ডা. সাবরিনার দাপটেই আরিফের করোনা টেস্ট প্রতারণা

অপরাধ দূর্নীতি সাস্থ্য ও চিকিৎসা

করোনা পরীক্ষা ছাড়াই ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে গ্রেফতার হওয়া জেকেজি হেলথ কেয়ারের সিইও আরিফ চৌধুরীর প্রতারণার নেপথ্যে ছিলেন তার স্ত্রী ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী। তাদের এক ল্যাপটপেই পাওয়া গেছে ১৫ হাজারেরও বেশি করোনার ভুয়া টেস্ট রিপোর্ট। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক সাবরিনার দাপটেই আরিফ চৌধুরী করোনা পরীক্ষার অনুমতি বাগিয়ে নেন স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে। জেকেজির চেয়ারম্যান হিসেবে সব যোগাযোগ রক্ষা করতেন সাবরিনাই। কিন্তু অপকর্ম ধরা পড়ার পর গা বাঁচিয়ে চলছেন সাবরিনা। গ্রেফতার হয়েছেন জেকেজির আরিফসহ ছয়জন। প্রায় তিন সপ্তাহ পরও ডা. সাবরিনা রয়েছেন বহাল তবিয়তে। অফিস করছেন নিয়মিত। কথা বলছেন গণমাধ্যমের সঙ্গে। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক হিসেবে চাকরিতে থেকেই জেকেজির চেয়ারম্যান পদে ছিলেন ডা. সাবরিনা। কীভাবে, কার মাধ্যমে তিনি এ কাজ হাতিয়েছেন, সে ব্যাপারে চলছে অনুসন্ধান। তদন্তে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে সাবরিনাকে গ্রেফতার করা হবে। তবে করোনা মহামারীর শুরুর দিকে ডা. সাবরিনার তদবিরে জেকেজি স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে করোনার নমুনা সংগ্রহের কাজ বাগিয়ে নেয়। এ কাজ নিতে সাবরিনা স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠকও করেন। কাজ পাওয়ার পরই করোনা টেস্টের নামে ভুয়া সনদ দেওয়া শুরু করেন আরিফুল। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৪৪টি নমুনা সংগ্রহ বুথ বসিয়ে এবং হটলাইন খুলে নমুনা সংগ্রহ শুরু করেন। কোনো পরীক্ষা না করেই প্রতিষ্ঠানটি কমপক্ষে ১৬ হাজার মানুষকে করোনা টেস্টের ভুয়া সনদ দিয়েছে। গুলশানে তাদের অফিসের ১৫ তলার কক্ষে বসেই এসব মনগড়া সনদ তৈরি করে হাজার হাজার মানুষের ই-মেইলে পাঠানো হতো। বুথের বাইরে হটলাইনের মাধ্যমে বাসাবাড়িতে গিয়েও নমুনা সংগ্রহ করতেন জেকেজির কর্মীরা। জানা যায়, আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) একাধিক প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে রয়েছে সাবরিনার সুসম্পর্ক। এই সম্পর্ক কাজে লাগিয়েই স্বাস্থ্য অধিদফতরে প্রভাব খাটাতেন তিনি। একাধিকবার ব্যবহার করেছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নামও। এখনো ওই সম্পর্কই তাকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে আইনের আওতা থেকে। অথচ প্রায় তিন মাস ধরে নমুনা সংগ্রহে জেকেজির সব কর্মকান্ডে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন সাবরিনা। সে সময় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান পরিচয় দিয়ে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন তিনি। পুলিশও বলছে, জেকেজির প্রতারণা থেকে সাবরিনার কোনোভাবেই দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। কারণ তার স্বামী আরিফ চৌধুরী জিজ্ঞাসাবাদে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সাবরিনার সক্রিয় সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদে সাবরিনার কথাও এসেছে। আমরা যখন তার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করেছি, তখন তিনি বলেছেন, চেয়ারম্যান আমার স্ত্রী। আমরা তদন্তের মাধ্যমে খোঁজ নিচ্ছি। প্রমাণ পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল সূত্র জানায়, সাবরিনার বিষয়টি হাসপাতালের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে তদন্ত করতে বলা হয়েছে। জানতে চাইলে অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ডা. নাসিমা সুলতানা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এখনো তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

২৩ জুন করোনার ভুয়া সনদ দেওয়া, জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগে আরিফুলসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে তেজগাঁও থানা পুলিশ। গ্রেফতারের পর থানা-হাজতে থাকা অবস্থায় আরিফুলের ক্যাডার বাহিনী ভাঙচুর ও হামলা করে থানায়। মারধর করে পুলিশকে। এ ছাড়া রাজধানীর মহাখালীর তিতুমীর কলেজে নমুনা সংগ্রহের বুথ বসিয়ে সেখানে প্রশিক্ষণের নামে নানা অনৈতিক কর্মকান্ডের অভিযোগও পাওয়া যায়। কলেজের কক্ষে নারী-পুরুষের আপত্তিকর অবস্থানসহ নানা অনৈতিক কাজে বাধা দিলে তিতুমীর কলেজের শিক্ষক, কর্মচারী ও ছাত্রদের ওপরও হামলা করে আরিফুলের লোকজন। অভিযোগ পাওয়া যায়, রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্নজনকে হুমকি দিতেন আরিফ। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নাম ব্যবহার করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালককেও দেখে নেওয়ার হুমকি দেন তিনি। স্বামী-স্ত্রী মিলে করোনা টেস্টের ভুয়া সনদ বিক্রি করতে থাকেন। প্রতিটি টেস্টের জন্য জনপ্রতি নিয়েছেন সর্বনিম্ন ৫ হাজার টাকা। আর বিদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে জনপ্রতি তারা নিতেন ১০০ ডলার। করোনা টেস্ট কারবার করে জেকেজি হাতিয়ে নিয়েছে কমপক্ষে ৮ কোটি টাকা। এদিকে গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে স্বাস্থ্য অধিদফতর জেকেজির প্রতারণার বিষয়েও তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে। এতে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটির প্রধান সমন্বয়ক আরিফুল চৌধুরী ওভাল গ্রুপ লিমিটেড নামে একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট গ্রুপের স্বত্বাধিকারী। ওভাল গ্রুপ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে স্বাস্থ্যসেবা সপ্তাহ-২০১৮-এর ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব পালন করে। করোনা সংকট শুরুর পর আরিফুল চৌধুরী অধিদফতরে এসে জানান, জেকেজি দক্ষিণ কোরিয়ার মডেলে বাংলাদেশে কিছু বুথ স্থাপন করতে চায়। ওভাল গ্রুপের সঙ্গে আগে থেকেই কাজের অভিজ্ঞতা থাকায় তাদের অনুমতি দেওয়া যায় বলে মনে করে স্বাস্থ্য অধিদফতর বা মন্ত্রণালয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া গেলে স্বাস্থ্য অধিদফতর জেকেজি গ্রুপের সঙ্গে তাদের চুক্তি বাতিল করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *