ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, করোনাকালে ইন্টারনেট, টেলিযোগাযোগ এবং ডাক বিভাগ বাংলাদেশের শ্বাস-প্রশ্বাসের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে। সরকার এগুলোকে সচল রাখার চেষ্টা করছে। মন্ত্রী বলেন, আগামী দুই বছরের মধ্যে টেলিটককে আমরা একটা পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই। সে লক্ষ্যে বেশ কিছু উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রকট না হলে এই উদ্যোগ এতদিনে অনেক দূর এগিয়ে যেত। ডাক বিভাগকে আরও আধুনিক ও গতিশীল করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেছেন, বর্তমানে ডাক বিভাগের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো কোনো কুরিয়ার সার্ভিস দেশে নেই। ডাক বিভাগের মাধ্যমেই মানুষ পার্সেল, ই-কমার্স লেনদেন করবে। আমরা সেই পর্যায়েই নিয়ে যাচ্ছি। মোস্তাফা জব্বার গতকাল দুপুরে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে একান্ত সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে কথা বলছিলেন। টেলিযোগাযোগমন্ত্রী বলেন, দেশ স্বাধীনের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টেলিযোগাযোগ খাতের যাত্রা শুরু করে দিয়েছিলেন। তারপর বহু সময় গেলেও দেশের টেলিযোগাযোগ খাত যেভাবে অগ্রসর হওয়ার কথা ছিল সেভাবে হয়নি। তিনি বলেন, ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খানের মালিকানাধীন সিটিসেল চালু করা হয়। সিটিসেলকে আউটগোয়িং কলের জন্য ১৪ টাকা আর ইনকামিং কলে ১২ টাকা দিতে হতো। ১৯৯৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও চারটি কোম্পানিকে লাইসেন্স দিলে সিটিসেলের একচেটিয়া ব্যবসা ভেঙে যায়। মোস্তাফা জব্বার বলেন, আবার ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর কিছুটা সময় নিয়ে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী হাতে নেওয়া ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যক্রম শুরু করতে একটু সময় লেগেছিল। একেবারে গ্রাম পর্যায়ে ইন্টারনেট না পৌঁছা কিংবা তার সুযোগ থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ বঞ্চিত- এ কথা জানানো হলে টেলিযোগাযোগমন্ত্রী বলেন, মোবাইল কোম্পানিগুলো যে পরিমাণ স্পেকট্রাম কেনার কথা ছিল সে পরিমাণ কিনেনি। তারা যদি স্পেকট্রাম কিনত বা বিনিয়োগ করত তাহলে আমাদের দেশের ইন্টারনেটের চেহারা অন্যরকম থাকত। মন্ত্রী বলেন, সরকার থেকে যে পরিমাণ সুযোগ সুবিধা মোবাইল কোম্পানিগুলো নিয়েছে সেই অনুপাতে বিনিয়োগ করেনি। গ্রামীণফোন সবচেয়ে বড় অপারেটর। তারাই সবচেয়ে পিছিয়ে। রবি ও বাংলালিংক কিছুটা করলেও বাংলালিংকের নেটওয়ার্ক দুর্বল। তাই, আশানুরূপ সেটা হয়নি। আমাদেরও কিছুটা ঘাটতি আছে। যার ফলে আমরা একেবারে গ্রাম পর্যায়ে ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছাতে পারিনি। সরকারি প্রতিষ্ঠান হয়েও মোবাইল অপারেটর টেলিটক কেন সারা দেশে তাদের গ্রাহক তৈরি করতে পারল না? জবাবে মোস্তাফা জব্বার বলেন, টেলিটকে ওইভাবে বিনিয়োগ হয়নি। সরকারিভাবে যতটুকু সাপোর্ট দেওয়ার দরকার ছিল সেটাও হয়নি। এজন্য আমি ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কথা বলব না। আমি মনে করি, আমাদের যারা নীতিনির্ধারক ছিলেন তারা টেলিটকের গুরুত্ব অনুভব করতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রী তো সব বিষয়ে দেখবেন না। নীতিনির্ধারকদের যারা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দফতরে আছেন তারা এটার গুরুত্ব অনুধাবন করেননি। নইলে আজ ‘টেলিটক’ই বাংলাদেশের এক নম্বর মোবাইল অপারেটর হতো। মন্ত্রী বলেন, করোনার আগেই টেলিটকের বিষয়ে আমি একটা প্রস্তাব একনেকে তুলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী ওটা দেখে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আমরা এখন তা নিয়ে কাজ করছি। তিনি বলেন, তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ ছিল। আমরা তাকে ৬ হাজার কোটি টাকায় নিয়ে গেছি। আশা করছি আগামী দুই বছরের মধ্যে টেলিটককে একটা পর্যায়ে নিয়ে যেত পারব। তিনি বলেন, টেলিটক নিয়ে দেশের মানুষের বিপুল আগ্রহ আছে। এর বিরাট সম্ভাবনাও আছে। শুধু নেটওয়ার্কটা পৌঁছে দেওয়া দরকার। তাহলেই মানুষ টেলিটককে নেবে। আমরা এখন সেই কাজটিই করছি। তিনি বলেন, সরকার একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। দেশের হাওরাঞ্চল, চরাঞ্চল, দুর্গম পাহাড়ি এলাকাসহ যেসব দুর্গম এলাকা আছে সেখানে টেলিটকের নেটওয়ার্ক পৌঁছে দেওয়ার কাজ। সেখানে শুধু টেলিটক অপারেট করবে। অন্য কেউ নয়। এই কাজ এখন চলছে।
এক প্রশ্নের জবাবে মোস্তাফা জব্বার বলেন, একটা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যা একনেক অনুমোদন করেছে। এর মাধ্যমে টেলিটককে উন্নত করতে পারব। এজন্য ইতিমধ্যে সৌদি আরব, চীন ও কোরিয়ার সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। তারা প্রত্যেকেই এখানে বিনিয়োগ করতে চান। এর মধ্যে সৌদি আরব চায় শেয়ারহোল্ডার হতে, আর চীন ও কোরিয়া একেবারে স্বল্প সুদে টেলিটকে বিনিয়োগ করতে চায়। আমরা পর্যালোচনা করে যেটা সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে সেটাই করব।
বিটিসিএল প্রসঙ্গ তুলে ধরে টেলিযোগাযোগমন্ত্রী বলেন, এই সংস্থা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এর অনেক সম্ভাবনা আছে। সামনে আরও কাজ আছে। বিটিসিএল সারা দেশে ৫৮৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফ্রি ওয়াইফাই সংযোগ দিয়েছে। যা এই করোনাকালে শিক্ষার্থীদের বিরাট উপকারে এসেছে। তিনি বলেন, দেশের দুর্গম এলাকায় প্রতিটি ইউনিয়নে আটটি করে ওয়াইফাই জোন করে দিচ্ছি। সরকারের লক্ষ্য শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ে ইন্টারনেট সুবধিা পৌঁছে দেওয়ার। সেই চেষ্টা আমরা করে যাচ্ছি। ২০১৮ সালে সরকার ফোর জি সম্প্রসারণ করেছে, কিন্তু সেটি এখনো গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছেনি। আগামী এক বছরের মধ্যে একেবারে গ্রাম পর্যায়ে ফোর জি সুবিধা পৌঁছে দিতে চাই। বর্তমানে ৫-৬ হাজার ফোর জি টাওয়ার আছে। সারা দেশে মোবাইল অপারেটরগুলোর ১৫-১৬ হাজার টাওয়ার আছে। সরকার বলে দিয়েছে, সবগুলোকে যেন ফোর জিতে কনভারশন করা হয়। কাজও চলছে। ফিক্সড ব্রডব্যান্ড প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, ইতিমধ্যে সারা দেশে ৩ হাজার ৮০০ ইউনিয়নে ফাইভার অপটিক্যাল লাইন স্থাপনের মাধ্যমে ব্রডব্যান্ড পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। বাকি ৭৭৭টি ইউনিয়নে এই অর্থ বছরের মধ্যে পৌঁছে যাবে। ইউনিয়ন থেকে একেবারে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত ব্রডব্যান্ড পৌঁছে গেছে। ডাক বিভাগের বর্তমান চিত্র ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে ডাকমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এই যুগে যদি মনে করা হয় যে মানুষ ডাকবাক্সে চিঠি ফেলবে আর সেটা পৌঁছে দেওয়া হবে, তা নয়। এখন পার্সেল, ই-কমার্স লেনদেন করার কোনো বিকল্প নেই। সারা দেশে ৯ হাজারের মতো ডাকঘর আছে। অনেক ডাকঘর নতুন করে সংস্কার করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ডাক বিভাগের জন্য ১৮০টি গাড়ি কিনতে অর্থ দিয়েছেন। ১৪টি স্লটিং সেন্টার করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ৬৪ জেলায় স্লটিং সেন্টার করতে। তিনি বলেন, এই করোনাকালে সারা দেশে সব ডাকঘর খোলা। হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডাক বিভাগের লোকজন কাজ করেছেন। আমরা ডাকঘরে নতুন সেবা চালু করেছি। ‘কৃষকের পাশে থাকা’ নামের এই সেবা চালুর মাধ্যমে করোনাকালে ডাক বিভাগের গাড়ি যেসব এলাকায় গেছে সেসব এলাকা থেকে ফেরার পথে কৃষকের শাকসবজি নিয়ে এসেছে। এক স্থান থেকে আরেক স্থানে পৌঁছে দিয়েছে। একেবারে মাঠ থেকে পণ্য তুলে এনে সুপারশপগুলোতে পৌঁছে দিয়েছে বিনামূল্যে। কৃষকও কোনো মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়াই সরাসরি টাকা পেয়েছে। তিনি বলেন, আমরা এখন ‘কৃষক বাজার’ চালু করার প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এতে করে কোনোরকম মধ্যস্বত্বভোগী থাকবে না। কৃষক সরাসরি লাভবান হবে। এ ছাড়া ডাকঘর এখন ডিজিটাল সার্ভিস দেবে। ফলত সারা দেশে ১৭ হাজার ডিজিটাল ডাকঘরের উদ্যোক্তা লাভবান হবেন।