ঝুঁকির মুখে হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড!

উন্নয়ন

বিভিন্ন সেবা সংস্থার সঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) কাজের সমন্বয় না থাকায় কোটি কোটি টাকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড টেকসই হচ্ছে না। বিভিন্ন অবকাঠামো নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং ওয়াসার বক্স কালভার্ট, খাল ও পাম্পগুলো যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ না করায় জলাবদ্ধতা নিরসন করা সম্ভব হচ্ছে না। সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে কাজের সমন্বয় না থাকায় নাগরিক ভোগান্তি কমছে না।

এক সংস্থার রাস্তা, ফুটপাত বা ড্রেনেজ খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শেষ হওয়ার পর আরেক সংস্থার কাজ শুরু হয়। এতে বাড়ছে জনদুর্ভোগ। ‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন’ শীর্ষক চলমান প্রকল্পের নিবিড় পরিবীক্ষণে এ চিত্র উঠে এসেছে। আবার করোনাভাইরাসের কারণে যথাসময়ে কাজ শেষ না হওয়ারও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) জুনে প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করে।

ডিএসসিসি’র প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম সোমবার যুগান্তরকে বলেন, এটা বাস্তবতা। আমরা রাস্তা তৈরি করি পরে অন্য সংস্থাগুলো কাটাকাটি করে। এ সমস্যা সমাধানে সিটি গভর্মেন্ট ব্যবস্থা ছাড়া সমাধান সম্ভব নয়। এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা গেলে অন্য সব সেবা সংস্থার নেতৃত্বেও থাকতেন মেয়র। তখন সেটি তদারক বা সমন্বয় করা সহজ হতো। এসব সমস্যার সমাধানে বর্তমান মেয়র তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন।

সূত্র জানায়, উন্নত নাগরিক সেবা দিতে প্রকল্পের আওতায় ঢাকা মহানগরের রাস্তা, নর্দমা ও ফুটপাত উন্নয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে নগরবাসীর জন্য একটি নিরাপদ ও কার্যকরী সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার কার্যক্রম চলছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা এবং ফুটপাত ব্যবহারের মাধ্যমে জনগণের সহজ চলাচল নিশ্চিত করা হবে। এটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় হচ্ছে এক হাজার ৭১৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের নেয়া প্রকল্পটির প্রধান কার্যক্রমগুলো হল- সড়ক ও ফুটপাত উন্নয়ন, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, এলইডি লাইট স্থাপন, ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ ও উন্নয়ন, বাস স্টপেজ/যাত্রীছাউনি/পুলিশ বক্স ও মিডিয়ানের সৌন্দর্য বর্ধন, পাবলিক টয়লেট নির্মাণ ও উন্নয়ন, পার্ক ও খেলার মাঠ উন্নয়ন, ধানমণ্ডি লেক সংস্কার, আধুনিক কসাইখানা নির্মাণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সেকেন্ডারি ট্রান্সফরমার স্টেশন স্থাপন, কবরস্থান উন্নয়ন, হাসপাতাল উন্নয়ন, নগরীর পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য আবাসিক ভবন নির্মাণ এবং নগরভবন সংস্কার।

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূল অনুমোদিত প্রকল্পটি ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু পরে প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে এক বছর বাড়িয়ে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ করা হয়। এতেও কাজ শেষ না হওয়ায় দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে দুই বছর মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে।

এদিকে প্রকল্পটির মূল ব্যয় ছিল এক হাজার ২০২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। প্রথম সংশোধনীতে কিছু বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ২১৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। দ্বিতীয় সংশোধনীতে ৫০২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা বাড়িয়ে মোট ব্যয় করা হয়েছে এক হাজার ৭১৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে ব্যয় বেড়েছে ৪১ দশমিক ৩৩ শতাংশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ৯৫ শতাংশ সরকারের নিজস্ব তহবিলের এবং পাঁচ শতাংশ ডিএসসিসি’র নিজস্ব তহবিলের অর্থ ব্যয় হচ্ছে।

প্রতিবেদনে আইএমইডি বলেছে, প্রধান পূর্ত প্যাকেজের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। প্রকল্পটির আওতায় ডিএসসিসির নতুন পাঁচটি অঞ্চলের ১৮টি ওয়ার্ডের একটি এলাকাও অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ভূমি দখল, মালিকানা সমস্যা, কর্ম এলাকা হস্তান্তরে বিলম্ব, সীমানা নির্ধারণে দেরি হওয়ায় ভৌত কাজের বিশেষ করে পার্ক ও খেলার মাঠের কাজ বাস্তবায়নে দেরি হচ্ছে।

এছাড়া রাজনৈতিক, সামাজিক ও এলাকাবাসীর নতুন নতুন প্রস্তাবের মুখে বিভিন্ন ভৌত কাজ করতে গিয়ে অতিরিক্ত ভৌত কাজের প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে। ফলে একটি সাইটে একাধিক প্যাকেজ হাতে নেয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। একটি সাইটে একাধিক প্যাকেজ করায় প্রকল্পের কাজে ওভারলেপিংয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

প্রকল্পের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই শেষ হওয়া কাজগুলো সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। বিভিন্ন সেবা সংস্থার সঙ্গে ডিএসসিসির কাজের সমন্বয়ের অভাবে দেখা যায়, একটি রাস্তা ঠিক করার কিছুদিনের মধ্যেই অন্য সংস্থা রাস্তাটি খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে। ফলে জনগণের ভোগান্তির কোনো অন্ত থাকে না।

মানুষের ভোগান্তির কথা বিবেচনা করে বেশির ভাগ রাস্তার কাজ রাতে বাস্তবায়ন করা হয়। এক্ষেত্রে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের কাজের গুণগত মান পুরোপুরি নিশ্চিত করতে পারে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

এছাড়া ডিএসসিসির আঞ্চলিক কার্যালয়ে জনবলের তুলনায় কাজের চাপ অত্যধিক এবং উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে জনবলের প্রকট ঘাটতি রয়েছে। একই সঙ্গে এলাকাভিত্তিক সম্পন্ন হওয়া কাজ সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের জন্য এখনও কোনো নীতিমালা এবং কমিটি গঠন করা হয়নি।

এক্ষেত্রে রক্ষণাবেক্ষণ ও পর্যবেক্ষণে পর্যাপ্ত জনবল এবং রাজস্ব খাত থেকে অর্থায়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বিভিন্ন সেবা সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ের অভাবে প্রকল্পটির মাধ্যমে বাস্তবায়িত কাজগুলো টেকসই করা যায়নি। ফুটপাতে হকার ও অবৈধ দখলদারের কারণে জনসাধারণ চলাচলের জন্য ফুটপাত ছেড়ে রাস্তা ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছেন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৮টি পার্ক ও ১১টি খেলার মাঠের উন্নয়ন করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এসব পার্ক ও খেলার মাঠ ব্যবহারের নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়নি। ফলে মাঠগুলোতে যদি মেলা, সমাবেশ বা বাঁশ ব্যবহারের সুযোগ দেয়া হয় তাহলে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত মাঠের ঘাস এবং সৌন্দর্য বিনষ্ট হতে পারে। কোভিড-১৯ ভাইরাসের কারণে প্রকল্পের কাজ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় যথাসময়ে সব কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নাও হতে পারে।

প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়- সিটি কর্পোরেশনের নাগরিক সেবা প্রদান, জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং নগরীর পরিবেশ সুন্দর করতে প্রকল্প বাস্তবায়ন যেমন জরুরি, তেমনি এসব বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *