শারমিন জাহানের বিরুদ্ধে মামলা–মাস্ক কেলেঙ্কারি নেপথ্যে হাসপাতালের দুই পরিচালক

অপরাধ দূর্নীতি

করোনা মহামারির মধ্যে নকল মাস্ক সরবরাহের অভিযোগে শারমিন জাহানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) প্রশাসন। গত বৃহস্পতিবার রাতে বিএসএমএমইউ’র প্রক্টর প্রফেসর মোজাফফর আহমেদ বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় মামলাটি দায়ের করেন। শাহবাগ থানার ওসি আবুল হাসান ও বিএসএমএমইউ’র জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার মজুমদার বিষয়টি জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন-১ শাখায় সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত শারমিনের মালিকানাধীন অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনাল ২৭ জুন ১১ হাজার মাস্ক সরবরাহের কার্যাদেশ পায়। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেও শারমিন জাহান কিভাবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সত্ত্বাধিকারী হন এই নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নীতিমালা অনুযায়ী, চাকরির পাশাপাশি ব্যবসা করার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র। অপরদিকে, মাস্ক ক্রয় নিয়ে অভিযোগের তীর উঠেছে বিএসএমএমইউ’র পরিচালক হাসপাতাল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. জুলফিকার আহমেদ আমিন ও সহকারি পরিচালক মো. শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে। তারা দু’জনে মিলে কোনও রকম স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ছাড়াই নিজস্ব লোকদের মাধ্যমে এসব কেনাকাটা করেছেন। এমনকি ক্রয়ের ক্ষেত্রে ছিলোনা টেন্ডার প্রক্রিয়া ও মান যাচাই-বাছাই কমিটি। নিজ ক্ষমতাবলেই পরিচালক ও সহকারি পরিচালক মাস্কসহ করোনার সময়ে সকল কেনাকাটা সম্পন্ন করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

এজাহারের উদ্ধৃতি দিয়ে ওসি আবুল হাসান বলেন, এই কার্যাদেশের বিপরীতে অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনাল ৩০ জুন প্রথম দফায় ১৩শ’, ২ জুলাই দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় ৪৬০ ও ১ হাজার এবং চতুর্থ দফায় ৭০০ মাস্ক সরবরাহ করে। তৃতীয় ও চতুর্থ দফায় পণ্য ‘সামগ্রিক গুণগতমানের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী পাওয়া যায়নি’ বলে অভিযোগ করা হয়।

মামলার অভিযোগ করা হয়, কোনো কোনো ফেইস মাস্কের বন্ধনি ছিঁড়ে গেছে, কোনো মাস্কের ছাপানো ইংরেজিতে লেখা ‘ত্রুটিপূর্ণ’ পাওয়া গেছে। এ ধরনের ত্রুটিতে কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারে, মাস্ক নিম্নমানের ছিল। এর ফলে কোভিড-১৯ সম্মুখ যোদ্ধাদের জীবন মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়তে পারত। এ বিষয়ে গত ১৮ জুলাই অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের সত্ত্বাধিকারী শারমিন জাহানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় বিএসএমএমইউ। ২০ জুলাই লিখিত জবাবে শারমিন দুঃখপ্রকাশ করেন, যা আসামির দোষ স্বীকারের শামিল। বিষয়টি আমলে নিয়ে শারমিন জাহানের বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৪২০ ও ৪০৬ ধারায় মামলা দায়ের করা হয় বলে ওসি জানান। মামলার এজাহারে অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের সত্ত্বাধিকারী শারমিন জাহানের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থাসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে।

শারমিন ২০১৬ সালের ৩০ জুন স্কলারশিপ নিয়ে চীনের উহানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। গত ২৩ জানুয়ারি থেকে উহানে লকডাউন শুরু হলে তিনি দেশে ফিরে আসেন। তার শিক্ষা ছুটির মেয়াদ এখনও শেষ হয়নি। এর মধ্যে চীনে থাকা অবস্থায় ২০১৯ সালের মার্চে অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনাল নামে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান খুলে নিজেই ব্যবসা শুরু করেন।

বিএসএমএমইউ’র পরিচালক (হাসপাতাল) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. জুলফিকার আহমেদ আমিন এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, মোট ৪টি লটে ৩ হাজার ৪৬০টি মাস্ক গ্রহণ করা হয়েছে। এরমধ্যে ত্রুটিপূর্ণ ৯৫৯টি মাস্ক ফেরৎ দেয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনাল এর কাছ থেকে গ্রহণকৃত মাস্কের সংখ্যা ২ হাজার ৫০১টি। ৭৩০ টাকা হিসেবে এর আর্থিক মূল্য ১৮ লাখ ২৫ হাজার ৭৩০ টাকা। তবে শারমিন জাহানকে মাস্ক ক্রয় কি ভিত্তিতে দেয়া হয়েছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে তাকে মোবাইলে কল করলে তিনি রিসিভ করেননি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে একাধিকাবার অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের সত্ত্বাধিকারী শারমিন জাহানের মোবাইলে কল ও এসএমএস করলেও তিনি কোন সারা দেননি।

বিএসএমএমইউ ভিসি প্রফেসর ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া জানিয়েছেন, কারণ দর্শানো নোটিশে অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে যা বলা হয়েছে তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। করোনা মাহামারিতে সম্মুখ সারির যোদ্ধাদের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো ধরণের আপস নয়। এই ঘৃণ্য কাজের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় আইনানুগ ব্যবস্থাসহ সব ধরণের ব্যবস্থা নেবে। মামলা দায়ের ছাড়াও ইতোমধ্যে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে তিন কর্ম দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার সাথে সাথেই পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিরত অবস্থায় অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের সত্ত্বাধিকারী হওয়ার সুযোগ আছে কিনা এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. আখতারুজ্জামান ইনকিলাবকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চালানো অন্যায়। তবে এটি আইনি বিষয় হওয়ায় সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করে যদি কেউ অন্যায়, অসততা ও নীতি বিরোধী কাজ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *