ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাত হানার ৪০ দিন পর রিং বাঁধ দিয়ে শ্যামনগর উপজেলার কাশিমারির ইউনিয়নের খোলপেটুয়া নদীর ভাঙন আটকানো গেলেও মানুষের দুর্ভোগ কাটেনি। ঘরবাড়ি হারানো মানুষ কবে বসতভিটায় ফিরতে পারবে, তা কেউ জানে না। চারদিকে ক্ষতবিক্ষত ছবি।
গত রোববার স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ি ইউনিয়নের খোলপেটুয়া নদীর ঝাপালি এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। এতে নদীর লবণাক্ত পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। কাশিমাড়ি ইউনিয়নের ১২টি গ্রাম ও কালীগঞ্জ উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের ৩টি গ্রাম তলিয়ে ৪০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে। ধসে পড়ে অসংখ্য কাঁচা ঘরবাড়ি। রাস্তাঘাট, চিংড়ির ঘের ও ফসলের মাঠ—সব পানিতে একাকার হয়ে যায়। লোকালয়ে পানি ঢোকার পর থেকে গ্রামবাসী স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কয়েক দফা ভেঙে যাওয়া বাঁধ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে সংস্কারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। একপর্যায়ে তাঁরা রিং বাঁধ দিয়ে ১ জুলাই থেকে লোকালয়ে পানি ঢোকা বন্ধ করেন। তবে গত ৪০ দিনে জোয়ার–ভাটায় সবকিছু ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
ঘোলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মোহর আলী বলেন, অনেকবার নদীভাঙন হয়েছে। কিন্তু এমন দুর্যোগ দেখা দেয়নি কখনো। লোকালয়ে পানি ওঠা–নামা বন্ধ হলেও তিনি বসতভিটায় ফিরতে পারছেন না। তাঁর ঘর ধসে পড়েছে। তিনি আশ্রয় নিয়েছেন একটি বেসরকারি সংস্থার কার্যালয়ের বারান্দায়। ঘর বাঁধার মতো সামর্থ্য নেই। মাসখানেক ধরে চরম দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছেন তিনি।
কাশিমাড়ী ইউনিয়নের গাংআটি গ্রামের তাছলিমা খাতুন জানান, তাঁর স্বামী ওহেদ আলী অসুস্থ। ঘূর্ণিঝড়ে তেমন ক্ষতি না হলেও বেড়িবাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানিতে তাঁদের একমাত্র ঘরটি ভেঙে পড়েছে। কোনোরকমে পলিথিন টাঙিয়ে বসবাস করছেন।
ইউনিয়নের খেজুরআটি গ্রামের জবেদা খাতুন বলেন, তাঁর একটিমাত্র ঘর ধসে পড়েছে। পাশের ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে তিনি অবস্থান করছেন। কবে বাড়ি ফিরতে পারবেন, তা তিনি জানেন না।
কাশিমারি ইউনিয়নের ৪০ কিলোমিটার কাঁচা ও পাকা সড়ক একটুও চলাচলের উপযোগী নেই। কাশিমারি-কৃষ্ণনগর সড়কের কালিকাপুর এলাকার এ চিত্র গতকাল সোমবারের। ছবি: প্রথম আলো
কাশিমারি ইউনিয়নের ৪০ কিলোমিটার কাঁচা ও পাকা সড়ক একটুও চলাচলের উপযোগী নেই। কাশিমারি-কৃষ্ণনগর সড়কের কালিকাপুর এলাকার এ চিত্র গতকাল সোমবারের। ছবি: প্রথম আলো
ঘোলা গ্রামের বাসিন্দা পশুচিকিৎসক মিজানুর রহমান বলেন, প্রায় এক মাস ১০ দিন পানিবন্দী হয়ে ছিলেন তাঁরা। এখন লোকালয়ে পানি ঢোকা বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু দুর্ভোগ কাটেনি। বাড়ি ফিরতে পারছেন না। তার ওপর কাঁচা ও পাকা সড়কের একটিও ভালো নেই। হেঁটে চলাচল করাও কষ্টকর। এলাকায় কাজ নেই। ত্রাণও অপ্রতুল। খাবার পানির সংকট সর্বত্র। মানুষ খেয়ে না–খেয়ে কোনোরকমে বেঁচে আছে।
কাশিমাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুর রউফ জানান, পাঁচ সপ্তাহ চেষ্টা করে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে রিং বাঁধ দিয়ে অবশেষে লোকালয়ে পানি ঢোকা বন্ধ করা গেছে প্রাথমিকভাবে। প্রতিদিন রিং বাঁধে মাটি দেওয়ার কাজ চলছে। কিন্তু দ্রুত স্থায়ী ব্যবস্থা না নিলে পূর্ণিমার সময় জোয়ারে বাঁধ রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, ৪০ দিন ধরে পানিতে সম্পূর্ণ ইউনিয়ন তলিয়ে থাকায় চারিদিক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ইউনিয়নের ৪০ কিলোমিটার কাঁচা ও পাকা সড়ক একটুও চলাচলের উপযোগী নেই। অধিকাংশ কাঁচা ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে। অক্ষত বেড়িবাঁধ ও আশ্রয়কেন্দ্রে থেকে মানুষ বাড়ি ফিরতে পারছে না। বেসরকারি সংস্থা মাঝেমধ্যে কিছু ত্রাণ দিচ্ছে। কিন্তু সরকারি ত্রাণ রিং বাঁধ দেওয়ার সময় ব্যয় হয়েছে। লোকালয়ে পানি ঢোকা বন্ধ হলেও ইউনিয়নের মানুষ যারপরনাই কষ্টে আছে।
সাতক্ষীরা পাউবো বিভাগ-১–এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের বলেন, শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ি ইউনিয়নের ঝাপালি এলাকায় ভেঙে যাওয়া অংশে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে রিং বাঁধ দিয়ে লোকালয়ে পানি ঢোকা আটকানো গেছে। বাঁধ সংস্কারের জন্য সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।