মিজানুর রহমানঃস্টাফ রিপোর্টার।
আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব/ ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ কথা অনেক আগেই লিখে গেছেন। তবু আকাশের তারার দিকে চেয়ে থাকতাম, খুঁজে ফিরতাম অনেক আপনজন এন্ড্রু কিশোরকে। অবশেষে সে সেই দয়ালের ডাকে, তার কাছেই চলে গেল তার সেই বিখ্যাত গান, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’র মতো। সব স্মৃতি পেছনে ফেলে, সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল অপার অসীমে।
১৯৭৩ সালের দিকে আমাদের বাড়ির একদম কাছেই রাজশাহীতে সুরবাণী সংগীত বিদ্যালয়টি তখন বেশ বড় নামকরা সংগীতচর্চা কেন্দ্র। একটি পুরোনো বাড়ির ছাদসংলগ্ন বেশ বড় জায়গায় অবস্থিত সংগীত বিদ্যালয়ে প্রায়ই গানের আসর বসত। যেকোনো জাতীয় দিবস বা রবীন্দ্র ও নজরুলজয়ন্তীতে সেখানে ঘটা করে অনুষ্ঠান হতো। এই রকম একটি অনুষ্ঠানে প্রথম দেখি এন্ড্রু কিশোরকে। সে কয়েকটি নজরুলসংগীত পরিবেশন করেছিল। তার গাওয়া ‘চাঁদ হেরিছে চাঁদ-মুখ তার’ গানটি শুনে খুব বিমোহিত হয়েছিলাম। এরপর নানা উপলক্ষে ওই সংগীত নিকেতনে যখনই কোনো গানের অনুষ্ঠান হতো, আমি গিয়ে হাজির হতাম। সুরবাণী সংগীত বিদ্যালয়ে এন্ড্রু কিশোরের ওস্তাদ ছিলেন আবদুল আজিজ বাচ্চু। অর্থাৎ সে সংগীতচর্চা করত আবদুল আজিজ বাচ্চুর অধীনে। প্রথম দিকে এন্ড্রু কিশোর আধুনিক, লোক ও দেশাত্মবোধক গান করত। সে রাজশাহী বেতারের একজন তালিকাভুক্ত শিল্পী।
রাজশাহী শহরে তখন খুব ধুমধাম করে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হতো। সেই দুর্গাপূজা অনুষ্ঠানে মিউজিক কনসার্ট হতো। রানীবাজারের অ্যারোহেড ক্লাব খুব জাঁকজমকের সঙ্গে দুর্গাপূজা করত। তাদের সেই পূজা মিউজিক কনসার্টে এন্ড্রু কিশোর গান গাইত। কয়েকবার অলকা সিনেমা হলের কাছে সেই পূজা মিউজিক কনসার্টে গিয়েছি। সে এক এলাহী কাণ্ড! রাস্তার ধারে উঁচু মঞ্চে এন্ড্রু কিশোর গান গাইছে, রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ তার গান শুনছে। তার গানের সময় রাস্তা বন্ধ হয়ে যেত। তখন দেখেছিলাম, সে নজরুলগীতির বাইরে সেই সময়ের জনপ্রিয় গায়ক কিশোর কুমারের জনপ্রিয় গানগুলো খুব মুনশিয়ানা দিয়ে অবিকল ভঙ্গিতে গাইত।
সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গে পরিচয়, বন্ধুত্ব, তারপর ঘনিষ্ঠতা। রাজশাহী শহরে ও মতিহারের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তখন এন্ড্রু কিশোর তুমুল জনপ্রিয়। এই জনপ্রিয়তা নিয়ে তার মধ্যে কোনো রকম ইগো কখনোই আমাদের চোখে পড়েনি। বরং সে ছিল প্রচণ্ড রকম বিনয়ী। প্রায়ই আমরা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে গোল হয়ে বসে আড্ডা দিতাম। আমি তাকে কিশোরদা বলে সম্বোধন করতাম।
লেখকের সঙ্গে এন্ড্রু কিশোর। ছবি: সংগৃহীত
লেখকের সঙ্গে এন্ড্রু কিশোর। ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীনই এন্ড্রু কিশোরের জনপ্রিয়তা ও গায়কি ঢং রাজশাহীর বাইরে ছড়িয়ে পড়ল। সম্ভবত ১৯৭৭ সালের দিকে ঢাকা থেকে সিনেমার প্লেব্যাক গান গাওয়ার ডাক পড়েছিল। তখনকার বিখ্যাত সুরকার আলম খানের ‘মেইল ট্রেন’ নামের একটি চলচ্চিত্রে ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানটি দিয়ে সিনেমার প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে তার জীবন শুরু হয়েছিল। এরপর পরিচালক বাদল রহমানের ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ নামের শিশুতোষ চলচ্চিত্রে ‘ধুম ধারাক্কা’ গানটি রেকর্ড করল। এর মাঝে আরও কিছু গান। ১৯৭৯ সালে এ জে মিন্টু পরিচালিত ‘প্রতিজ্ঞা’ চলচ্চিত্রের ‘এক চোর যায় চলে’ গানটি পুরো বাংলাদেশে ফাটাফাটি রকমের হিট করল।
এরপর একটির পর একটি চলচ্চিত্রের গান হিট করতে থাকল। ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘ভালোবেসে গেলাম শুধু’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যেখানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’—এ রকম অসংখ্য সব গান তখন মানুষের মুখে মুখে ফিরত। এন্ড্রু কিশোর অচিরেই বাংলাদেশের জনপ্রিয় শিল্পী হয়ে উঠল। আমরা রাজশাহীতে তার গুণমুগ্ধরা তখন কিশোরদাকে নিয়ে খুব গৌরব বোধ করতাম।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে ১৯৮০ সালের জানুয়ারি মাসে কিশোরদা তার গান গাওয়ার প্রয়োজনে ঢাকায় থিতু হলো। ঢাকার ফকিরাপুল বাজারের সন্নিকটে কিশোর একটি ফ্ল্যাটের তৃতীয় তলায় বসবাস শুরু করল। তবে সে প্রায় রাজশাহীতে তার পরিবারের কাছে বেড়াতে আসত। ১৯৮৪ সালের মে মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েশন পরীক্ষা চুকিয়ে আমি চাকরি নিয়ে ঢাকা চলে আসি। ঢাকাতে এসে আমিও কিশোরের সঙ্গে বসবাস শুরু করি।
সে সময় এন্ড্রু কিশোর দেশজুড়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। একসঙ্গে থাকার ফলে তার সংগীতময় জীবনযাপন আর তার জনপ্রিয়তা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হলো। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে কিছু ঔষধি গাছের রস খেত, তারপর যোগব্যায়াম করে গলা সাধত।
১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে বাংলাদেশের ছায়াছবিতে প্লেব্যাক মিউজিকের জন্য এন্ড্রু কিশোরের গলা ছিল অপরিহার্য। সে সময় দেখেছি হঠাৎ করে ফকিরাপুলের বাসায় বিখ্যাত সুরকার আলাউদ্দিন আলী এসে হাজির। হয়তো খুব তাড়াতাড়ি কোনো গানের কাজ শেষ করতে হবে, সেই বিষয়ে বা সুর কেমন হবে, তা নিয়ে কথা বলতে এসেছেন। এই রকম বাংলাদেশের আরও বিখ্যাত সুরকার শেখ সাদী খান, ইমতিয়াজ আহমেদ বুলবুল প্রমুখ প্রায়ই আসতেন। গায়কদের মধ্যে কুমার বিশ্বজিৎ, তপন চৌধুরী প্রায়ই আসতেন আড্ডা দিতে।
১৯৮২ সালে রেকর্ডিংয়ের আগে কিশোরদা আমাদের বাসায় ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’ গানটি অনুশীলন করছিল। গানটির কথা ও সুরের মধ্যে আধ্যাত্মিকতার ভাব দেখে সেদিন আমি বলেছিলাম, গানটা কিন্তু বাজারে খাবে। সেই গানটি রেকর্ডিংয়ের দিন আমি তার সঙ্গে শ্রুতি স্টুডিওতে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যার পর গানটি রেকর্ড হলো। ‘বড় ভালো লোক ছিলো’ ছবির এই গান লিখেছিলেন সব্যসাচী লেখক কবি সৈয়দ শামসুল হক আর সুর করেছিলেন আলম খান। এই কালজয়ী গানটির জন্য পরবর্তীকালে এন্ড্রু কিশোর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেল।
রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় প্রায়ই তার অসংখ্য শ্রোতা ‘দাদা দাদা’ বলে চিৎকার করতেন। ১৯৮২ সালের দিকে রাজশাহী বিমানবন্দর নির্মিত হলে কিশোরদা বলল, ‘চল, আমরা রাজশাহীমুখী প্রথম ফ্লাইটে রাজশাহী যাই।’ কথামতো টিকিট জোগাড় হলো। রাজশাহীতে নামার পর অসংখ্য লোক কিশোরদাকে সংবর্ধনা জানিয়েছিল।
১৯৮৪ সালের জুন মাসে আমি প্রবাসে চলে আসি। বৃষ্টিমুখর এক দিনে কিশোরদা এবং আমার বড় ভাই ‘দৈনিক বাংলা’ ও ‘বিচিত্রা’র সাবেক প্রতিনিধি আহমেদ সফি উদ্দিন আমাকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দিয়েছিল। দেশ ছাড়ার পর জার্মানি থেকে ১৯৯০ সালে আবার দেশে যাই। ঢাকা বিমানবন্দরে যথারীতি কিশোরদা এসে হাজির। ১৯৮১ সালের মে থেকে ১৯৮৪ সালের জুন—প্রায় ৩৬ মাস কিশোরদার সঙ্গে এক ছাদের নিচে একসঙ্গে ছিলাম। সেই সময়কার নানা স্মৃতি সব সময় মানসপটে সমুজ্জ্বল।
আশির দশকে এন্ড্রু কিশোরের গান বাংলাদেশের সংগীতজগতে নতুন এক ধারার সূচনা করে। তার অসংখ্য জনপ্রিয় গান বাংলাদেশের সর্বত্র মানুষের মুখে মুখে ফিরত। সব ফেলে তার অসংখ্য বন্ধু আর অগণিত ভক্ত, সবাইকে কাঁদিয়ে সে চলে গেল। কিন্তু কালজয়ী সব গান এন্ড্রু কিশোরকে বাংলা সংগীতজগতে সমুজ্জ্বল রাখবে।