মুহম্মদ নুরুল্লাহ্:তাঁকে অনেকবার দেখেছি জনসভায়, ঘরোয়া সমাবেশ বা মিটিং এ। বিরোধী দলের নেত্রী থাকাকালীন তিনি রাজশাহী আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে তাঁর একটা মতবিনিময়ের প্রোগ্রাম অবশ্যই থাকতো। একবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরী হাউজে আর দুই তিনবার সার্কিট হাউজে এ ধরনের মতবিনিময় হয়েছে, প্রত্যেকটিতে আমি উপস্থিত ছিলাম। এসব অনুষ্ঠানে প্রগতিশীল মানসিকতার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী শিক্ষকবৃন্দই গিয়েছেন। দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর সাথে আলোচনা হয়েছে।
শিক্ষকদের মধ্যে যারা কথা বলতে চেয়েছেন সবাই পেরেছেন। তাঁর সমালোচনা করা হলেও নেত্রী ধৈর্যের সাথে শুনেছেন এবং নোট নিয়েছেন। আমরা যারা তাঁর সাথে মতবিনিময়ে গিয়েছি, উপলব্ধি করেছি যে আমরা আওয়ামী লীগ নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সাথে এমন বন্ধনে আবদ্ধ যা অবিচ্ছেদ্য।
আওয়ামী লীগ কোন দিন রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে পারবে তা ছিল আমাদের কাছে দুরাশা। তবু ১৯৯৬ সালে দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলো। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ২০ বছর ৬ মাস পর তাঁর দল ক্ষমতায়। তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী। এই দুই দশকেরও বেশী সময় ধরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অপাংক্তেয়। তাঁর জয় বাংলা শ্লোগান শুধু যে নির্বাসিত তা নয় সেটি উপহাসের এবং নিন্দার। স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবসে রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতায় অনুপস্থিত স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমির ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারীদল আর সরকারের কথা। শুধু আছে এক মেজরের কথা যিনি বেতারে স্বাধীনতা ঘোষনা করেছেন আর সেই ঘোষণা শুনে জনগণ যুদ্ধ করে দখলদার সৈন্যদের পরাজিত করে বিজয় অর্জন করলো, সেই দখলদার সৈন্যের পরিচয়ও গোপন থাকে তাদের নির্মিত ইতিহাসে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনিক দায়িত্ব দেওয়া হয় সেই সব ব্যক্তিদের যারা পাকিস্তানপন্থী মানসিকতা হৃদয়ে ধারন করেন আর লালন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ এর অ্যাক্ট দ্বারা পরিচালিত। সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপের সুযোগ কম তবু সিনেটের মাধ্যমে ভিসি প্যানেল নির্বাচনের সময় সরকারি এজেন্সিগুলো তাদের পছন্দমত প্রার্থীকে বিজয়ী করার ব্যাপারে কলকাঠি নাড়ায়। ফলে ৭৫ থেকে ৯৫ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারন করেন এবং তা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হবেন এমন কেউ ভিসি হতে পারেন নি। সরকার পরিবর্তনের পর এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে সঙ্গত কারনেই এমন প্রত্যাশা সৃষ্টি হল।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল শিক্ষকদের একটি গ্রুপ ছিল। এই গ্রুপের অনুসারীদের চিন্তাভাবনা সমন্বিত করার জন্য একটি স্টিয়ারিং কমিটি ছিল। আমিও স্টিয়ারিং কমিটির একজন সদস্য। স্টিয়ারিং কমিটির একটা মিটিং হল। মিটিং এ সিদ্ধান্ত হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক সর্বোচ্চ পদগুলোতে পরিবর্তনের জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানাতে হবে। আমরা পাঁচজন শিক্ষকের একটি তালিকা করে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে পাঠালাম, আমাদের বিবেচনায় এই পাঁচজনের মধ্য থেকে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য নিয়োগ করা যেতে পারে।
একদিন শোনা গেল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসছেন নাটোরের উত্তরা গণভবনে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম তাঁর সাথে দেখা করে আমাদের আবেদন জানিয়ে আসবো। তাকে অনুরোধ করবো অন্ততঃ উপ-উপাচার্য বদল করে প্রগতিশীল চিন্তাধারার একজনকে নিয়োগ দিতে। নির্ধারিত দিনে দুপুরের দিকে আমাদের গ্রুপের নেতৃস্থানীয় ৭-৮ জন উত্তরা গণভবনে চলে গেলাম।
একটু পরে ওখানে দায়িত্বরত প্রধানমন্ত্রীর কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ হল। তারা জানালেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের সাথে সবার শেষে কথা বলবেন। যাতে আমরা যথেষ্ট সময় পাই কথা বলার জন্য। ওখানে তখন সরকারী লোকজন ছাড়াও রাজনীতি সংশ্লিষ্ট একটার পর একটা গ্রুপের সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সাথে সাক্ষাৎ চলছে। আমরা আশ্বস্ত, অপেক্ষা করছি শেষ সময়ের জন্য।
সম্ভবতঃ তখন বিকাল সাড়ে চারটা। হঠাৎ শোনা গেল আবহাওয়া রিপোর্ট ঝড়ের পুর্বাভাস পাওয়া গেছে। তাড়াতাড়ি ঢাকা রওনা না হলে হেলিকপ্টার ফ্লাই করা ঝুঁকিপূর্ন হয়ে যাবে- এমতাবস্থায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুব দ্রুতই নাটোর ছেড়ে চলে যাবেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই তিনি যে হলঘরে মিটিং করছিলেন সেখান থেকে বের হয়ে আসলেন। বের হয়ে তিনি আমাদের কাছে চলে আসলেন, বললেন, যেখানে মিটিং করছিলাম ঐ ঘরের লোকজন বের হতেও কয়েক মিনিট সময় চলে যাবে। আপনারা আমার সাথে আসুন। তিনি হুকুম দিলেন তাড়াতাড়ি কয়েকটি চেয়ার আনতে। তিন চারটা চেয়ার আনা হয়েছে। আরো অন্তত দুইটা চেয়ার দরকার। এ সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বললেন আপনারা কিছু মনে না করলে এই বিছানাতেই বসুন। বিছানাটি তখন কিছু অগোছালো, ভাল গৃহিনীদের ঘরে যেমন পরিপাটি আর টানটান করে বিছানা পাতা থাকে তেমনটি নয়। তিনি তাড়াতাড়ি বিছানাটির উপর নিপুন হাত বুলিয়ে সেটিকে বেশ পরিপাটি করে নিজ খাটের এককোনে বসলেন আর আমাদের দুই তিনজনকে বসতে দিলেন। আমরা বিস্মিত বাংলাদেশের এই নারী প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে দেখে। তাঁর মনে পদের দেমাক নাই, বড় পদবীধারী ব্যক্তিরা মানসিক দূরত্ব সৃষ্টির জন্য কথা বলার সময় কণ্ঠে যে শীতলতা আনেন তা নেই বরং আছে অতিথি আপ্যায়নের উষ্ণতা আর স্মিত হাসি। তাঁর প্রধানমন্ত্রীর সত্তা বাংলার অতিথিপরায়ন নারী সত্তাকে অতিক্রম করে যায়নি। তাই তিনি নিজ হাতে বিছানার চাদর পরিপাটি করে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের বসতে দিতে পারেন।
২০০১ সালের পরের ঘটনা, তখন তিনি সংসদ বিরোধী দলীয় নেতা, থাকেন সুধাসদনে। আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন শিক্ষক তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছি। সুধাসদনে ঢুকে শুনলাম, তিনি কিছুটা অসুস্থ। বিশ্রামে আছেন। আসতে একটু দেরি হবে। আমরা অপেক্ষা করছি, ঘন্টাখানেক পর তিনি আসলেন। আমরা অতিথিদের অপেক্ষার জন্য একটি ছোট লাউঞ্জে বসে আছি। তিনি তাঁর অফিসে ঢোকার আগেই আমাদের কাছে আসলেন, সৌজন্য বিনিময় হল। তিনি তাঁর এক কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করলেন, উনাদের চা-টা দিয়েছ? কর্মচারী মাথা নাড়ল, দেয়নি। তিনি কিছুটা বিরক্তির সাথে বললেন, এক ঘন্টা হল উনারা এসেছেন, এখন ও চা দেওনি কেন? শীগগির চা দাও। আগে ভিতরে যাও। রাজবাড়ির মিষ্টি আছে, আগে মিষ্টি দাও। তিনি তাঁর অফিস কক্ষে ঢুকলেন অন্য কয়েকজন সাক্ষাৎপ্রার্থীকে নিয়ে। মিষ্টি আসল, রাজবাড়ীর বড় বড় রসগোল্লা। আমরা সাধ্যমত সেগুলোর সদ্ব্যবহার করলাম। পরে তাঁর সাথে অনেকক্ষন কথাবার্তা হল। সেদিন আমরা রাজনীতিবিদ শেখ হাসিনার পাশাপাশি অতিথিবৎসল শেখ হাসিনারও দেখা পেয়েছিলাম।
লেখকঃ সাবেক উপ-উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়