ধন্যবাদ বিসিবি- ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

ক্রিকেট প্রচ্ছদ


মতামত:ধন্যবাদ বিসিবি- ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

পাকিস্তান ক্রিকেট দলের সাম্প্রতিক সফর নিয়ে এই মুহূর্তে উত্তাল দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। কাপছে মিডিয়াও। বাংলাদেশকে টি-২০ সিরিজে এরই মধ্যে হারিয়েছে পাকিস্তান। সর্বশেষ টি-২০ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ক্রিকেট দলের পারফরম্যান্স বিবেচনায় এমন ফলাফল অবশ্য অপ্রত্যাশিতও ছিল না। ক্রিকেটে একটা বাজে সময় যাচ্ছে বাংলার বাঘদের। অতএব সিরিজের ফলাফলে জাতি ব্যথিত হলেও তা সংবাদপত্রের শিরোনামের কারণ হয়নি। শিরোনামটা হয়েছে পাকিস্তান দলের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ আর তাদের সমর্থনে এদেশীয় কিছু নির্লজ্জ দালালের নির্লজ্জতম দালালির কারণে।

মিরপুর স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে প্র্যাকটিস করা আন্তর্জাতিক কনভেশন এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা প্রদর্শন আইনের সুস্পষ্ট লংঘন, যার জন্য এক বছর কারাদণ্ডের বিধান আছে আমাদের দণ্ডবিধিতে। আইসিসি স্বীকৃত কোনো ক্রিকেট ম্যাচে প্রতিদ্বন্দ্বী দল দুটোর পতাকা উত্তোলনের যে বিধানটি রয়েছে এটি আর সেটি এক বিষয় নয়। পিসিবি অবশ্য এসবের থোরাই কেয়ার করে। কোনো রকম অনুমতির তোয়াক্কা না করেই পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা দিনের পর দিন পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে মিরপুরে প্র্যাকটিস করেছে আর তারপর যখন বিষয়টি নিয়ে মিডিয়ায় তুমুল লেখালেখি, তখন তারা দায়সারা অনুমতি চেয়েছে বিসিবির কাছে, যদিও এ ধরনের অনুমতি দেয়ার কোন এখতিয়ারই বিসিবির নেই।

পিসিবি আর পাকি ক্রিকেটারদের অমন বেপরোয়া আচরণের শক্তিটা কোথায় তা অবশ্য দুদিনের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। মাঠে বাংলা মায়ের কুলাঙ্গার সন্তানরা পাকিস্তানি জার্সি গায়ে, পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে, নেচে-গেয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বিজয় উদযাপন করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, একাধিক টিভি চ্যানেলে কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের স্ট্যাটাসে ম্যাচ-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়েও তারা সীমানার চূড়ান্ত লংঘনও করেছে। বাংলাদেশ আর পাকিস্তান একই দেশ এমনি মন্তব্য থেকে শুরু করে পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান কিংবা একাত্তরে পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ায় হতাশা আর পশ্চিম পাকিস্তানকে অভিনন্দন আর পরবর্তী ম্যাচে-পূর্ব পাকিস্তানের জন্য শুভ কামনা- এসব কিছুই ত্রিশ লাখ শহীদ আর পাচ লাখ বীরাঙ্গনার সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে মুজিব শতবর্ষ আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর যুগপৎ উদযাপনকে কলংকিত করেছে। আর এসব কারণেই প্রতিবাদে উত্তাল বাংলাদেশ।

বিসিবির এক সময় নাম ছিল বিসিসিবি, অর্থাৎ বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড। নামটি একটু স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে যায় বলেই সম্ভবত পরবর্তীতে কন্ট্রোল শব্দটি বাদ দিয়ে এর নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড বা সংক্ষেপে বিসিবি। দুষ্টুলোকে বলছে সমস্যাটা আসলে সেখানেই হয়ে গেছে। নাম থেকে কন্ট্রোল শব্দটি বাদ দিয়ে বিসিবি এখন সব রকমের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। কাজেই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে, মুজিববর্ষে আনকোরা একটা বাংলাদেশ জাতীয় দলকে পাকিস্তানের মুখোমুখি করাটা তাদের কাছে সমস্যা বলে মনে হয়নি।

অনেকে আবার বলছেন বিষয়টি অমন ভাবে না দেখার জন্য। খেলায় হারলেই কি দেশ হারে নাকি? আমিও এর সাথে সম্পূর্ণ সহমত। কিন্তু বিশ্বকাপে ভারতকে হারিয়ে যখন পাকিস্তানের সিটিং ক্যাবিনেট মন্ত্রী ঘোষণা করে যে এর মাধ্যমে ইসলামের বিজয় সূচিত হয়েছে, ভুলে যায় যে এর আগে ভারতের কাছে তাদের দফায় দফায় টি-২০ পরাজয় মানে ইসলামের পরাজয় ছিল না, তখন ওই শারমেয় শাবকরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ডিসেম্বরের ঠিক আগে আগে এই সিরিজ জয়টিকে কীভাবে মূল্যায়ন করছে তাতো বলাই বাহুল্য। কাজেই বর্ণবাদের কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট টিম যে দশকের পর দশক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাইরে ছিল সেই উদাহরণ না টেনে এনেও, আমি চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি যে, এ বিষয়টিকে আমাদের অত উদারভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই।

তবে আমি অন্য একটি কারণে ক্রিকেট বোর্ডের কাছে কৃতজ্ঞ। এই সময়টায় পাকিস্তান ক্রিকেট দলটাকে বাংলাদেশে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এসে তারা আমাদের মানসচক্ষু খুলে দিয়েছেন। পাকিস্তানে তৈরি আর পাক সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর সরবরাহ করা যে আর্জেস গ্রেনেডগুলোয় ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল বাংলাদেশ, সেই আঘাতের ক্ষত সরাসরি বহন করেও ক্রিকেট বোর্ড যখন এমনি সময়ে পাকিস্তান ক্রিকেট দলটাকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ঢাকায় উড়িয়ে আনলো, তখন আমার ক্ষোভের চেয়ে বিস্ময়বোধ হয়েছিল অনেক বেশি। কিন্তু এখন আমি বুঝতে পারছি যে এতে আসলে শাপে বরই হয়েছে।

গত কিছুদিন ধরেই পাকিস্তানের মূল ধারার আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসার ফল্গুধারা বইছিল। বলা হচ্ছিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুজিববর্ষেই পাকিস্তান সফরে যাবেন। আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, একাত্তরে বাংলাদেশের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধিনায়ক লেফটেনেন্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজীর ভাতুস্পুত্র ইমরান খান নিয়াজীর আসন্ন বাংলাদেশ সফরের গুজবতো এখন ইথারে ইথারে।

ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাই কমিশনারের মাননীয় প্রধানন্ত্রীর সাথে সাম্প্রতিক রুটিন স্বাক্ষাতের পর গুজবটি আরও ডাল-পালা মেলতে শুরু করেছিল। কয়লা ধুলে হয়তো ময়লা গেলেও যেতে পারে, কিন্তু পাকিস্তান যে যেইকার সেই রয়ে গেছে, এ বিষয়টি এ যাত্রায় ওরাই আমাদের আরো একবার চোখে আঙুল দিয়ে ভালোমত বুঝিয়ে দিয়ে গেল।

২০০০ সালে পাকিস্তানি পতাকা উড়ানোর প্রতিবাদ করায় সে সময়কার ৬৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি কামাল হোসেনকে গুলি করে হত্যা করেছিল একাত্তরের রাজাকার আর প্রয়াত লেফটেনেন্ট জেনারেল হোসেন মোহাম্মদ এরশাদের মনোনীত অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ডেপুটি মেয়র জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেলের দুই কুলাঙ্গার ছেলে। গত তেরটি বছর ধরে বাংলাদেশে স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি টানা ক্ষমতায় থাকায় আমাদের মধ্যে এক ধরনের আত্মতুষ্টি চলে এসেছিল যে এই বাংলাদেশ বোধহয় সেই জায়গা থেকে অনেকদূর সরে এসেছে। সেই ভুলটাও এ যাত্রায় আমাদের ভালোমতই ভেোঙ গেছে। আমরা যে জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল আর ‘মেরি মি আফ্রিদির’ জমানা থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি, এমনি স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও না, আর এমনকি আওয়ামী লীগ তের বছর টানা ক্ষমতায় থাকার পরেও না, সেটা বুঝতে আমাদের এখন আর বাকি নেই।

আর সবচেয়ে বড় কথা আমরা সকাল-বিকাল হাইব্রিড-হাইব্রিড বলে যতই চিৎকার করি না কেন, শুধু যে হাইব্রিডই নয়, বরং আমাদের পোড়খাওয়া মানুষগুলোর অবক্ষয়ও যে আমাদের জন্য সমস্যার সেই শিক্ষাটাও আমাদের এ যাত্রায় হয়ে গেল। পাশাপাশি আমরা যারা কথায় কথায় আমাদের আদর্শিক অবক্ষয়ের জন্য ধর্মীয় শিক্ষাকে দায়ী করি, তাদেরও বোধহয় মিরপুর গ্যালারিতে আধুনিক পোশাক পরিহিতা আধুনিক বাঙালি ললনাদের নগ্ন পাকিস্তান প্রীতিতে বুঝতে আর বাকি নেই যে এই প্রজাতিটিও ভবিষ্যতের বাংলাদেশের জন্য বড় মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কাজেই বিসিবিকে ধন্যবাদ না দিয়ে আর পারলাম না।


লেখক : ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *