মিজানুর রহমানঃস্টাফ রিপোর্টার।
করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারীতে বাংলাদেশে মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৩ শতাংশ। রবিবার পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বেলজিয়ামে মৃত্যুর হার ১৫.৯ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ১৪ শতাংশ, স্পেন ১১.৪ শতাংশ, ইতালি ১৪.৫ শতাংশ, সুইডেন ৮.১ শতাংশ, ফ্রান্স ১৪.৯ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ৫ শতাংশ, নেদারল্যান্ডস ১২.২ শতাংশ, ব্রাজিল ৪.৩ শতাংশ, কানাডায় ৮.২ শতাংশ, সুইজারল্যান্ডস এ ৬.২ শতাংশ, মেক্সিকোতে ১২.৪ শতাংশ, ইরান ৪.৭ শতাংশ, জার্মানী ৪.৬ শতাংশ, মিশরে ৪.২ শতাংশ, পাকিস্তান ২ শতাংশ, আফগানিস্তান ২.৩ শতাংশ, ভারতে ৩ শতাংশ, বাংলাদেশে ১.৩ শতাংশ, জাপানে ৫.৩ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ায় ১.৪ শতাংশ এবং চীনে মৃত্যুর হার ৫.৫ শতাংশ।
করোনাভাইরাস মহামারী থেকে মানুষের জীবন বাঁচাতে, মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে শুরু থেকেই গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে দরিদ্র মানুষকে ত্রাণ সহযোগিতার পাশাপাশি জীবিকা ও অর্থনীতি বাঁচাতে নিয়েছেন নানান পদক্ষেপ। করোনা সংকট মোকাবিলায় দ্রুত বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ায় দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসিত হচ্ছেন শেখ হাসিনা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ফোর্বস ম্যাগাজিনসহ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করা হয়েছে।
২৪ এপ্রিল এক আর্টিকেলে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপের প্রশংসা করেছে বিখ্যাত ম্যাগাজিন ফোর্বস। একইসঙ্গে প্রশংসা করা হয়েছে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বেরও।
শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপের বিষয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ১৬১ (১৬ কোটির বেশি) মিলিয়ন মানুষের বাস। দেশটির প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দক্ষতার সঙ্গে সংকট মোকাবিলা করা তার জন্য নতুন কিছু নয়। এরই ধারাবাহিকতায় করোনা মোকাবিলায়ও তিনি নিয়েছেন দ্রুত পদক্ষেপ। যার প্রশংসা করেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামও।
এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামের আয়োজিত ‘এনহ্যান্সিং রিজিওন্যাল কো-অপারেশন ইন সাউথ এশিয়া টু কমব্যাট কোভিড-১৯ রিলেটেড ইমপ্যাক্ট অন ইটস ইকোনোমিকস’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল সম্মেলনে গণভবন থেকে যোগ দেন শেখ হাসিনা। এ সম্মেলনে বিশ্বকে এক হয়ে করোনা মোকাবিলা করার আহ্বান জানান তিনি।
১৫ মার্চ গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে কোভিড-১৯ ঠেকানোর লড়াইয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে সার্ক নেতাদের আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।
২৫ মে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সহায়তা প্রদান বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। শি জিনপিংয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী পরে চীন বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশে আসে।
৪ জুন ভার্চ্যুয়াল প্ল্যাটফর্মে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (গাভি) আয়োজিত ভ্যাকসিন সামিটে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি দ্রুত ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আহ্বান জানান এবং সংস্থাটির তহবিল বাড়াতে অনুদান দিতে বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। এসব অনুষ্ঠানে প্রশংসিত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
করোনা মহামারীর এই সংকটে জনগণের পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যতদিন না এই সংকট কাটবে, ততদিন আমি এবং আমার সরকার আপনাদের পাশে থাকব।
সরকার মানুষের জীবন ও জীবিকা নিশ্চিতের জন্য কাজ করে যাচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একদিকে মানুষকে বাঁচানো, আবার মানুষের খাদ্যের ব্যবস্থা, চিকিৎসার ব্যবস্থা, শিক্ষার ব্যবস্থা সেগুলো যাতে ঠিক থাকে সেদিকেও আমরা বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখছি। সেজন্য আমি দেশবাসীকে বলবো, স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য যা যা নির্দেশনা সেগুলো মেনে চলে নিজের জীবনকে চালাতে হবে।
করোনা সংকট কাটিয়ে উঠতে প্রতিমূহুর্তের করণীয় ঠিক করতে দিনরাত এক করে কাজ করে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম গণমাধ্যমকে বলেন, করোনাভাইরাস মহামারী পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের মানুষের জীবন এবং অর্থনীতিকে বাঁচাতে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি সার্বক্ষণিক সবকিছুর খোঁজ-খবর রাখছেন এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা হচ্ছে দুটো বিষয়। একটা হচ্ছে জীবন, আরেকটা হচ্ছে জীবিকা। প্রথম থেকেই ওনার কনসার্ন ছিল জীবন যাতে করে ব্যাহত না হয়।
গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী সবকিছু সমন্বয় করছেন জানিয়ে আহমদ কায়কাউস বলেন, প্রধানমন্ত্রী সবার সঙ্গে বসে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। … প্রতিদিনই তিনি বিভিন্নজনের সঙ্গে বৈঠক করছেন, সব সময় তিনি আপডেট নিচ্ছেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
অর্থনীতি ও জীবন বাঁচাতে শেখ হাসিনার নেওয়া যত পদক্ষেপ
• দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা এবং পাবলিক পরীক্ষা স্থগিত করে সরকার।
• অনলাইন, টেলিভিশনের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা।
• করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে গত ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে অবধি সাধারণ ছুটি ঘোষণা।
• চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসনসহ করোনা যুদ্ধে ফ্রন্ট লাইন যোদ্ধাদের জন্য পিপিই-মাস্কসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী নিশ্চিত করা।
• টেস্টিং কিট আমদানি, দেশের বিভিন্ন স্থানে ল্যাব স্থাপনসহ পরীক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা।
• করোনা মোকাবেলার ফ্রন্টলাইন যোদ্ধাদের জন্য ৫-১০ লাখ টাকার স্বাস্থ্য বীমা এবং এর ৫ গুণ জীবন বীমা ঘোষণা।
• ২ হাজার ডাক্তার ও ৫ হজার ৫৪ জন নার্স নিয়োগ। আরও ৫ হাজার স্বাস্থ্য টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়া হবে।
• স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শের জন্য ৩টি হটলাইন (১৬২৬৩; ৩৩৩ ও ১০৬৫৫) চালু।
• করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিভাগ, জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি গঠন।
• ভিডিও কনফারেন্সিংয়ে সংযুক্ত হয়ে জেলার কর্মকর্তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া।
• প্রধানমন্ত্রী সঙ্কট মোকাবিলায় ১ এপ্রিল ৩১টি, ১৬ এপ্রিল ১০টি, ২০ এপ্রিল ১৩টি এবং ২৭ এপ্রিল ১০টি নির্দেশনা দেন।
• করোনা পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে চাঙা রাখতে ১৯টি প্যাকেজে ১ লাখ ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা। যা জিডিপি’র ৩.৭ শতাংশ।
• ভাতা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধি ৮১১ কোটি টাকার, গৃহহীন মানুষের জন্য ঘর তৈরির জন্য ২ হাজার ১৩০ কোটি টাকা।
• বোরো ধান/চাল ক্রয়ের কার্যক্রম (অতিরিক্ত ২ লাখ টন) ৮৬০ কোটি টাকার এবং কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ ২০০ কোটি টাকা।
• ভিজিডি, ভিজিএফ, ১০ টাকায় খাদ্য সহায়তা ও অন্য সহায়তা প্রাপ্ত প্রায় ৭৬ লাখ পরিবার বাদ দিয়ে অবশিষ্ট প্রায় ৫০ লাখ করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে মুজিববর্ষ উপলক্ষে মে/২০২০ মাসে এককালীন ২৫শ টাকা হারে মোট ১২শ ৫০ কোটি টাকা নগদ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
• স্নাতক ও সমমান পর্যায়ের ২০১৯ সালের ২ লাখ ৯ হাজার ৬৭৪ জন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে উপবৃত্তি বাবদ ১০২ কোটি ৭৪ লাখ ২ হাজার ৬শ টাকা এবং টিউশন ফি বাবদ ৮ কোটি ৬৬ লাখ ৪১ হাজার ২০০ টাকা বিতরণ।
• প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের কার্যক্রম আরও সম্প্রসারিত করে জুলাই ২০২০ থেকে দেশের ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে স্নাতক পর্যায়ের দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের উপবৃত্তি দেওয়া হবে।
• ৫০ লাখ মানুষের জন্য রেশন কার্ড করা আছে যারা ১০ টাকায় চাল পান। নতুন আরও ৫০ লাখ রেশন কার্ড দেওয়ার ব্যবস্থা। এতে প্রায় ৫ কোটি মানুষ উপকৃত হবেন।
• কৃষি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে কৃষকদের জন্য আউশ ধানের বীজ ও সার বিনামূল্যে পৌঁছানোর উদ্যোগ।
• বোরো মৌসুমে ৮ লাখ মেট্রিক টন ধান, ১০ লাখ মেট্রিক টন চাল, ২ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন আতপ এবং ৮০ হাজার মেট্রিক টন গমসহ সর্বমোট ২১ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য সংগ্রহের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
• কৃষি যান্ত্রীকিকরণে অঞ্চলভেদে উপকরণ ক্রয়ের জন্য ৭০ শতাংশ পর্যন্ত সরকারি ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে।
• ৬৪ জেলার ত্রাণ কার্যক্রমের সমন্বয় সাধনের জন্য ৬৪ জন সচিবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
• ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ। অভিযুক্ত জনপ্রতিনিধিদের বহিষ্কার করা হয়েছে।
• ২৮ জুন পর্যন্ত সারাদেশে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে দুই লাখ ১১ হাজার ১৭ মেট্রিক টন এবং বিতরণ করা হয়েছে এক লাখ ৮৮ হাজার ২৪ মেট্রিক টন। এতে উপকারভোগী পরিবারের সংখ্যা এক কোটি ৬২ লাখ ৯৫ হাজার ৯০৪ এবং উপকারভোগী লোকসংখ্যা সাত কোটি ১৪ লাখ ৮৩ হাজার ৯৫ জন।
• শিশুখাদ্যসহ অন্যান্য সামগ্রী ক্রয়ের জন্য নগদ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রায় ১২৩ কোটি টাকা।
• করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যে রমজান উপলক্ষে কওমি মাদ্রাসাগুলোকে ১৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, মসজিদগুলোর জন্য ১২২ কোটি ২ লাখ ১৫ হাজার টাকা অর্থ সহায়তা।