ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়াঃ
দেশদ্রোহিতার চেয়ে বড় কোনো পাপ নেই- ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী স্বার্থে দেশবিরোধী কর্মকান্ডে যুক্ত হওয়া অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ। আমাদের জাতিগত মুক্তি ও অগ্রগতির পথে এ দেশেরই কিছু মানুষ বারবার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের সুমহান স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যে দেশদ্রোহী-জাতিদ্রোহী গোষ্ঠী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেছিল, সরাসরি দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল, আমাদের মা-বোনদের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিল তাদের উত্তরসূরিরা এখনো আমাদের জাতিগত উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে আছে। এ অপশক্তির বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্র এবং বাংলাদেশের অন্তর্নিহিত আদর্শ ও চেতনা বিরোধী অপপ্রয়াস বাস্তবায়নে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা, জাতীয় চার নেতাকে হত্যা, দীর্ঘ স্বৈরশাসনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় পরিচালিত করা হয়। আজও একটি মহল অনুরূপভাবে দেশের স্বার্থবিরোধী কর্মকান্ডে নিয়োজিত রয়েছে। এ দেশের রাজনীতিতে যেমন দেশবিরোধী একটি গোষ্ঠীর শক্ত অবস্থান রয়েছে তেমনি অন্যান্য ক্ষেত্রেও এর প্রভাব বিদ্যমান। পৃথিবীর এমন কোনো সভ্য দেশ নেই যেখানে সমাজের বিশিষ্টজনেরা দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো অবস্থান গ্রহণ করেন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আমাদের দেশে এ ধরনের সমস্যা প্রকট। আমাদের জাতিগত অগ্রগতির ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে রয়েছে এ বিরোধিতার ন্যক্কারজনক অধ্যায়।
সাম্প্রতিক সময়ের বাংলাদেশ উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির নতুন এক সোপানে উদ্ভাসিত। সফল রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও ভিশনারি নেতৃত্বে শত বাধা পেরিয়ে পাহাড়সম ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়িত হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে বিশ্বসভায় বাংলাদেশ আজ অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত। পদ্মা সেতু হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের আত্মমর্যাদা ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রতীক। ২৫ জুন, ২০২২ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে যেমন পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের সফলতার গল্প প্রচারিত হয়েছে ঠিক অন্যদিকে পদ্মা সেতু প্রকল্পবিরোধী ষড়যন্ত্রের কথাও উঠে এসেছে। ষড়যন্ত্রের কলঙ্কজনক অধ্যায়ে বারবার একজন বিশিষ্টজনের নামও উচ্চারিত হয়েছে। তথাকথিত দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতু প্রকল্পে প্রতিশ্রুত অর্থায়ন বন্ধের পেছনে যে ষড়যন্ত্র রয়েছে, সেখানে গোপন তথ্য প্রকাশকারী বিশ্বখ্যাত সংস্থা উইকিলিকসের প্রতিবেদন এবং বিশ্বের খ্যাতনামা গণমাধ্যম এপি, ফক্সনিউজ, দ্য ডেইলি কলার, ডেনভার পোস্টসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধের পেছনে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যোগসাজশ প্রমাণিত হয়েছে।
ড. ইউনূস প্রভাব খাটিয়ে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে ধার্যকৃত ঋণ প্রত্যাহার করিয়েছেন- এমন অভিযোগের বিপরীতে ইউনূস সেন্টার থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে- প্রফেসর ইউনূস পদ্মা সেতু বিষয়ে বিশ্বব্যাংক বা অন্য কোনো সংস্থা বা ব্যক্তির কাছে কখনো কোনো অভিযোগ বা অনুযোগ জানাননি। এ প্রসঙ্গে চাপ প্রয়োগের অনুষঙ্গ হিসেবে ড. ইউনূস ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে যে ৩ লাখ মার্কিন ডলার অনুদান দিয়েছেন সে অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে বিবৃতিতে অস্বীকার করা হয়েছে। এ অভিযোগ ভিত্তিহীন হলেই বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে খুশি হতাম। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের তৎকালীন এমডি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান বন্ধ, অন্যথায় বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধের হুমকি এ সবকিছুর যোগসূত্রের প্রমাণ পাওয়া যায় ২০১৬ সালে উইকিলিকস্ কর্তৃক হিলারি ক্লিনটনের ফাঁস হওয়া ৩০ হাজার ইমেলের মাধ্যমে। সেসব ইমেলের মধ্যে ড. ইউনূসের ইমেলের সন্ধানও পাওয়া যায়। সেসব ইমেলে তিনি বাংলাদেশ সরকারের গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান এবং তার পদ কেড়ে নেওয়ার বিষয়ে দীর্ঘ বর্ণনা এবং হিলারির সাহায্য প্রার্থনা করেন। উইকিলিকসের ফাঁস করা ইমেলের সূত্র ধরে অনুসন্ধানী রিপোর্ট তৈরি করে মার্কিন বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েট প্রেস (এপি) ও ডি ডেইলি কলার। এ ছাড়া শিকাগো ট্রিবিউন ও সিএনবিসির প্রতিবেদনেও মুহাম্মদ ইউনূসের ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে অনুদান প্রদানের বিষয়টি প্রকাশ এবং নিশ্চিত করা হয়।
মার্কিন বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েট প্রেস (এপি) ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের অনুদানদাতাদের নিয়ে প্রকাশিত অনুসন্ধানী রিপোর্টে উল্লেখ করে- হিলারি ক্লিনটন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর সঙ্গে যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে দেখা করেছেন; তাঁদের অর্ধেক ব্যক্তি নিজে বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে অনুদান দিয়েছেন এবং এ অনুদানদাতাদের তালিকায় ড. ইউনূসের নামও রয়েছে। এপির তথ্যানুযায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে ড. ইউনূস তিনবার দেখা করেছেন এবং টেলিফোনে কয়েকবার কথা বলেছেন। এপি তার রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, এ সময় বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংকের দায়িত্ব থেকে ড. ইউনূসকে পদত্যাগে বাংলাদেশ সরকার তদন্ত কমিশন গঠন করে পদক্ষেপ নিচ্ছিল এবং এ কারণেই হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে দেখা করে সাহায্য চেয়েছিলেন ড. ইউনূস। তাঁকে সাহায্য করার পন্থা খুঁজে বের করতে সহকারীদের নির্দেশও দিয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটন। এপি আরও জানায়, এ সময় জনাব ইউনূস ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে ১ লাখ থেকে আড়াই লাখ মার্কিন ডলার অনুদান দিয়েছেন। গ্রামীণ রিসার্চ নামক আরেকটি প্রতিষ্ঠান, তারও চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন জনাব ড. ইউনূস, ওই প্রতিষ্ঠান থেকেও ২৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার ডলার অনুদান দেওয়া হয়েছে।
দ্য ডেইলি কলার ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক আমেরিকার একটি অন্যতম বৃহত্তম সংবাদ প্রকাশনা সংস্থা, রাজনৈতিক কর্মকান্ডের তদন্তভিত্তিক অনুসন্ধানী সংবাদ পরিবেশনের জন্য খ্যাতিসম্পন্ন এবং বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। ২০১৭ সালের ২৫ এপ্রিল প্রকাশিত সংখ্যায় রিপোর্টের রিচার্ড পোল্কের লেখা প্রতিবেদনের হেডলাইন করা হয়- ‘হিলারি আইআরএস অডিটের ভয় দেখিয়ে তদন্ত বন্ধ করতে হুমকি দেন’। সংবাদে বলা হয়- বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গঠিত একটি কমিশন সে সময় গ্রামীণ ব্যাংক এবং এর তৎকালীন এমডি ড. ইউনূসের অনেক আর্থিক অসংগতি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত করছিল। ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের অন্যতম দাতা ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে তদন্ত বন্ধের প্রয়াস হিসেবে হিলারি ক্লিনটন তাঁর সরকারি দফতরকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী -পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে (যিনি পরিবারের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন বসবাস করছেন) বহুবার জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন করেন। স্টেট ডিপার্টমেন্টের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ অডিটের হুমকি দিয়ে দফায় দফায় তাঁকে চাপ প্রয়োগ করা হতে থাকে। যাতে তিনি তাঁর মা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে তদন্ত বন্ধ করতে প্রভাবিত করেন (IRS অডিট হচ্ছে ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা যার মাধ্যমে ট্যাক্স আইনের অধীনে একজন ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের প্রদত্ত আর্থিক তথ্য নিরীক্ষা করা হয়)। পরে ২০১১ সালে হিলারি ক্লিনটনের অফিস থেকে টেলিফোন করে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সতর্ক করা হয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত বন্ধ না করলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর জন্য প্রতিশ্রুত ঋণ প্রদান করা থেকে সরে আসতে পারে এমন আভাস দেওয়া হয়। ২০১৭ সালের মার্কিন সিনেটে এ-সংক্রান্ত তদন্ত অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে অভিযোগ করা হয়েছে, ব্যক্তিগত কারণে কোনো একটি সার্বভৌম দেশের স্বাধীন তদন্তকে প্রভাবিত করতে চেয়েছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এবং এ কাজে তিনি সে সময় বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি, ড্যান মজীনা, ডেপুটি চিফ অব মিশন জন ডেনি লুইস ও ইউএসএইডের প্রশাসক রাজীব সাহাকে ব্যবহার করেন। এ সবই প্রমাণ করে গ্রামীণ ব্যাংকের আর্থিক অব্যবস্থাপনার অভিযোগ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে উদ্ধার করার জন্য হিলারি ক্লিনটন ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট, মার্কিন দূতাবাস এবং বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তাদের ব্যবহার করেছেন। তবে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিশনের অনুসন্ধান বন্ধ হয়নি এবং ২০১১ সালের জুনে আইনি লড়াইয়ে হেরে গিয়ে তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে অব্যাহতি নিতে বাধ্য হন। এর তিন মাস পর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি প্রথম তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে হিলারির কাছে ইমেল পাঠান। উইকিলিকস্ কর্তৃক হিলারি ক্লিনটনের ফাঁস হয়ে যাওয়া ৩০ হাজার ইমেলের মধ্যে এ ইমেলও রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় পরে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ এনে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়; যা পক্ষান্তরে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধে ড. ইউনূসের সরাসরি সংশ্লিষ্টতার যোগসূত্র প্রমাণ করে।
একজন বিশ্বখ্যাত নাগরিক হিসেবে তাঁর সততার প্রমাণ হতো যদি তিনি অনুতপ্ত হয়ে দায় স্বীকার করে নিতেন। কিন্তু তিনি শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করেছেন, ইউনূস সেন্টারের সারবত্তাহীন বিবৃতির মাধ্যমে। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তিনি কোনো ফোরামে বাংলাদেশের স্বার্থের প্রশ্নে দূতিয়ালি করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু সূক্ষ্ম চাল দিয়ে তিনি এ দেশের সরকারকে হাতের মুঠোয় রাখতে চান বলেই প্রতীয়মান হয়। রাষ্ট্রক্ষমতা আয়ত্তের জন্য তিনি একটি রাজনৈতিক দল খুলে জনগণের সাড়া না পেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েন। এত যাঁর আত্ম-অহংকার তিনি যদি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে না পারেন তার দায় আওয়ামী লীগের ওপর বর্তাবে কেন? সরকারি চাকরির অনুসৃত নীতি অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদটি সার্বক্ষণিক ও সুনির্দিষ্ট আইনি কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষেত্রে তিনি নিজস্ব কর্তৃত্ব জোরদার রাখার প্রয়াস চালাতে গিয়ে দেশের আইনের সঠিক প্রয়োগে বাধা দিয়েছেন। যার মধ্য দিয়ে তাঁর নৈতিক স্খলন প্রতীয়মান হয়েছে। আজ বিশ্বসভায় পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধে তাঁর অপকৌশল প্রমাণিত হওয়ার পর একটি দায়সারা বিবৃতি তাঁর অন্যায়কে মুছে দিতে এবং তাঁকে কলঙ্কমুক্ত করতে পারে না। দুর্দিনে যিনি জাতির পাশে থাকেন না তাকে জাতি গ্রহণ করে না। জাতি তাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে।
লেখক : দফতর সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।