রাজধানীর উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের কভিড ডেডিকেটেড রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালানোর পর এবার তা সিলগালা করে দিয়েছে এলিট ফোর্স র্যাব। গতকাল র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার বিন কাশেমের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত হাসপাতালটি সিলগাল করে দেয়। অন্যদিকে রিজেন্ট হাসপাতালে র্যাবের অভিযানের পর প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. মোহাম্মদ শাহেদসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা দায়ের করেছে র্যাব। মোহাম্মদ শাহেদের অপকর্মের একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য বের হয়ে আসছে। এ হাসপাতালে অনিয়মই ছিল যেন নিয়ম। আর নিজের সুবিধার জন্য এমন কোনো অন্যায়-অপকর্ম নেই, যা প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান করেননি। সোমবার বিকাল থেকে রাত অবধি উত্তরা রিজেন্ট হাসপাতালটির মূল কার্যালয়ে প্রথমে অভিযান পরিচালনা করে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। সেখান থেকে অভিযান শেষে হাসপাতালটির মিরপুর শাখায় অভিযান চালানো হয়। হাসপাতালটিতে নভেল করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা না করেই ইচ্ছামতো ‘নেগেটিভ’, ‘পজিটিভ’ ফল বসিয়ে দেওয়া হতো রোগীদের। এ ছাড়া আরও কিছু অভিযোগে হাসপাতালটির আটজনকে আটক করা হয় গতকাল রাতেই। একই সঙ্গে হাসপাতালটির উত্তরার মূল কার্যালয় সিলগালা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের গোয়েন্দাপ্রধান লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বলেছেন, ‘রিজেন্ট হাসপাতাল পরীক্ষা না করে করোনার রিপোর্ট দেওয়াসহ নানা অপরাধমূলক কাজ করে আসছিল। সেসবের প্রমাণও আমরা পেয়েছি। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে হাসপাতালটির মূল কার্যালয় সিলগালা করে দিয়েছি। এ ছাড়া রিজেন্ট গ্রুপের মূল কার্যালয় সিলগালা করা হয়েছে। হাসপাতালটিতে ১০ থেকে ১৫ জন করোনা রোগী আছেন। তাদের কুর্মিটোলায় পাঠানো হচ্ছে।’
রিজেন্ট হাসপাতাল থেকে অননুমোদিত র্যাপিড টেস্টিং কিট ও হাসপাতালটির চেয়ারম্যানের ব্যবহৃত একটি গাড়ি জব্দ করা হয়। তিনি বলেন, ‘ওই গাড়িতে ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের স্টিকার লাগানো ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজনের চোখে ধুলো দিতেই ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের স্টিকার ব্যবহার করা হতো। সে গাড়ি জব্দ করেছি। রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগে অভিযান চালানো হয়েছিল, সেসবের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ পর্যন্ত চেয়ারম্যানসহ ১৭ জনের সংশ্লিষ্টতা আমরা পেয়েছি। এদের ব্যাপারে মামলা হবে।’
জানা গেছে, বিনামূল্যে কভিড পরীক্ষার অনুমোদন নিয়ে প্রতিবার নমুনা সংগ্রহের জন্য নেওয়া হতো সাড়ে ৩ হাজার টাকা। যদিও রিপোর্ট যাচাই করে দেখা যায় বেশির ভাগই ভুয়া। এরই মধ্যে ১০ হাজার নমুনা সংগ্রহ করেছে রিজেন্ট হাসপাতাল। তবে পলাশ নামে তাদের এক কর্মকর্তা আইপিএইচ থেকে ৪ হাজার ২৬৪টি পরীক্ষা করিয়েছেন। কিন্তু সেখানে কোনো রোগীরই ঠিকানা দেওয়া হয়নি। বাকি নমুনাগুলো সিলপ্যাড ব্যবহার করে ভুক্তভোগীদের সরবরাহ করেছে রিজেন্ট হাসপাতাল। প্রতিজনের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। এর অনেকেই প্রথমবার ‘নেগেটিভ’ আসায় দ্বিতীয়বার ১ হাজার টাকা দিয়ে পুনরায় পরীক্ষা করিয়েছেন। এভাবেই কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে মিরপুরের রিজেন্ট হাসপাতাল। এদিকে উত্তরায় রিজেন্ট গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে অসংখ্য অনুমোদনহীন কভিড টেস্টিং কিট পেয়েছে র্যাব। নমুনা সংগ্রহের বুথ নয়, নয় কভিড পরীক্ষা কেন্দ্র, তবু মিলেছে অসংখ্য কিট, যেগুলোর নেই কোনো অনুমোদন। এমন চিত্র দেখা গেছে রাজধানীর উত্তরায় রিজেন্ট গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ে। গতকাল দুপুরে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে মেলে কভিড পরীক্ষার বেশকিছু ভুয়া রিপোর্টও।
র্যাব সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম জানান, করোনার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসা ও বাড়িতে থাকা রোগীদের করোনার নমুনা সংগ্রহ করে ভুয়া রিপোর্ট প্রদান করত রিজেন্ট হাসপাতাল। এ ছাড়া সরকার থেকে বিনামূল্যে কভিড-১৯ টেস্ট করার অনুমতি নিয়ে রিপোর্টপ্রতি সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা করে আদায় করত। এভাবে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে মোট ৩ কোটি টাকা হাতিয়েছে রিজেন্ট।
অভিযোগের অন্ত নেই : ২০১০ সালের দিকে এই সাহেদ করিম নিজেকে সেনাবাহিনীর সাবেক কর্নেল পরিচয় দিয়ে বিডি ক্লিক নামের একটি এমএলএম কোম্পানি খুলে হাতিয়ে নেন শত শত কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্তরা তার নামে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানায় মামলা করেছেন। কেবল ধানমন্ডি থানাতেই সাহেদ করিমের বিরুদ্ধে ১৮টি সাধারণ ডায়েরি ও মামলা রয়েছে।
এদিকে রিজেন্ট হাসপাতাল ভবনের মালিক জাহানারা কবির অভিযোগ করেন, চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তার ভবন দখলে রাখা হয়েছে। চলে যেতে বললেই হুমকি দেওয়া হতো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নামে। বিনামূল্যে পরীক্ষার কথা থাকলেও রিজেন্ট হাসপাতালে সেবাপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহে নেওয়া হতো সাড়ে ৩ হাজার টাকা করে।
২০১৪ সালের পর নবায়ন হয়নি উত্তরা শাখার লাইসেন্স। আর ২০১৭ সালের পর নবায়ন হয়নি মিরপুর শাখার অনুমোদন। লাইসেন্স নবায়ন না হওয়ার পরও প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে কভিড হাসপাতালের চুক্তি জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের। যদিও রিজেন্ট কর্তৃপক্ষ নবায়ন না হওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন।
১৫ মে সরকারিভাবে নিযুক্ত দুজন চিকিৎসক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব বরাবর আলাদা দুটি চিঠিতে রিজেন্ট হাসপাতালের বিভিন্ন ত্রুটি বিষয়ে অবহিত করেন। তারা হাসপাতালে থাকা চারটি আইসিইউতে ত্রুটিপূর্ণ সেন্ট্রাল অক্সিজেন ও তিনটি ভেনটিলেটর থাকার কথা জানান। এ ছাড়া আইসিইউতে দক্ষ জনবল না থাকা ও জরুরি কভিড-১৯ পরীক্ষা করার ব্যবস্থা না থাকার কথাও জানান তারা। ওষুধ ও সুরক্ষাসামগ্রীর ঘাটতির বিষয়েও জানানো হয় চিঠিতে। প্রয়োজনীয় উপকরণ ও জনবল না পাওয়ার বিষয়ে হাসপাতাল চেয়ারম্যানকে জানানো হলে তিনি চিকিৎসকদের হুমকি ও ভয়ভীতি দেখান। এমনকি তাদের সঙ্গে বাজে ব্যবহারও করেছেন বলে অভিযোগ চিকিৎসকদের।
সরকারিভাবে ১৬ মে পর্যন্ত চিকিৎসক নিয়োগ থাকলেও রিজেন্ট হাসপাতালে বিভিন্ন সময় রোগীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চিকিৎসা করানো হতো। একই সঙ্গে আছে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ। এ হাসপাতালে কেবল ভর্তি থাকা রোগীদের নমুনা পরীক্ষা করানোর অনুমতি থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীরা বাসায় গিয়ে নমুনা পরীক্ষা করতেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানের সনদ জাল করে নমুনা পরীক্ষার ফল জানানোর অভিযোগও আছে রিজেন্টের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে একাধিক অভিযোগ গেছে স্বাস্থ্য অধিদফতরে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আমিনুল হাসান বলেন, ‘আমাদের কাছে যতবার অভিযোগ এসেছে, ততবারই আমরা প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. সাহেদকে ফোন করে জানিয়েছি। এর পরও কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নিতে দেখিনি। রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে আমাদের চিঠি চালাচালি অনেক হয়েছে এটা সত্যি। প্রথম দিকে আসলে এ হাসপাতালটি এগিয়ে আসায় আমরা চিকিৎসাসেবা দেওয়ার বিষয়ে রাজি হই। পরে নানা অনিয়মের কারণে তাদের সঙ্গে আমাদের সমঝোতা চুক্তিতে পরিবর্তন আনতে হয়।’
১ জুন রিজেন্ট হাসপাতাল চেয়ারম্যান মো. সাহেদের সই করা এক চিঠিতে হাসপাতালের উত্তরা শাখায় ৯০ লাখ ৫০ হাজার ও মিরপুর শাখায় ১ কোটি ৯৬ লাখ ২০ হাজার টাকা দিতে অনুরোধ করা হয়। হাসপাতালের দুই শাখার মাসিক খরচ হিসেবে উল্লেখ করা হয় টাকার এ অঙ্ককে। এ সময় সমঝোতা স্মারক সংশোধন করে আগের সমঝোতার তারিখ থেকে এ খরচ রিজেন্ট হাসপাতালকে দিতে অনুরোধ করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধিদফতরের পরিচালক ডা. আমিনুল হাসান বলেন, ‘তারা আমাদের কাছে বিল চেয়েছে কিন্তু আমরা তা দিইনি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুরোধে আমরা আমাদের চিকিৎসকদের প্রত্যাহার করে নিই।’ তবে রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে প্রাথমিক সমঝোতা চুক্তিতে কী ছিল, তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি ডা. আমিনুল হাসান।
রিজেন্ট হাসপাতালের সব কার্যক্রম বাতিল : করোনাভাইরাসের চিকিৎসা ও নমুনা পরীক্ষায় নানা অনিয়ম-প্রতারণার অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতালের সব ধরনের কার্যক্রম বাতিল করা হয়েছে। এর ফলে হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখায় আর কোনো ধরনের কার্যক্রম চলতে পারবে না। গতকাল বিকালে স্বাস্থ্য অধিদফতর এ হাসপাতালের সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আমিনুল হাসান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। ডা. আমিনুল বলেন, রিজেন্ট হাসপাতালের সব কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। হাসপাতালটি কোনো কার্যক্রম চালাতে পারবে না। এরই মধ্যে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন প্রস্তুত করা হয়েছে। কিছু সময়ের মধ্যেই এ-সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে পৌঁছে যাবে। আদেশে বলা হয়, এসব অনিয়মের কারণে ‘দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ রেগুলেশন অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২’ অনুযায়ী হাসপাতালটির কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হলো।
ছয় বছর আগেই লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ : খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স আপডেট করা হয়ে থাকে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে। প্রতিষ্ঠানটিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যে কোনো বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স দেওয়া হয় এক বছরের জন্য। এ ক্ষেত্রে বছরের যে কোনো সময়ই নেওয়া হোক না কেন, অর্থবছর হিসাব করে ৩০ জুন লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী ৫০ শয্যার রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা শাখার (ঠিকানা : বাড়ি # ৩৮, রোড # ১৭, সেক্টর # ১১, উত্তরা, ঢাকা) লাইসেন্স দেওয়া হয় ২০১৩ সালের ৮ ডিসেম্বর। এ মেয়াদ শেষ হয় ২০১৪ সালের ৩০ জুন। রক্ত সঞ্চালন কার্যক্রম ছাড়া এ শাখায় প্যাথলজিক্যাল ল্যাবের লাইসেন্স (নম্বর ৭৮৭৬) দেওয়া হয় ২০১৩ সালের ৮ ডিসেম্বর। এর মেয়াদও শেষ হয় ২০১৪ সালের ৩০ জুন। অর্থাৎ ছয় বছর আগেই রিজেন্ট হাসপাতাল উত্তরা শাখার সব লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। একইভাবে ২০১৭ সালের ২৩ মার্চ রিজেন্ট হাসপাতালের ৫০ শয্যাবিশিষ্ট মিরপুর শাখার (১৪/১১ মিতি প্লাজা, মিরপুর-১২, ঢাকা) লাইসেন্স দেওয়া হয়, যার মেয়াদ শেষ হয় ২০১৭ সালের ৩০ জুন। অর্থাৎ মিরপুর শাখাটির মেয়াদও শেষ হয়েছে তিন বছর আগে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আমিনুল হাসান বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানানো হয়েছে। তাদের কাগজপত্র আপডেট করার বিষয়েও জানানো হয়েছে। তবে তাদের কাগজপত্র এখনো আপডেট হয়নি।