শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা ও আর্থিক খাতে অগ্রগতি

অর্থনীতি প্রচ্ছদ

প্রণব কুমার পান্ডেঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এক সময় বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। এই তলাবিহীন ঝুড়ি ভারতসহ অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের তুলনায় দ্রুত সম্প্রসারিত অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে পৃথিবীর বুকে।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এক দশক ধরে, পুরো বিশ্ব বাংলাদেশের অর্থনীতির অভূতপূর্ব অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার বেশিরভাগ লক্ষ্য অর্জনে দেশটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। এমডিজির আওতায় বেশিরভাগ সামাজিক সূচকের লক্ষ্য অর্জনে আমাদের দেশ প্রতিবেশী ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে। আর এ কারণেই নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন প্রায়শই এই খাতে বাংলাদেশের অর্জনের প্রশংসা করেছেন।

এটা অত্যন্ত আনন্দের যে, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.২২৭ মার্কিন ডলারে। মাথাপিছু আয় (১৯৪৭ মার্কিন ডলার) এবং অনেক মূল অর্থনৈতিক সূচকে আমাদের দেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। এই উত্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ করোনা অতিমারির কারণে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ অর্থনীতির গতি বজায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছে।

এখানে উল্লেখ্য যে, ২০০৭ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতের তুলনায় অর্ধেক ছিল। দেশের অর্থনীতির উন্নতির ভিত্তিতে আইএমএফ ধারণা করেছে যে, ২০২৫ সালে মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, মাথাপিছু আয়ের এ জাতীয় প্রবৃদ্ধি দেশের অর্থনৈতিক শক্তির পরিচায়ক।

জনসংখ্যাতাত্ত্বিক সুবিধা, শক্তিশালী রেডিমেড গার্মেন্টস (আরএমজি) রপ্তানি ও স্থিতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে দেশে প্রবৃদ্ধি অর্জন সহজ হয়েছে। টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেশকে নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জনে সহায়তা করেছে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে। ২০২৪ সালে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও করোনা অতিমারি সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী বিপর্যয়ের কারণে এর সময় দুই বছর বাড়ানো হয়েছে।

সবচেয়ে সন্তোষজনক বিষয় হলো, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য জাতিসংঘের উন্নয়ন নীতি কমিটির (ইউএন সিডিপি) অনুমোদন পেয়েছে। এমনকি অতিমারির আগে দেশে দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেয়েছিল ব্যাপক হারে। যদিও অতিমারির কারণে তা আবার কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন ইতিবাচক অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হলেও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে গত দেড় বছরে করোনা অতিমারির কারণে আমাদের দেশ অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত এবং অন্যান্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। তবে, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, অতিমারি মোকাবিলা করেও বিশ্বের বড় অনেক অর্থনীতির তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ শক্তিশালী অবস্থায় রয়েছে।

এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, গত এক দশকে বাংলাদেশ কীভাবে এই অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে? জনসংখ্যাতাত্ত্বিক সুবিধা, শক্তিশালী রেডিমেড গার্মেন্টস (আরএমজি) রপ্তানি এবং স্থিতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে শেখ হাসিনার নেতৃত্বই অর্থনীতিকে সঠিক পথে চালিত করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। একসময় দেশের জনগণ জাতীয় বাজেট বাস্তবায়নের জন্য সরকারের সক্ষমতা সম্পর্কে সংশয়ী ছিল। তবে এটি আমাদের দেশে ইতিমধ্যে বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে সরকারের উল্লেখযোগ্য সাফল্য এবং এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির শক্তিশালী রূপটি ফুটে উঠেছে।

সরকার সাফল্যের সঙ্গে মাথাপিছু আয়, জিডিপিতে প্রবৃদ্ধিসহ সামাজিক সূচকের লক্ষ্য অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে পদ্মা সেতু, ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প, কর্ণফুলী নদীর তলদেশের টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়েসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নেও তার সামর্থে্যর পরিচয় দিয়েছে। এ ধরনের প্রকল্প বাংলাদেশের জনগণের কাছে স্বপ্নের প্রকল্প ছিল।

এক দশক আগেও দেশের জনগণ এমন উন্নয়নের সাক্ষী হওয়ার কথা ভাবতেও পারত না। তবে শেখ হাসিনার নিবেদিত নেতৃত্ব এই স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করেছে। বিশ্বব্যাংক যখন দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন না করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন বাংলাদেশের নাগরিকরা স্বপ্নেও ভাবেনি যে, এই প্রকল্পটি দেশে নির্মিত হবে। তবে শেখ হাসিনা নিজস্ব উৎসের অর্থায়ন থেকে এই মেগা প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ব্যাপারে তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন বিধায় পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান হয়েছে।

গত দেড় বছরে করোনা অতিমারির ধ্বংসাত্মক প্রভাবের মুখোমুখি না হলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও শক্তিশালী হতো। তবে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে অতিমারি মোকাবিলা করার জন্য শেখ হাসিনা প্রশংসার দাবিদার। বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিগুলো যখন অর্থনীতির গতি এবং স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হিমশিম খাচ্ছে, ঠিক সেই সময় শেখ হাসিনা অর্থনৈতিক গতিশীলতা বজায় রাখতে এবং অতিমারির স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত বিপর্যয় মোকাবিলায় সফল হয়েছেন। আর এই কারণেই আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এখনও সঠিক পথে রয়েছে, এবং আমরা অতিমারির স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত বিপর্যয়কে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করছি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তবে, তিনি তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে পারেননি কারণ বিশ্বাসঘাতকরা তাকে পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যের সঙ্গে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে নির্মমভাবে হত্যা করে। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরে, বাংলাদেশ দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সরকারি বর্বরতার কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে থাকার লড়াই করে।

শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে দলের এই দুঃসময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য দেশে ফেরেন। তার পর থেকে তিনি শুধু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে শক্তিশালীই করেননি বরং ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠায় পিতার অসম্পূর্ণ স্বপ্ন অর্জনে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। তিনি তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য সঠিক পথে এগিয়ে চলছেন। তার এই যাত্রাপথ নিষ্কণ্টক ছিল না। তাকে নানা ধরনের অত্যাচার ও ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হতে হয়েছে এই যাত্রাপথে।

এমনকি রাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট বিভিন্ন গোষ্ঠী বহুবার তাকে হত্যার চেষ্টা করেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেকে পিতার মতো একজন পরিণত ও দূরদর্শী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বলেই আমরা তার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। সকল প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে তিনি বাংলাদেশকে উন্নয়নের পরবর্তী ধাপে নিয়ে যেতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছেন বিধায় আমাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে এবং ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পেরেছি গত ১২ বছর।

লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *