ড. প্রণব কুমার পান্ডে:
বিগত কয়েক বছর ধরে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে ক্রমাগত টানাপোড়েন প্রত্যক্ষ করেছে বাংলাদেশের জনগণ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বিএনপির নির্বাচনের দাবি এবং নির্বাচনের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বিধান অনুসরণে আওয়ামী লীগের দৃঢ় প্রত্যয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে অচলাবস্থা তৈরি করেছে।
এই ধরনের রাজনৈতিক পরিবেশে জনগণের মধ্যে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে তা হলো: বিএনপি কি আদৌও গণআন্দোলনের মাধ্যমে বর্তমান সরকারকে উৎখাত করে তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করতে পারবে? এই নিবন্ধটিতে বাংলাদেশ রাজনীতির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণের মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতি এবং চলমান রাজনৈতিক সংকটের সম্ভাব্য ফলাফলগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি অন্যতম বিষয়। উভয় দলেরই রয়েছে একটি বড় সমর্থক গোষ্ঠী এবং উভয় দলই একটা লম্বা সময় দেশ শাসন করেছে। বিগত ১৫ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে, উভয় রাজনৈতিক দলই একে-অপরের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে চলেছে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য। এই লড়াইয়ের মাধ্যমে প্রত্যেকেই রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থানকে সুসংগত করার চেষ্টা করেছে। তবে, বিভিন্ন ধরনের সমন্বিত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও প্রতিবাদ সমাবেশের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ছাড়িয়ে যাওয়ার বিএনপির প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
অতীতের ধারাবাহিকতায় এবারও বিএনপি নির্বাচনকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করার জন্য গণআন্দোলনের আয়োজন করেছে। দুঃখজনকভাবে, তাদের সেই পরিশ্রম এখনও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আনতে ব্যর্থ হয়েছে এবং সাংবিধানিক বিধান সমুন্নত রাখতে আওয়ামী লীগ তার আনুগত্যে অটুট রেখেছে।
নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবির পক্ষে বিএনপির মূল যুক্তি হলো ক্ষমতাসীন দল তাদের ক্ষমতা ও সম্পদের অপব্যবহার করে নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে তাদের পক্ষে প্রভাবিত করতে পারে। ফলে, তাদের যুক্তি একটি স্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করবে। যদিও এই দাবির পক্ষে তারা তাদের কিছু সমর্থকদের সমর্থন অর্জন করেছে, তবে তাদের দাবি মেনে নিতে আওয়ামী লীগকে বাধ্য করার মতো প্রভাব তারা এখনও দেখাতে পারেনি। এই চলমান টানাপোড়েনের মধ্যে, মার্কিনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ রাজনৈতিক পরিবেশের ওপর পরিচালিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, জরিপে অংশগ্রহণকারী মধ্যে প্রায় ৫৬ শতাংশ উত্তরদাতা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল করার পক্ষে নন। অর্থাৎ জরিপের ফলাফল অনুযায়ী বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির পক্ষে বেশিরভাগ উত্তরদাতা ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে না। অন্যদিকে, একই প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির বিষয়টিও উঠে এসেছে। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৭০ শতাংশ উত্তরদাতা শেখ হাসিনার নেতৃত্ব সম্পর্কে ইতিবাচক মতামত প্রকাশ করেছে। এই ফলাফল বিরোধীদের সরকারকে পদত্যাগের বাধ্য করার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবির ওপর অনিশ্চয়তার ছায়া ফেলেছে।
গণ-আন্দোলনের কার্যকারিতা বিভিন্ন কারণের ওপর নির্ভর করে, যার মধ্যে রয়েছে জনগণের সমর্থনের দৃঢ়তা, সাংগঠনিক দক্ষতা এবং অর্থপূর্ণ সংলাপে অংশ নেওয়ার জন্য সরকারের বাধ্য করা সক্ষমতা। গত প্রায় এক দশকের ওপর সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলনের ডাক দিলেও সেই আন্দোলনের দেশের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল না। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলনে তাদের নেতাকর্মীরা অংশগ্রহণ করছে বিধায় বিএনপি নেতৃত্ব দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষদের অসন্তুষ্টিকে কাজে লাগিয়ে এই আন্দোলনকে জোরদার করতে চাইছে।
তবে, আমরা বিএনপির আন্দোলনের অতীতের দিকে লক্ষ করলে দেখবো, গত এক দশকে তারা কখনোই সরকারকে চাপে ফেলার আন্দোলন করতে পারেনি। অভ্যন্তরীণ বিরোধ, সুসংগত কৌশলের অভাব এবং আন্দোলনের গতি বজায় রাখার অক্ষমতা তাদের সকল আন্দোলনকে ব্যর্থ করেছে। রাজনীতিতে জটিল খেলায় সরকারকে চাপে ফেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা গ্রহণের বাধ্য করায় তারা ব্যর্থ হয়েছে। ফলে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে তারা তাদের দাবি আদায় করতে পারবে এই মর্মে জনগণের মধ্যে আস্থা অর্জন করতে পারছে না। তাছাড়া, গত এক দশকের ওপরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার বাংলাদেশকে যেভাবে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে এবং কোভিড-১৯ অতিমারির বিরুদ্ধে সফলতার সাথে যুদ্ধ করেছে সেই অভিজ্ঞতা সরকারকে জনগণের মধ্যে সমর্থনের দিক থেকে বেশ কিছুটা এগিয়ে রেখেছে।
ফলে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য বিএনপির দাবি প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমে সাংবিধানিক নীতিকে সমুন্নত রেখে নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ দৃঢ় প্রতিশ্রুতি এবং অটুট বিশ্বাস জনগণের সামনে স্পষ্ট করেছে। জনসমর্থনের ওপর ভিত্তি করে ক্ষমতাসীন দল কার্যকরভাবে তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য নাগরিকদের সমর্থন আদায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। তাছাড়া, আওয়ামী লীগ দক্ষ রাজনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে বিরোধী দলের আন্দোলনকে দক্ষতার সাথে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে তার দক্ষতা প্রদর্শন করেছে।
সরকারের ওপর অভ্যন্তরীণ চাপ প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাদের পূর্বের ব্যর্থতাকে মাথায় রেখে বিএনপি লবিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন অর্জনের চেষ্টা করে যাচ্ছে।
সুতরাং, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে জটিল এই রাজনৈতিক সমীকরণের ওপর বাহ্যিক প্রভাবের বিষয়টি সতর্কতার সাথে প্রত্যক্ষ করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। অতীতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সময় আন্তর্জাতিক স্টেকহোল্ডার এবং কূটনীতিকরা যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করলেও বর্তমান সরকার বহিরাগত চাপের কাছে নতি স্বীকার না করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। যদিও কিছু দেশ বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে কথা বলছে, অন্যরা বিষয়টিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে বর্ণনা করে আরও সংযত অবস্থান গ্রহণ করেছে। তাই বিএনপির আন্দোলনের ফলাফল নিয়ে দেশের মানুষের মনে যথেষ্ট দ্বিধা রয়েছে।
গত এক দশকের ওপরে ক্ষমতায় থাকার ফলে আওয়ামী লীগ সরকার এই ধরনের চাপ কীভাবে সামলাতে হয় সে বিষয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। তাছাড়া, সরকার এবং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেশে একটি সুষ্ঠু, স্বচ্ছ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়েছে এবং এই বিষয়টি বাস্তবে রূপায়ণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনের বেশ কিছু সংস্কার করা হয়েছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের ব্যাপারে বর্তমান সরকারের অবস্থানকে সাধুবাদ জানানো হয়েছে।
তবে, অনেকেই মনে করতে পারেন বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে চলমান রাজনৈতিক লড়াই একটি জটিল ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে দেশে। অতীতের ধারাবাহিকতায় এই ধরনের ধারণা অমূলক নয়। কারণ, আমরা প্রতি পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচনকে সামনে রেখে এক ধরনের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আর এই কারণেই বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। তবে বর্তমান সরকার তাদের দাবি মেনে নেবে বলে আমি মনে করি না। তাই ফলাফল নির্ভর করবে বিএনপির প্রচেষ্টার শক্তি ও ঐক্য, সরকারের প্রতিক্রিয়া এবং বাহ্যিক প্রভাবের ওপর।
তবে, সার্বিক পরিস্থিতির বিবেচনায় আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না বর্তমান সরকার কোনও অনৈতিক দাবির কাছে মাথা নত করবে। পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। অতএব, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনে সেই ভূ-রাজনৈতিক বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। সেই ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার কিছুটা হলেও সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। বিএনপির সরকার পতনের আন্দোলন অসারতায় পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
লেখক: অধ্যাপক, লোক-প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।