অবসরে পাঠানো রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের ২৫ হাজার শ্রমিকের যাবতীয় পাওনা আগামী সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে পরিশোধ করা হবে। এই অর্থ শ্রমিকদের নিজস্ব ব্যাংক হিসাবে জমা হবে। আর প্রকৃত শ্রমিকদের তথ্য ও মৃত শ্রমিকদের উত্তরাধিকারী শনাক্তে গঠন করা হচ্ছে একটি কমিটি। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
রোববার (২৮ জুন) লোকসানে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিককে পাওনা দিয়ে অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্তের কথা জানায় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) আওতাধীন পাটকলগুলোর আধুনিকায়ন এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের করে গড়ে তুলতে উৎপাদন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করতে প্রায় ৫,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হবে।
বিজেএমসি’র অধীনে থাকা ২৬টি পাটকলের মধ্যে মনোয়ার জুট মিল ছাড়া সবগুলোতেই উৎপাদন চলছে। এসব কারখানায় ২৪ হাজার ৮৬৬ স্থায়ী শ্রমিকের বাইরে তালিকাভুক্ত ও দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিক আছে প্রায় ২৬ হাজার। বেসরকারি খাতের পাটকলগুলো লাভ দেখাতে পারলেও বিজেএমসির আওতাধীন মিলগুলো বছরের পর বছর লোকসান করে যাচ্ছে, যার পেছনে অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো গত ৪৪ বছরের মধ্যে মাত্র চার বছর লাভ করেছে। ৪৮ বছরে এই খাতে সরকারকে ১০ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। প্রতি বছর শ্রমিকের মজুরিসহ খরচ মেটাতে সরকারের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে।
জানতে চাইলে বিজেএমসি’র চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) মো. আবদুর রউফ শনিবার বলেন, ‘শ্রমিকরা গত মাসে যে কাজ করছে সেই পাওনা এ মাসে দেব। এ মাস থেকে দুই মাস (জুলাই-আগস্ট) নোটিশ পিরিয়ড হিসেবে গণ্য হবে। এ সময় মিলগুলোতে কাজ হোক আর না হোক শ্রমিকরা তাদের বেতন সময়মতোই পেয়ে যাবেন। এই সময়ের মধ্যেই আমরা শ্রমিকদের পাওনা সংক্রান্ত হিসাব-নিকাশ চূড়ান্ত করে ফেলব। কারও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা মৃত শ্রমিকের উত্তরাধিকার নির্ধারণ সংক্রান্ত জটিলতা না থাকলে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যেই শ্রমিকদের পাওনা যার যার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে (হিসাব) চলে যাবে ইনশাআল্লাহ।’
বিজেএমসি চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘আমাদের বলা হয়েছে শ্রমিকদের অ্যাকাউন্ট পে-চেকের মাধ্যমে পাওনা পরিশোধ করতে হবে। এখন সব শ্রমিকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। ফলে যাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই তাদের এই সময়ের মধ্যে অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। যেসব শ্রমিক ইতোমধ্যে মারা গেছেন, তাদের উত্তরাধিকার নির্ধারণ করা একটি সময়সাপেক্ষ ও দুরূহ কাজ। এটি নির্ধারণ না করা গেলে চেক ইস্যু করা যাবে না। এসব বিষয় ভেরিফাই করতে একটি কমিটি করা হবে। তারপরই ওই তালিকা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। অর্থ মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত কমিটি করে পুনরায় যাচাই-বাছাই করে তারপরই সরকারি টাকা ছাড় করবে। ফলে যাদের এ জাতীয় সমস্যা থাকবে তাদের পাওনা পেতে দেরি হতে পারে।’
শ্রমিকদের অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্তের কথা পাট মন্ত্রণালয় জানানোর পর গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস জানান, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তিনি বলেন, ‘দুই লাখ টাকার কম যাদের পাওনা হবে, তাদের পুরো টাকা তাৎক্ষণিকভাবে নগদ দেয়া হবে। আর দুই লাখের বেশি পাওনা হলে ৫০ শতাংশ টাকা তাৎক্ষণিকভাবে নগদ দেয়া হবে। বাকি ৫০ শতাংশ টাকা তাদের দেয়া হবে তিন মাস মেয়াদি সঞ্চয়পত্রের আকারে। নিম্ন আয়ের শ্রমিক ভাইবোনদের জীবনের নিশ্চয়তার জন্যই প্রধানমন্ত্রী এটি করেছেন।’
এই ঘোষণার একদিন পর শুক্রবার রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীর বাড়িতে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। সেখানে উপস্থিত ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সেখানে পাটমন্ত্রী বলেছেন, বৃহস্পতিবার আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে ওই সময় প্রধানমন্ত্রী আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি আমাদের বলেন, ‘এই শ্রমিকরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আন্দোলন করেছেন। এক লাখ শ্রমিক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আন্দোলন করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন।’ এ কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী চোখের পানি ফেলেছেন। বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন তারা, তাদের তো পুনর্বাসন করতে হবে, তাদের আরও ট্রেনিং দেয়া যায় কিনা।’ অর্থ সচিবকে বলেছেন, ‘তাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করো, তাদের আমার দরকার, তাদের হারাতে চাই না।’
এর আগে রাষ্ট্রায়ত্ত ২৬টি পাটকলের ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী কর্মচারীর চাকরি ‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের’ মাধ্যমে অবসায়নের সিদ্ধান্ত গত রোববার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে জানান বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। পাট সচিব লোকমান হোসেন মিয়া ওইদিন বলেছিলেন, শ্রমিকদের অবসায়নের পর আগামী ছয় মাসের মধ্যে পিপিপির (সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব) আওতায় আধুনিকায়ন করে এসব পাটকলকে উৎপাদনমুখী করা হবে। তখন এসব শ্রমিক সেখানে চাকরি করার সুযোগ পাবেন। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকদের পাওনা টাকার অর্ধেক নগদ এবং বাকি অর্ধেক মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র আকারে পরিশোধ করবে সরকার।
এরপর বৃহস্পতিবার রাতে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পাটকল শ্রমিকদের কীভাবে পাওনা পরিশোধ করা হবে সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দেয়। এতে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর বিরাজমান পরিস্থিতি স্থায়ী সমাধানসহ পাট খাতে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো ১ জুলাই থেকে বন্ধ ঘোষণা এবং গোল্ডেন হ্যান্ডশেক সুবিধার আওতায় কর্মরত ২৪ হাজার ৮৮৬ জন শ্রমিকের সমুদয় পাওনা এককালীন পরিশোধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। শ্রম আইন অনুযায়ী নোটিশ মেয়াদের অর্থাৎ ৬০ দিনের মজুরি। চাকরিবিধি অনুযায়ী প্রাপ্য গ্রাচুইটি, পিএফ তহবিলে জমাকৃত অর্থ এবং নির্ধারিত হারে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক সুবিধা পাবেন। প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, প্রতি শ্রমিক সর্বনিম্ন ১৩ লাখ ৮৬ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫৪ লাখ টাকা পর্যন্ত পাবেন।
মন্ত্রণালয় বলছে, একই সঙ্গে ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত অবসরে যাওয়া ৮ হাজার ৯৫৬ জন শ্রমিক ও বদলি শ্রমিকদের সমুদয় পাওনা একসঙ্গে পরিশোধ করা হবে। কীভাবে এই টাকা পরিশোধ করা হবে তার ব্যাখ্যায় বলা হয়, শ্রমিকের পাওনার অর্ধেক নগদ এবং বাকি অর্ধেক তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র আকারে দেয়ার ফলে শ্রমিকরা এক প্রকারের বাধ্যতামূলক সঞ্চয়ের সুযোগ পাবেন, যা তাকে প্রতি তিন মাস অন্তর উল্লেখযোগ্য পরিমাণে মুনাফা দেবে। এতে শ্রমিকদের জন্য একটি বাড়তি আর্থিক সুরক্ষা তৈরি হবে। যারা ১৪ লাখ টাকা পাবেন তাদের ৭ লাখ টাকা নগদ দেয়া হবে। আর বাকি ৭ লাখ টাকার মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র থেকে তিন মাস পরপর ১৯ হাজার ৩২০ টাকা করে পাবেন। যাদের পাওনা ২৪ লাখ টাকা তারা তিন মাস পরপর সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৩ হাজার ১২০ টাকা, যাদের পাওনা ৩৮ লাখ টাকা তারা সঞ্চয়পত্র থেকে ৫২ হাজার ৪৪০ টাকা এবং যাদের পাওনা ৫৪ লাখ টাকা তারা তিন মাস অন্তর সঞ্চয়পত্র থেকে ৭৪ হাজার ৫২০ টাকা করে পাবেন বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।