর ধরে বাঙালি জাতি দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার যে স্বপ্ন দেখেছে, বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করেছি আমরা। দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রাম এবং অতঃপর ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানের বীজমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ৯ মাস রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয়ী জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বীর বাঙালি। পাকিস্তানি জান্তা ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার বাহিনীর নাশকতায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় পুরো দেশ।

একারণে মহান স্বাধীনতা অর্জনের পর প্রথমেই দেশ পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেন জাতির পিতা ও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্থানচ্যুত প্রায় দুই কোটি মানুষের আবাসস্থান সংস্কার ও গৃহনির্মাণ, নাগরিকদের পুনর্বাসন, দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন এবং শিক্ষাখাতে আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে আধুনিক শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন তিনি। বঙ্গবন্ধু জানতেন, বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে গড়তে হলে জাতীয় চার নীতির বাস্তবায়ন খুবই জরুরি। তাই তিনি সঠিক শিক্ষাসহ বহুমুখী নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে একটি নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন, যাদের হাতে বিকশিত হয়ে উঠবে নতুন বাংলাদেশ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্র এবং দেশবিরোধী চক্রের বিষাক্ত থাবায় সেই পথ থেকে বিচ্যুত হয় বাংলাদেশ।

হ্যাঁ, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মহান স্বাধীনতা অর্জন এবং ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশের যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল; তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। এই কালোরাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের নিজ বাসভবনে বর্বর ঘাতকদের গুলিতে সপরিবারের নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ধানমন্ডির সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লুটিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘদিনের জন্য অন্ধকারাচ্ছন্নতায় ঢাকা পড়ে পুরো বাংলাদেশ, পিতৃহত্যার দায়ে কলঙ্কিত হয়ে পড়ে বাঙালি জাতি।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে ঘাতকরা বাংলাদেশের বিকাশকে থমকে দিতে চেয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য পুঁজিবাদের রোষানল, ধর্মীয় উগ্রতা, সামাজিক নৈরাজ্য-অসমতা-বৈষম্য থেকে মুক্ত করে বাংলাদেশকে একটি প্রগতিশীল, মানবিক ও উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু যেসব উদ্যোগ নিয়েছিলেন; বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেসব উদ্যোগকে বাতিল ঘোষণা করে ঘাতকরা। কারণ তারা জানতো, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ নির্মাণ নীতি বাস্তবায়িত হলে, খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই স্বাবলম্বী হয়ে উঠতো দেশের মানুষ। তখন আর উগ্রবাদ ছড়ানোর সুযোগ থাকতো না, থাকতো না দেশকে পিছিয়ে নেওয়ার কোনো উপায়।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে স্বাধীনতাবিরোধীরা দেশকে আবারো পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আমলে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যেভাবে ধর্মব্যবসায়ীদের মুখোশ খুলে দিয়ে নৌকা প্রতীকে একচেটিয়ে ভোট দেয় জনগণ, এরপর থেকে অসাম্প্রদায়িকতার যে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফূরণ ঘটে আপামর বাঙালির মধ্যে,গণরায়কে ভিত্তি করে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সাথে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির নতুন ধারার স্বপ্নে সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের যে স্বপ্ন দেখেছিল বাঙালি- সেই স্বপ্ন পূরণের জন্যই মুক্তিযুদ্ধে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন আমাদের পূর্বপুরুষরা; তাদের সেই স্বপ্নই, সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে দেশে আবারো স্বৈরশাসন চালু করে পাকিস্তানিদের এদেশীয় প্রেতাত্মারা, সাম্প্রদায়িকতার বিভাজনে বিভক্ত করে তোলে জাতিকে, ঘটে উগ্রবাদের বিস্তার।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে শুধু একজন ব্যক্তিকেই হত্যা করা হয়নি, পুরো বাঙালি জাতির ভবিষ্যতকে হত্যা করে ঘাতকচক্র। এমনকি কেউ যেনো কখনো বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শন বাস্তবায়ন করে বাঙালি জাতিকে মুক্তির পথে দেখাতে না পারে, বাঙালি জাতি যেনো স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল ভোগ করতে না পারে, এজন্য তারা হত্যা করেছে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ১১ বছরের শিশু রাসেলসহ পরিবারের সদ সবদস্যকে। এমনকি পরবর্তীতে জাতীয় চার নেতা থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদেরও হত্যা করে এই চক্র। শুধু বিদেশ থাকায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা।

১৫ আগস্ট কালরাতে শহীদ হয়েছিলেন যারা:

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট কালরাতে ঘাতকের হাতে নিহত হন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুননেছা, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, ধানমন্ডির বাসায় কর্তব্যরত এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব কর্নেল জামিল, সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক।

প্রায় একই সময়ে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে ও যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় হামলা চালিয়ে হত্যা করে শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণিকে।

বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াতের বাসায় হামলা করে হত্যা করা হয় রব সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবী, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত এবং এক আত্মীয় বেন্টু খানকে।

ইনডেমনিটি, যেভাবে শুরু হয় বিচারহীনতার সংস্কৃতি:

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর-রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দেন। এরপর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বাঁচানোর জন্য ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্ব-ঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ একটি ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করে।

অধ্যাদেশটিতে দুটি ভাগ আছে। প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় অংশে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।

ইনডেমনিটির মূল কথা হলো, যারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারের নির্মমভাবে হত্যা করেছে; তাদের কারো বিচার করা যাবে না। তারা একটা দেশের প্রতিষ্ঠাতাকে পরিবারসহ হত্যা করে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াবে, তাদের নামে কোনো অভিযোগও করা যাবে না!!!

এরপর ক্ষমতায় আসে আরেক সামরিক শাসক মেজর জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সময় এই ব্যক্তি উপ-সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্বে ছিল এবং বঙ্গবন্ধুর খুনি সেনা সদস্যরা তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলতো। বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুক, রশীদ, ডালিম, হুদা, নূর চৌধুরী, মহিউদ্দিনসহ অধিকাংশ খুনির সঙ্গেই জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত বিশেষ সম্পর্ক ছিল। খন্দকার মোশতাক ও জিয়াউর রহমান এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে অবহিত ছিল এবং তাদের সাথে একাধিক বৈঠক হয়েছে বলেও খুনি রশীদ-ফারুকরা তাদের সাক্ষাৎকারে পরবর্তীতে বলেছে।

একারণে, মোশতাকের পর রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে, মোশতাকের ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করে জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ এবং ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেয় স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান।

শুধু তাই নয়, জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে খুনিদের দেশ থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করার পাশাপাশি ১২ জনকে রাষ্ট্রীয় কূটনৈতিক দায়িত্বও প্রদান করেছে। ফলে সরকারি টাকায় বিদেশে বসে রাজকীয় জীবনযাপন করেছে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা। এমনকি অনেকে জিয়ার সহায়তায় দেশের মধ্যেই ব্যবসা করে কোটিপতি হয়ে গেছে অল্প দিনের মধ্যে। এরফলে দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতির চালু হয়। দেশ থেকে উঠে যায় ন্যায় বিচার। জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদসহ বহুমুখী অপরাধের অন্ধকারে ডুবে যায় প্রিয় স্বদেশ।

তবে দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় মতায় আসীন হলে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত করা এবং নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে বিচার সম্পন্ন হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট শাসনের পাঁচ বছর এই রায় কার্যকরের পথে বাধা সৃষ্টি করে রাখা হলেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বর্তমান মহাজোট সরকার গঠনের পর ২০০৯ সালে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের পাঁচজনের রায় কার্যকর হয় ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি। ২০২০ সালের ১১ এপ্রিল দিবাগত রাতে খুনি আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয় কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েক খুনি বিভিন্ন দেশে পালিয়ে রয়েছে।

১০ আগস্ট ১৯৮৯, ধানমন্ডির বাসায় ফের প্রকাশ্যে হামলা:

১৯৭৫ সালে স্বামীর সাথে বিদেশ থাকায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে চান শেখ হাসিনা। তার কাছে বেড়াতে যাওয়ার কারণে তার ছোট বোন শেখ রেহানাও বেঁচে যান। তবে বঙ্গন্ধুকে হত্যার পর ঘাতকদের নিশানায় পরিণত হন বঙ্গবন্ধুর জীবিত দুই কন্যা। ঘাতকদের লক্ষ্য ছিল বাংলার মাটি থেকে বঙ্গবন্ধুর রক্তের নিশানা মুছে ফেলা। তাই প্রাণনাশের বহুমুখী হুমকির মুখে প্রথমে ইউরোপ ও পরে ভারতে আত্মগোপন করে অবস্থান করেন বঙ্গবন্ধুর কন্যারা। দীর্ঘ ৬ বছর নির্বাসন শেষে, অবশেষে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ঘাতক-দল, স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান ও দেশবিরোধী উগ্রবাদীদের ষড়যন্ত্রে আওয়ামী লীগকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা এবং দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠকন্যা শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এরপর আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ ও পুনর্গঠিত করে বাংলার মানুষকে ভাত ও ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ওই বছরের ১৭ মে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা।

সব হারানোর বেদনা বুকে নিয়ে দেশে ফিরেই লাখ লাখ মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হন তিনি। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে ছিল না। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পরেই তাকে হত্যার ছক আঁকে ফ্রিডম পার্টির ঘাতক দল। উল্লেখ্য যে, স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় বঙ্গবন্ধুর ও তার পরিবারের হত্যাকারীদের নেতৃত্বেই সংগঠিত হয়েছিল এই দলটি। তারা বিদেশে নিরাপদ জীবনযাপন এবং দেশে ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয় জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায়।

পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে এই খুনিরা আরেক স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক দল হিসেবে ‘ফ্রিডম পার্টি’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। এরপরই আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করার মিশন বাস্তবায়ন শুরু করে তারা। যার ধারাবাহিকতায় সারা দেশে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর হত্যার মিশন চালানো হয়। এমনকি ১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট রাতে ফ্রিডম পার্টির সন্ত্রাসীরা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে প্রকাশ্যে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনে গুলি ও গ্রেনেড হামলা চালায়। তবে বাসভবনের প্রহরী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের প্রতিরোধের মুখে তাদের সেই অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

তবে স্বৈরশাসক ও বঙ্গবন্ধু হত্যার মদতদাতা জিয়াউর রহমানের মতোই এই খুনিদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতে থাকেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর হামলার প্রতিদান স্বরূপ ১৯৯১ সালে বিএনপি-জামায়াত আমলে সারাদেশ দাপিয়ে বেড়ানোর সুযোগ দেওয়া হয় তাদের। এমনকি ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়া এক ভোটারবিহিন নির্বাচনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও জাতীর চার নেতার খুনি রশীদ (কুমিল্লা) ও খুনি হুদাকে (চুয়াডাঙ্গা) ফ্রিডম পার্টি থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করে সংসদে নিয়ে আসেন এবং রশীদকে বিরোধীদলীয় নেতার আসন দান করেন।

৩০ আগস্ট ২০০২, শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলি ও বোমা:

২০০১ সালে সুক্ষ্ম কারচুপির মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠনের পর সারাদেশে আওয়ামী লীগ ও সংখ্যা লঘু জনগোষ্ঠীর ওর আমানুষিক নির্যাতন শুরু করে। ২০০২ সালের ২৬ আগস্ট সাতক্ষীরার কলারোয়ার হিজলদীতে একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী বিএনপি-জামায়াত সন্ত্রাসীদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়ে সাতক্ষীরা হাসপাতালে ভর্তি হন।

৩০ আগস্ট বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা খুলনা সফরের সময় এই খবর পেয়ে তাকে দেখতে সাতক্ষীরা যান। পথে কলারোয়া উপজেলায় শেখ হাসিনার গাড়িবহরের ওপর গুলি ও বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এসময় নিরাপত্তারক্ষীরা তাকে দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেন। এই হামলায় কয়েকজন সফরসঙ্গী আহত হন। এমনকি তার সঙ্গে থাকা সাতক্ষীরার ১২ সাংবাদিক আক্রান্ত হন।

২১ আগস্ট ২০০৪, রাষ্ট্রীয় মদতে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে হত্যাচেষ্টা:

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের এক সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও নিহত হন আইভি রহমানসহ ২৪ নেতাকর্মী। হামলায় আরও প্রয় চার-শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। আহতদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। তাদের কেউ কেউ আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি। এই ঘটনায় মানববর্ম রচনা করে শেখ হাসিনাকে প্রাণে রক্ষা করেন দলের নেতাকর্মীরা। প্রাণে বেঁচে গেলেও শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার।

পরবর্তীতে জজ মিয়া নামের এক ব্যক্তিকে দিয়ে গ্রেনেড হামলার বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে বিএনপি-জামায়াত সরকার। তবে ২০০৭ সালের সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ওই হামলার ঘটনায় পুনরায় তদন্ত হয়। সেখানে নিষিদ্ধ সংগঠন হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান এবং তৎকালীন বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর নাম আসে। অপরাধীদের স্বীকারোক্তির মাধ্যমে বিএনপি’র অন্যতম শীর্ষ নেতা তারেক রহমান, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ বেশ কয়েকজন বিএনপি নেতা এবং সরকারি কর্মকর্তার নাম ফাঁস হয়ে পড়ে। বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা জানান, হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড এসেছিল পাকিস্তান থেকে।

এই ঘটনার বিষয়ে পরবর্তীতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতেই ২১শে অগাস্টের হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে এবং এই হত্যাকাণ্ডে রাষ্ট্রযন্ত্র জড়িত ছিল বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন- ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টের মতোই ২০০৪ সালের ২১ অগাস্টের হামলার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে হত্যা এবং আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে চাওয়া হয়েছিল৷ আর এই ষড়যন্ত্রে তখনকার সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র জড়িত। তারেক রহমানের হাওয়া ভবনে বসে এই হামলার ষড়যন্ত্র হয়েছে৷’

এমনকি তদন্তকারী কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ভাগ্নে ও তার একান্ত সচিব সাইফুল ইসলাম ডিউক জানিয়েছেন, ২১ আগস্ট হামলার অস্ত্র ও বোমা সরবরাহকারী মাওলানা তাজউদ্দীন সম্পর্কে তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই। শেখ হাসিনার ওপর হামলার পর তারেক রহমানের নির্দেশে তাকে পাকিস্তানে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে তৎকালীন বিএনপি সরকার। এমনকি মুফতি হান্নানও এই হামলার আগে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের কথা স্বীকার করেছে।

১৭ আগস্ট ২০০৫, উগ্রবাদীদের জাতীয় সন্ত্রাস:

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর দেশের সাধারণ মানুষের ওপর লুটপাট, ধর্ষণ ও বোমা হামলার অপসংস্কৃতি শুরু হয়। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ শেষের দিকে পরবর্তী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নাশকতা শুরু করে তারা। তাদের ইন্ধনে রমনার বটমূলে ছায়ানটের বৈশাখ-বরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হয়, আহত হন অনেকে। এই হামলায় জড়িত হুজি নেতা মুফতি হান্নান, মাওলানা তাজউদ্দীনরা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গেও জড়িত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে বেরিয়ে আসে- এই চক্রটি তারেক রহমান ও হাওয়া ভবনের সঙ্গে সংযুক্ত।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই দানবের মতো আত্মপ্রকাশ করে জঙ্গি সংগঠন জেএমবি, সারাদেশে বোমা বিস্ফোরণ ঘটাতে শুরু করে তারা। ২০০১ সালে সাতক্ষীরা, ২০০২ সালে নাটোর ও ময়মনসিংহের একাধিক স্থানে একযোগে বোমা হামলা করে তারা। এছাড়াও চলতে থাকে বাংলা ভাইদের সন্ত্রাসের রাজত্ব। মানুষকে হত্যা করে গাছের সঙ্গে প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে রাখতে শুরু করে এই উগ্রবাদীরা।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এসব ঘটনার কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায়, এমনকি তাদের মদত দিয়ে আওয়ামী লীগ দমনের নীতি গ্রহণ করায়, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট একযোগে ৬৩ জেলার ৪৩৪ স্থানে বোমার বিম্ফোরণ ঘটানোর সাহস দেখায় জঙ্গি সংগঠন জেএমবি। সেই ঘটনায় ২ জন নিহত ও আহত হয় শতাধিক। এরপর সারাদেশে তাণ্ডব চালাতে থাকে মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলো। পরবর্তী সময়ে কয়েকটি ধারাবাহিক বোমা হামলায় তাদের হাতে বিচারক ও আইনজীবীসহ ৩০ জন নিহত ও আহত হন চার শতাধিক ব্যক্তি। একই বছরের ৩ অক্টোবরে চট্টগ্রাম, চাঁদপুর এবং লক্ষীপুরের আদালতে জঙ্গিরা বোমা হামলা চালায়। এতে তিনজন নিহত এবং বিচারকসহ কমপক্ষে ৫০ জন আহত হন।

পরবর্তীতে জঙ্গিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বরাত দিয়ে বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর সংবাদ থেকে জানা গেছে, সেই সময়ের ক্ষমতাসীন দলের (বিএনপি-জামায়াত) কোনো কোনো নেতা এসব নৈরাজ্যকর ঘটনায় পৃষ্ঠপোষকতা করতো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *