সুভাষ সিংহ রায়

শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশ শিক্ষাঙ্গন
সুভাষ সিংহ রায়
সুভাষ সিংহ রায়
সমাজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আজ থেকে ৯৯ বছর আগে ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯১২ সালের ২৭ মে ব্যারিস্টার রবার্ট নাথানকে প্রধান করে গঠন করা হয় ১৪ সদস্যবিশিষ্ট ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি কমিটি’। এই কমিটিতে ছিলেন ছয়জন ব্রিটিশ, চারজন মুসলমান ও চারজন হিন্দু। ১৯১০ সালের ৫ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ ও আসাম আইন পরিষদের সদস্য অনঙ্গমোহন নাহা ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবি করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন মুসলিম ছাত্রদের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল এই কারণে যে তা পিছিয়ে থাকা বাঙালি মুসলমান সমাজকে উঠে দাঁড়াতে ও এগিয়ে যেতে ধাত্রীর ভূমিকা পালন করেছিল । সেই অর্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আধুনিক বাঙালি মুসলমানের প্রথম ঠিকানা। মেধাবী দরিদ্র মুসলমান ছাত্র এবং পাটচাষি সচ্ছল মুসলমান পরিবারের জন্য মানসম্মত উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দেয় ১৯২০, ৩০ ও ৪০ দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই উচ্চশিক্ষিতেরাই নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত পাকিস্তানের রাজনীতির ও প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তাদেরই একটি অগ্রসর অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী অংশ ষাটের দশকে স্বায়ত্বশাসনের জন্য সফল আন্দোলন করে এবং একাত্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেছে একদল প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, যারা নতুন নতুন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তত্ত্ব তৈরি করেছেন, যা কাজে লাগিয়েছেন জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকেরা। অখণ্ড- বঙ্গদেশে, বিশেষ করে পূর্ব বাংলায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তরুণসমাজকে ধর্মনিরপেক্ষ আচরণ করতে শিখিয়েছিল। নবাব নওয়াব আলী তখন ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য। ১৯৭১-র ২০ মার্চ কাউন্সিল অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি এই দেরির জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং সরকারকে চাপ দেন, যাতে আর দেরি না করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা অবিলম্বে গ্রহণ করা হয়।

তার সমকালের অভিজাত বাঙালি মুসলমান ভূস্বামীদের প্রায় সবাই আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে বলতেন তারা মুসলমান, কিন্তু নওয়াব আলী নিজেকে মনে করতেন বাঙালি মুসলমান এবং মাতৃভাষা বাংলার প্রতি ছিল তার অসামান্য প্রীতি। তিনি স্পষ্ট ভাষায় এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমাদের মাতৃভাষা উর্দু নয়, বাংলা’। আবুল মনসুর আহমদ তার আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর-এ লিখেছিলেন , ‘এটা তাহার মতো সরকারপন্থী মডারেট রাজনীতিকের জন্য কত বড় দুঃসাহসিকতার কাজ ছিল, পঞ্চাশ বছর পর আজ তাহা অনুমান করা সহজ নহে।’

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটা বিখ্যাত গান আছে , ‘অতীত দিনের স্মৃতি কেউ ভোলে না, কেউ ভোলে/ কেউ দুঃখ লয়ে কাঁদে, কেউ ভুলিতে গায় গীত।’ আমার জীবনের সবচেয়ে সমৃদ্ধ সময় মূলত বিশ্ববিদ্যালয় জীবন; বিশেষ করে জগন্নাথ হলের আবাসিক জীবন। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল প্রাক্তন ছাত্রদের একই ধরনের নস্টালজিক অনুভূতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ছিল আমার শিক্ষাদীক্ষার তীর্থক্ষেত্র। ১৯২১ সালের ১লা জুলাই এ তিনটি আবাসিক হল (জগন্নাথ হল, ঢাকা হল, সলিমুল্লাহ হল) নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন হলের মধ্যে জগন্নাথ হলই সবার আগে নির্মিত হয়। এমনকি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সুপারিশ ঘোষণার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগেই জগন্নাথ হলের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল। কাজ শুরু করা হয় ৩০০ ছাত্রের আবাসনের উপযোগী একটি কেন্দ্রীয় ভবন এবং তিনটি অন্য ভবন নির্মাণের। জগন্নাথ হলের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির শক্ত ভিত্তি স্থাপন করে দেন প্রথম প্রভোস্ট নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। তিনি ছিলেন একইসঙ্গে আইন বিভাগের অধ্যাপক ও আইন ফ্যাকাল্টির ডিন। তাছাড়া নরেশচন্দ্র ছিলেন বিশের দশকের খ্যাতিমান ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও নাট্যকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিপর্বে নানাধরনের টানাপড়েন ছিল। তৎকালীন পূর্ব বাংলার সাহাদের অধিকাংশই ছিলেন অবস্থাপন্ন। তারা গ্রামে-গঞ্জে ব্যবসা করতেন। আবার তারা বিভিন্ন জনহিতকর কাজের সঙ্গেও যুক্ত থাকতেন, অর্থসাহায্য করতেন বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। সেসময় বহু ব্রাহ্মণ কায়স্থ ছিলেন অসচ্ছল। জগন্নাথ হলের ব্রাহ্মণদের বৈষম্যমূলক আচরণে সাহারা ক্ষুব্ধ হন এবং সমালোচনা করেন। ফলে বর্ণহিন্দুদের মধ্যে যারা উদার, তারা সাহাদের ব্যাপারে নমনীয় হলেও নমশূদ্রদের সঙ্গে বাস করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করতেন। শেষ পর্যন্ত বিষয়টিতে একটি সমঝোতার চেষ্টা হয়।

জগন্নাথ হলের একেবারে শুরুতেই ‘বাসন্তিকা’ পত্রিকা জাগরণ সৃষ্টি করতে পেরেছিল। নাট্যকার মন্মথ রায়সহ বাংলা নাট্যসাহিত্যের কীর্তিমান মানুষ সৃষ্টি হয়েছিল জগন্নাথ হল থেকে। জগন্নাথ হলের শুধু নাটক ও সঙ্গীতানুষ্ঠান নয়, অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও ছিল অত্যন্ত প্রশংসার যোগ্য। প্রতিবছর ফাল্গুন মাসে হতো বাৎসরিক বসন্তোৎসব।

১৯২৭-এ যখন সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেস সভায় যোগ দিতে ঢাকা সফর করেন, তখন মুসলিম হলের ছাত্ররা তাকে হলে আমন্ত্রণ জানান। হলের ডাইনিং রুমে শ’কয়েক হিন্দু-মুসলমান ছাত্রের উদ্দেশে তিনি ভাষণ দেন। তিনি তার বক্তৃতায় জাতির কল্যাণের জন্য ভেদাভেদ ভুলে সকল সম্প্রদায়ের ঐক্যের ওপর জোর দিয়েছিলেন। হল সংসদের রিপোর্টের ভাষায় : Mr. Bose in a very fine way exhorted us all to sink our infallibility for the good of the country. তেজস্বী তরুণ নেতাকে ছাত্রদের কাছে পরিচয় করিয়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন মুসলিম হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক মাহমুদ হাসান। হলের ছাত্রনেতাদের মধ্যে সৈয়দ আবদুল ওয়াহেদ, ওয়ালীউল্লাহ পাটোয়ারী, এ এফ এম আবদুল হক, আলী নূর প্রমুখ সুভাষচন্দ্রের অভ্যর্থনার ব্যাপারে উদ্যোক্তার ভূমিকা পালন করেন। তখন ঢাকার সাম্প্রদায়িক আবহাওয়া ছিল উত্তপ্ত। হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নেতারাই নিজ নিজ সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত ব্যক্ত করেন। তবে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের ভুলগুলোর ব্যাপারে তারা অর্থবহ নীরবতা অবলম্বন করেন, অর্থাৎ আত্মসমালোচনায় আগ্রহী ছিলেন না কেউই। এর আগে বড় বড় কংগ্রেস নেতা ঢাকায় এসে হিন্দুদের পক্ষেই অনেকটা হিন্দু জাতীয়তাবাদের পক্ষেই-কথা বলে গেছেন। তাতে মুসলমান সম্প্রদায় বরং আরও বেশি মুসলমানিত্বের দিকে ঝুঁকেছেন। যেমন, সরোজিনী নাইডু ঢাকায় এসেছিলেন ১৩৩০-এর জ্যৈষ্ঠ মাসে কংগ্রেসের জেলা সম্মিলনীর সভাপতিত্ব করতে। তিনি নিজে সাম্প্রদায়িক ছিলেন না, তবু সম্মেলনে তার বক্তব্যে মুসলমান সম্প্রদায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি, কারণ তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যাপারেই বেশি কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘হিন্দু-জাতির সংহতি-শক্তি নাই, হিন্দুদের সংগঠিত হওয়া উচিত।’ তিনি অবশ্য একবার বলেন, ‘মুসলমানদেরও সংগঠিত হওয়া কর্তব্য, তবে হিন্দুদের বিরুদ্ধে নহে।’ [প্রবাসী, আষাঢ়, ১৩৩৩] আমার স্মৃতিতে অসংখ্য মেধাবী সন্তানের ইতিহাস রয়েছে। বিশেষ করে আশির দশকের এমনি একজন কর্মযোগী ছাত্র ছিলেন রাম চন্দ্র সাহা, যাকে ভুলে থাকা যায় না। রাম চন্দ্র সাহার একান্ত চেষ্টায় আজ থেকে তিন দশক আগে জগন্নাথ হলে ‘বিবেকানন্দ শিক্ষা সাংস্কৃতিক পরিষদ’ গড়ে ওঠে। আমরা সকলেই জেনে থাকবো সেই সময়টা ছিল ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের জীবনের ভয়ংকর ভয়ংকর দিন, ভয়ংকর ভয়ংকর রাত। প্রায় প্রতি দিনই শত শত রাউন্ড গুলি ফুটতো। এবং সেটা রাতের যেমন গুলি-বোমা ফুটতো, দিনের বেলাগুলোও তেমন ছিল। সেই সময়ে জগন্নাথ হলে নিয়মিতভাবে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক- ক্রীড়া চর্চা ও প্রতিযোগিতা নিয়মিতভাবে হয়েছিল ।

(২)

ইতিহাস পাঠ থেকে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্টিলগ্নে সলিমুল্লাহ হলে ‘আল মামুন’ ক্লাব ছিল, খলিফা মামুনের নামে। ১৯২৭ সালের জুলাই মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র সংসদের উদ্যোগে গঠিত হয়েছিল ‘আল মামুন ক্লাব’। বিদ্যোৎসাহী খলিফা আল মামুনের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ক্লাবটি। আল মামুন ক্লাবের প্রধান কাজ ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা। প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিতর্ক হতো। তাতে অংশ নিতেন হলের ছাত্ররা, কখনো শিক্ষকরাও। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ করে আনা হতো এই ক্লাবের সান্ধ্য বৈঠকে বক্তৃতা দিতে। শুধু মুসলিম শিক্ষকরাই এখানে আসতেন তা নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক কালিকারঞ্জন কানুনগো, বাংলার চারু বন্দ্যোপাধ্যায়, দর্শনের হরিদাস ভট্টাচার্য নিয়মিতভাবে আসতেন।

আজ থেকে ৯৪ বছর আগে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জগন্নাথ হলের তৎকালীন প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক রমেশ চন্দ্র মজুমদারের বাসভবনে অবস্থান করেছিলেন। জগন্নাথ হল ও মুসলিম হল ইউনিয়নের আয়োজনে সংবর্ধনা-সভায় যোগ দেওয়ার কথা ছিল। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি জগন্নাথ হল ইউনিয়নের সংবর্ধনা-সভায় যোগ দিতে না পারলেও মুসলিম হল ইউনিয়নের সভায় যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে যে মানপত্র পাঠ করা হয়েছিল তা ছিল অনন্য বৈশিষ্ট্যেভরা। এ পরিসরে পাঠ করা সেই মানপত্র থেকে কয়েকটি উৎকলন করা যেতে পারে।

“…হে পুণ্যচিত্ত, অনন্ত রূপপিয়াসী সাধক!
আমাদের আদর্শ কর্ম্মপ্রাণ, স্নেহপ্রবণ, ভক্ত-বীর হযরত মুহম্মদের জীবনের মূল- মন্ত্রটি তোমার একটি ছন্দে বেশ সুন্দর অভিব্যক্ত হইয়াছে-
“ বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়। 
অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময়
লভিব মুক্তির স্বাদ।
তোমার এই ছন্দটি সেই পুরুষ-সিংহের প্রতি আমাদের ভক্তি অধিকতর প্রগাঢ় করিয়া তুলে এবং নব নব ভাবে সেই মরুর যোগীকে দেখিবার ইচ্ছা জাগায় ।…”

এই সংবর্ধনার উত্তরে কবি বলেছিলেন, (‘অভিযান ’, প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ভাদ্র ১৩৩৩ সংখ্যায় মুদ্রিত ) “এই সভা গৃহে প্রবেশ করার পর থেকে এ পর্যন্ত আমার উপর পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে। প্রাচীন শাস্ত্রে পড়েছি , কৃতী ব্যক্তির উপর পুষ্পবৃষ্টি হয়। এ পুষ্পবৃষ্টি যদি তারই সপ্রমাণ করে, তবে আমি আজ আনন্দিত। কৃতী হয় প্রীতি দিয়ে। এ পর্যন্ত আমার সকল সাধনা ও ইচ্ছায়, রচনা ও কর্মে আমার সংকল্প হয়েছে হৃদয়ের প্রীতি সর্ব্বজাতি, সর্ব্বদেশকে দিতে। পাশ্চাত্য দেশে আমি মানবের কবি বলে সমাদৃত। তার কারণ কোন সম্প্রদায় বিশেষের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আমি কোনো কার্য্য করিনি।…”

অথচ এখনও পর্যন্ত কেউ কেউ সুযোগ পেলেই বলে থাকেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোর বিরোধী ছিলেন । ১৯২২ সালের ২৮ মার্চ কলকাতার গড়ের মাঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সভা একটা অনুষ্ঠিত হয়েছিল বটে, কিন্তু তাতে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি ছিল অসম্ভব, কেননা সেদিন তিনি কলকাতাতেই ছিলেন না । ১৯২২ সালের ২৪ মার্চ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহে চলে এসেছিলেন। সেই বছরের ২৮ মার্চ থেকে ১২ এপ্রিলের মধ্যে সেখানে বসে ১৮টি গান ও কবিতা রচনা করেছিলেন, যা পরে ‘গীতিমাল্য’ গ্রন্থে সংকলিত হয়। ‘গীতিমাল্য’ (১৯১৪ ) গ্রন্থে ৪ সংখ্যক কবিতা ‘স্থির নয়নে তাকিয়ে আছি’ শিলাইদহে ১৫ চৈত্র ১৩১৮ তারিখ (২৮ মার্চ ১৯১২) রচিত হয়, তা ওই গ্রন্থে কবিতাটির নিচেই লেখা আছে ।
জগন্নাথ হলের তৎকালীন প্রাধ্যক্ষ রমেশ চন্দ্র মজুমদারের বাসভবনে বসে লিখে ছিলেন-

“এই কথাটি মনে রেখো, তোমাদের এই হাসিখেলায়
আমি যে গান গেয়েছিলেম, জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়।
শুকনো ঘাসে শূন্য বলে আপন-মনে
অনাদরে অবহেলায়
আমি যে গান গেয়েছিলেম, জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়॥
দিনের পথিক মনে রেখো, আমি চলেছিলেম রাতে
সন্ধ্যাপ্রদীপ নিয়ে হাতে।
যখন আমার ও-পার থেকে গেল ডেকে ভেসেছিলেম ভাঙা ভেলায়।
আমি যে গান গেয়েছিলেম জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়॥”

এবং সেটা জগন্নাথ হলে বার্ষিকী ‘ বাসন্তিকা’য় ছাপা হয়েছিল ।

(৩)

অধ্যাপক এ কে এম নাজমুল করিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা শিক্ষক ছিলেন। ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ে তার নামে এখন প্রতি বছর ‘নাজমুল করিম স্মারক বক্তৃতা’ অনুষ্ঠিত হয়। পাঠকদের অনেকে অধ্যাপক করিমের এক অসাধারণ প্রবন্ধ ‘ভূগোল ও ভগবান’ পাঠ করে থাকতে পারেন। সেই লেখার কয়েকটা লাইন এ পরিসরে প্রাসঙ্গিকভাবে উপস্থাপন করা যায়। “আমার এক মাস্টার মশাই একবার মহামুস্কিলে পড়েন। তার ভাঙ্গা মোটরখানা সারাতে নিয়েছিলেন ঢাকার এক মটর মেকানিকের কাছে। ভাঙ্গা মটরখানাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে ড্রাইভার বলল, বাবু, বিশ্বকর্ম্মার পূজার জন্য আজ কারখানা বন্ধ। মোটরখানা জরুরি দরকার তাই অধ্যাপক বললেন, “তারা যে মুসলমান মোটর মেকানিক। তারা দোকান বন্ধ রাখবে কেন ?” ড্রাইভার উত্তর দিল, “তা হলে কি হয়, বাবু, তারা বিশ্বকর্ম্মার পূজা না করতে পারে, কিন্তু তাই বলে কাজ বন্ধ না রাখলে যে তাদের অমঙ্গল হবে।” কী আর করা যায়, বিশ্বকর্ম্মার অনুকম্পায় সেদিন আর মোটরে চড়া হল না। তবে সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপকের একটা কথা পরিষ্কার হয়ে গেল, মানুষের আর্থিক ও ভৌগোলিক পরিবেশই মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে রূপ দেয়। তাই মুসলমান মেকানিকেরও বিশ্বাস যে বিশ্বকর্ম্মাকে দোকানপাট বন্ধ রেখে সম্মান না দেখালে তার ব্যবসায় ক্ষতি হতে পারে। আমাদের এ মাটিতে ধর্ম ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন এভাবেই হয়েছে।

আমাদের অনেকেরই জানা আছে, জগন্নাথ হলের দুর্গাপুজোর আয়োজন করে থাকে হলের কর্মচারীরা ও সরস্বতী পুজোর আয়োজনে থাকে ছাত্ররা। ৯৮ বছরে এই নিয়মে ব্যত্যয় হয়নি কখনও। জগন্নাথ হলের বাণী-অর্চনা অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল ‘সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান’। ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক যৌথভাবে তা আয়োজন করতো। ১৯২৭ সালে বাণী-অর্চনা উপলক্ষে ‘অচলায়তন’ মঞ্চস্থ হয়েছিল। আমরা ‘অচলায়তনে’ দেখি বিদ্রোহ। সামাজিক পরিবেশ থেকে তার প্রসার। সমাজে আচার-বিচারের বাড়াবাড়ি। আগেই উল্লেখ করেছি সে সময়কার জগন্নাথ হলের ব্রাহ্মণ ছাত্রদের বৈষম্যমূলক আচরণে সাহারা ক্ষুব্ধ ছিলেন। বর্ণহিন্দুদের প্রগতিশীল অংশ বর্ণভেদের অচলায়তন ভাঙতে পেরেছিলেন। জগন্নাথ হলের একেবারে শুরুতেই ‘বাসন্তিকা’ পত্রিকা জাগরণ সৃষ্টি করতে পেরেছিল। আমরা জানি জনসাধারণের দিক থেকে অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ-সুর জেগেছে। ‘কালের যাত্রা’য় বিশ্বকবি দেখিয়েছেন ‘শুদ্রদের জয়’। বলে গেছেন, “ওরাই যে আজ পেয়েছে কালের প্রসাদ…এবার থেকে মান রাখতে হবে ওদের সঙ্গে সমান হয়ে। ”

১৯৯০-৯১ শিক্ষাবর্ষে জগন্নাথ হলে ছাত্র সংসদের উদ্যোগে গড়ে ওঠে ‘বিতর্ক’ নামে একটি তার্কিক সংগঠন। এটাই ছিল স্বাধীনতা পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হল পর্যায়ে প্রথম বিতর্ক সংগঠন। সর্বপ্রথম এই বিতর্ক সংগঠনের সভাপতি হয়েছিলেন আইনের ছাত্র প্রশান্ত ভূষণ বড়ুয়া। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হলে বিতার্কিকদের নিয়ে সংগঠন গড়ে ওঠে। ২০২০ সালের ১লা জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষে পদার্পণ করেছে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সংকট ও তা সমাধানের উপায় কী , তা আমার জিজ্ঞাসা নয় । আমার প্রশ্নও সেই সংকটকে ছুঁয়েছে, তবে সরলে নয় তির্যকে: অর্থাৎ সাম্প্রতিকে নয়- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীতের নিরানব্বই বছরের ব্যবধানে, প্রত্যক্ষের প্রতীয়মানতায় নয়- ধারণায়, লক্ষণে নয় -কারণে। কেন, এদিক থেকে, আমার ইতিহাস চিন্তা উন্মার্গগামী হলো?

লেখক: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন , সাবেক সহ-সভাপতি, জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *