আধুনিক নৌবাহিনী গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ প্রধানমন্ত্রীর

জাতীয়

বাংলাদেশ যুদ্ধ নয় শান্তি চায়, উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্রসীমা এবং সম্পদ রক্ষায় আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকালে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে নতুন সংযোজিত যুদ্ধ জাহাজ ‘বানৌজা সংগ্রাম’-এর কমিশনিং প্রদানকালে প্রদত্ত ভাষণে একথা বলেন।

চট্টগ্রামের নৌঘাঁটি বিএনএস ঈসা খানে অনুষ্ঠিত মূল অনুষ্ঠানের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে সংযুক্ত হন। বঙ্গবন্ধুর করে যাওয়া দেশের পররাষ্ট্রনীতির প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা কারো সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাই না। আমরা শান্তি চাই।’

‘আমরা শান্তি চাই, এটা যেমন সত্য আবার কেউ যদি আমাদের ওপর হামলা করে তাহলে সেটা যেন আমরা যথাযথভাবে মোকাবেলা করতে পারি সেজন্য যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন প্রতিষ্ঠান আমরা গড়ে তুলতে চাই।’

তিনি বলেন, ‘সেজন্যই আমরা চাচ্ছি আমাদের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীসহ প্রতিটি প্রতিষ্ঠান যেন আধুনিক জ্ঞান সম্পন্ন হয়।’

তার সরকারের উদ্যোগে দেশে আন্তর্জাতিক মানের যুদ্ধ জাহাজ তৈরির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা নিজেরাও এখন দেশে স্বল্প পরিসরে নৌবাহিনীর জাহাজ বানানো শুরু করেছি, মেরামত করছি এবং বন্ধু প্রতিম দেশের সঙ্গে মিলে যেখানে যা প্রয়োজন তা করে যাচ্ছি।’

‘তবে, ভবিষ্যতে এ ধরনের জাহাজ যেন আমরা নিজেরাই তৈরি এবং রপ্তানি করতে পারি সেজন্য আমাদের জানতে হবে, শিখতে হবে এবং এই চিন্তাটাকেও মাথায় রাখতে হবে,’ বলেন তিনি।

তিনিই সর্বপ্রথম খুলনা শিপইয়ার্ডকে নৌবাহিনীর দায়িত্বে দিয়ে দেন এবং পাশাপাশি চট্টগ্রাম এবং নারায়ণগঞ্জের দুটি ড্রাইডকেও নৌবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন বলে উল্লেখ করেন।

তিনি কমিশনিং করা এই যুদ্ধ জাহাজ ‘বানৌজা সংগ্রাম’-এর জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যোগদানে লেবাননে যাওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, করো সঙ্গে বৈরিতা নয়-’ সেই নীতি নিয়েই আমরা চলবো। কাজেই যেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা দরকার সেখানে আমাদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা সবসময় অব্যাহত থাকবে। এই সহযোগিতা আমরা করে যাব।’

সরকার প্রধান বলেন, ‘জাতিসংঘের সদস্যভূক্ত দেশ হিসেবে এটাকে আমাদের কর্তব্য বলে আমরা মনে করি। তবে, অহেতুক ঝুঁকি না নিয়ে সকলে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবেন।’

শেখ হাসিনা এ সময় কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেই দায়িত্ব পালনেরও পরামর্শ দেন।

তিনি বলেন, ‘আমি নৌবাহিনীর সকল সদস্যকে বলবো আপনার নিজেদের সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করেই স্ব-স্ব দায়িত্ব পালন করবেন।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই করোনাভাইরাসের সময় নিজেকে এবং পরিবারকে সকলে সুরক্ষিত রাখবেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে এই সময় নৌ বাহিনীর সকল সদস্য এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য তিনি সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল ও দোয়া কামনা করেন।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রধান এডমিরাল আওরঙ্গজেব চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি ক্রমে বানৌজা সংগ্রামের কমিশনিং ফরমান জাহাজটির অধিনায়ক ক্যাপ্টেন আরিফুর রহমানের কাছে হস্তান্তর করেন।

অনুষ্ঠানে জাহাজটি নিয়ে একটি ভিডিও ডকুমেন্টারিও প্রদর্শিত হয়। গণচীনে তৈরি বানৌজা সংগ্রাম ৯০ মিটার দীর্ঘ এবং ১১ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট। শত্রু বিমান, জাহাজ এবং স্থাপনায় আঘাত হানতে সক্ষম জাহাজটি আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন কামান, ভূমি থেকে আকাশে এবং ভূমি থেকে ভূমিতে উৎক্ষেপণযোগ্য মিসাইল, অত্যাধুনিক থ্রিডি রাডার, ফায়ার কন্ট্রোল সিস্টেম, রাডার জ্যামিং সিস্টেমসহ বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধ সরঞ্জামাদিতে সুসজ্জিত। জাহাজটিতে হেলিকপ্টার অবতরণ ও উড্ডয়নের জন্য ডেক ল্যান্ডিংসহ অন্যান্য সুবিধাদি রয়েছে।

সূত্র জানায়, গভীর সমুদ্রে দীর্ঘ সময়ব্যাপী মোতায়েনযোগ্য এ জাহাজর মাধ্যমে বিশাল সমুদ্র এলাকায় অনুপ্রবেশ ঠেকানো, চোরাচালান ও জলদস্যুতা রোধ, সমুদ্রে উদ্ধার তৎপরতা, সমুদ্র অর্থনীতির বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনাসহ মৎস্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার পাশাপাশি তেল, গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বরাদ্দকৃত ব্লকসমূহের অধিকতর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

’৯৬ সালে সরকার গঠনের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সে সময় বিশ্বমন্দা অব্যাহত থাকলেও তার সরকার দায়িত্বে এসেই অত্যাধুনিক ফ্রিগেট ‘বানৌজা বঙ্গবন্ধু’ ক্রয় করে এবং নৌবাহিনীকে আরও সুসংগঠিত এবং সুসজ্জিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে।

পুনরায় ২০০৮-এর নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর থেকে এই ক’বছর তার দল টানা দায়িত্বে থাকায় জাতির পিতার ১৯৭৪ সালে প্রণীত প্রতিরক্ষা নীতিমালার ওপর ভিত্তি করেই ফোর্সেস গোল-২০৩০ প্রণয়ন করে এবং সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীসহ প্রতিটি বাহিনীকে শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমাদের নৌবাহিনীতে সাবমেরিন এবং এভিয়েশন সিস্টেম যুক্ত হয়েছে। এখন আমাদের নৌবাহিনী ত্রিমাত্রিক।’

জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পাশের দেশ ভারত এবং মিয়ানমারের সঙ্গে বন্ধুত্ব অটুট রেখে আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে মামলা করে বাংলাদেশের জন্য বিশাল সমুদ্রসীমা প্রাপ্তিতে তার সরকারের সাফল্যও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, ‘জাতির পিতা আমাদের সমুদ্রসীমা সমস্যা দূর করার উদ্যোগ নিলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে ’৭৫ পরবর্তী সরকারগুলো এ বিষয়ে কোন উদ্যোগ নেয়নি।’ তারা বিষয়টিতে ‘ওয়াকিবহাল’ ছিলেন কি না তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।

সরকার প্রধান বলেন, ’৯৬ সালে সরকারের আসার পরই তিনি উদ্যোগ গ্রহণ করে অনেকদূর পর্যন্ত কাজ এগিয়ে রেখে যান এবং ২০০৮ সালে পুনরায় রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর সমুদ্রে বাংলাদেশের যে অধিকার তা আদায়ের প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন।

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে মিয়ানমার এবং ভারত-এই দুই প্রতিবেশীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে আমরা আমাদের সমুদ্রসীমা অর্জন করেছি।

কোভিড-১৯ আঘাত হানার পূর্বে বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, দারিদ্রের সীমা আমরা চল্লিশ থেকে ২০ ভাগে নামিয়ে এনেছিলাম। প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ১৩ ভাগে উন্নীত হয়েছিল । কিন্তু হঠাৎ এক অদৃশ্য অশুভ শক্তি কোভিড-১৯ এর আক্রমণে সমগ্র বিশ্ব আজ স্থবির হয়ে পড়েছে। যাতায়াত, সামাজিক যোগাযোগসহ সবকিছুতেই একটা ভীতির সঞ্চার হয়েছে।

তিনি বলেন, এই অদৃশ্য শক্তিকে অনেক শক্তিধর দেশ ও মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আমরা চাই এই অবস্থা থেকে মুক্তি, সারাবিশ্ব মুক্তি পাক এবং আমরাও যেন মুক্তি পাই। এই করোনা ভাইরাসের হাত থেকে একদিন বাংলাদেশ এবং বিশ্ব মুক্তি পাবে এবং মানুষ আবারো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে বলেও দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী নৌসেনা এবং ‘অপারেশন জ্যাকপট’ পরিচালনা করতে গিয়ে শাহাদৎবরণকারী শহিদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে সদ্য কমিশনিং প্রাপ্ত যুদ্ধ জাহাজটির নাম ‘সংগ্রাম’ যথোপযুক্ত হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমরা সংগ্রাম করে এবং যুদ্ধ করেই স্বাধীনতা অর্জন করেছি। ইনশাল্লাহ এই জাহাজটি আগামীতে দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনবে।’ বাসস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *