জিয়াউর রহমান: বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের প্রধান নেপথ্য কুশীলব

প্রচ্ছদ

নিখাদ বার্তাকক্ষ :: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারের হত্যার ঘটনার ইতোমধ্যে ৬ জন খুনির ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। পালিয়ে বেড়াচ্ছে আরো অনেকে। কিন্তু যারা বছরের পর বছর ধরে এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করেছে, তাদের পরিবারও পরবর্তীতে ভোল পাল্টে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে দাবি করে সরলপ্রাণ সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের কূটনৈতিক ও গোয়েন্দা দলিল এবং সাংবাদিকদের কাছে থাকা তথ্য প্রকাশিত হয়ে পড়ায় তাদের ভূমিকাও এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে। ইতিহাসে কখনোই সত্য চাপা থাকে না। সেই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রধান নেপথ্য কুশীলব হিসেবে প্রকাশ হয়ে পড়েছে জেনারেল জিয়াউর রহমানের ভূমিকা। এখন এটি দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে, বেসমারিক মোশতাক গংকে পেছনে থেকে শক্তি ও সাহস দিয়ে এবং জুনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের সামনে রেখে পুরো ঘটনাটি পরিচালনা করেছিল জিয়াউর রহমান।

খুনিদের স্বীকারোক্তিতে বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়ার ভূমিকা

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিভিন্ন সময় এবিষয়ে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছে তার দুই খুনি ফারুক ও রশিদ। সম্পর্কে তারা দুজন ভায়রা ভাই। এছাড়াও মেজর রশিদের সঙ্গে খন্দকার মোশতাকের সম্পর্ক হলো চাচা-ভাতিজা। তাদের এসব সাক্ষাৎকার থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে জিয়াউর রহমানের দীর্ঘমেয়াদি সম্পৃক্ততার কথা জানা যায়।

এক প্রশ্নের জবাবে তারা জানায়, ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পরপরই উপসেনাপ্রধান থেকে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত হয় জিয়াউর রহমান। তখন সে আর বেসামরিক কোনো সরকার দেখতে চায়নি। এমনকি দেশে দ্রুত কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চালুর বিরুদ্ধেও ছিল সে। অতৃপ্ত বাসনা, উচ্চাভিলাষ এবং লোভ জেনারেল জিয়াকে এমনভাবে পেয়ে বসেছিল যে; যে কোনো মূল্যে প্রেসিডেন্ট পদে অভিষিক্ত হতে চাইতো সে। ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর হত্যাকাণ্ডের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল সে। এমনকি পরবর্তীতে রশিদ-ফারুক যৌথভাবে লেখা একটি গ্রন্থতেও তারা এ বিষয়ে স্পষ্ট করে লিখেছে।

এদিকে ১৯৮৫ সালে সাপ্তাহিক মেঘনা পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি শাহরিয়ারও জিয়াউর রহমানের কথা উল্লেখ করেছে। এক প্রশ্নের জবাবে সে বলে, জিয়াউর রহমান সেসময় আর্মির ডেপুটি চিফ ছিল। তার অনেক ফাংশন ছিল। তাই তার সাথে অনেক সময়ই কথা হয়েছে। অনেক জায়গাতেই এসব মিটিং হয়েছে।

এদিকে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ১৯৭৬ সালে বিদেশি সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে এক সাক্ষাৎকার দেয় দুই খুনি ফারুক ও রশিদ। সেখানে ফারুক রহমান বলেছে, ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় আমি উপসেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করি। সে তখন সব শোনে এবং আমাদের এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেয়। তবে সিনিয়র অফিসার হিসেবে নিজে সামনে থাকতে অপারগতা প্রকাশ করে। এরপর খন্দকার মোশতাকের সাথেও কয়েকবার বৈঠকের কথা জানায় ফারুক। এবিষয়ে পরবর্তীতে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস জিয়াউর রহমানের কাছে জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান এটা নিয়ে কথা বলবেন কিনা তা পরে ভেবে জানানোর কথা বলেছিল, কিন্তু সে আর পরে কোনো জবাব দেয়নি।

বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি মাজেদ। সে পরিচয় গোপন করে দীর্ঘদিন ভারতে পালিয়ে ছিল। তাকে গ্রেফতারের পর সেও জানায়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত সেনা সদস্যদের প্রত্যক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে জিয়াউর রহমান। তাদের পরিবার নিয়ে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ দেয় সে। এমনকি প্রাইজ পোস্টিং হিসেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরিও দিয়েছিল সেনাপ্রধান জিয়া।

জিয়ার নির্দেশেই বঙ্গবন্ধুর পর কারাগারে চার নেতাকে হত্যা

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরের দিনই নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে খন্দকার মোশতাক, উপসেনাপ্রধান থেকে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেয় জিয়াউর রহমান। মুখ্য সচিব করা হয় মাহাবুব আলম চাষীকে, যে একসময় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা হিসেবে জুলফিকার আলী ভুট্টোর খুব কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিল। এরপরই দেশজুড়ে আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাহিনী। সামরিক সদস্যদের তীব্র মহড়ার মধ্যে ওই সময়টায় নিজেকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখার জন্য তাদের সঙ্গে বঙ্গভবনে নিয়মিত দরবার চালাত খন্দকার মোশতাক। তবে তিন মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে তার।

কিন্তু তার আগেই মোশতাক ও জিয়াউর রহমান মিলে মুক্তিযুদ্ধকালীন জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, কামারুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে কারাগারে বন্দি করে। এমনকি আইএসআই-এর এক সাবেক বাঙালি গোয়েন্দার মাধ্যমে আত্মগোপনে যাওয়ায় প্রক্কালে তাজউদ্দীন আহমেদকেও আটক করায় জিয়াউর রহমান। পরবর্তীতে সেই কর্মকর্তাকে পুরস্কার হিসেবে এক লাখ ডলার এবং স্কলারশিপ দিয়ে বিদেশে পাঠায় সে। আরো পরে ওই কর্মকর্তা পরিচয় গোপন করে বিবিসি বাংলা বিভাগে চাকরি নেয়। এবং সেখানে বসে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লেগে থাকে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তথ্যপ্রমাণসহ বিবিসিকে সব তথ্য জানালে ওই কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেয় তারা।

এদিকে, জেলে থাকা জাতীয় চার নেতাকে নিজের জন্য হুমকি ভাবতো মোশতাক। একই সঙ্গে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানও নিজের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতা নিশ্চিত করতে এই নেতাদের চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। জেলের মধ্যে সৈন্য পাঠিয়ে জাতীয় নেতাকে হত্যার ব্যবস্থা জিয়াই করে দেয়। এমনকি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যারা মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে অস্বীকার করেছিল, তাদেরও অনেককে অস্ত্র দেখিয়ে হুমকি দেয় জিয়ার সৈন্যরা। এছাড়াও অবৈধভাবে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণার পর মোশতাক যখন প্রথমবার সংসদ অধিবেশনে প্রবেশ করে, তখন সংসদ সদস্যদের অনেকে তাকে দাঁড়িয়ে অভ্যার্থনা না জানানোর দায়ে জিয়াউর রহমানের সৈন্যদের রোষানলে পড়েন। পরেরদিনই ছয় জনকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে জেলে ঢুকানো হয় জিয়ার নির্দেশে।

বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দায়মুক্তি দিয়ে পুরস্কৃত করে জিয়াউর রহমান

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারের নির্মমভাবে হত্যার পর দেশের স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে খন্দকার মোশতাক। আর তাকে পেছন থেকে শক্তি জোগাচ্ছিলো সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষার জন্য সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে মোশতাক। এটি প্রথমে ১৯৭৫ সালের অধ্যাদেশ নং ৫০ নামে অভিহিত ছিল। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে নাটকীয় ভোটের মাধ্যমে নিজেকে দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণার পর এই অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করে জেনারেল জিয়াউর রহমান। সাজানো সংসদে এটিকে অনুমোদন করায় সে।

শুধু বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকারীদের সুরক্ষা দিতেই ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশ সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর ব্যবস্থা করে জিয়াউর রহমান। শুধু তাই নয়, এর আগে সেনাপ্রধান তথা সামরিক অবস্থার মধ্যে ডিফ্যাক্টো রাষ্ট্রপ্রধান থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের নিরাপদে বিদেশযাপনের ব্যাবস্থাও করে সে। এরপর রাষ্ট্রীয় অর্থ খরচ করে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মোটা বেতনে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করে। বঙ্গবন্ধুর যে ১২ খুনিকে বিদেশে চাকরি দিয়ে জিয়াউর রহমান পুরস্কৃত করেছিল, তাদের তালিকা দেওয়া হলো:

১. লে. কর্নেল শরিফুল হককে (ডালিম) চীনে প্রথম সচিব,
২. লে. কর্নেল আজিজ পাশাকে আর্জেন্টিনায় প্রথম সচিব,
৩. মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে আলজেরিয়ায় প্রথম সচিব,
৪. মেজর বজলুল হুদাকে পাকিস্তানে দ্বিতীয় সচিব,
৫. মেজর শাহরিয়ার রশিদকে ইন্দোনেশিয়ায় দ্বিতীয় সচিব,
৬. মেজর রাশেদ চৌধুরীকে সৌদি আরবে দ্বিতীয় সচিব,
৭. মেজর নূর চৌধুরীকে ইরানে দ্বিতীয় সচিব,
৮. মেজর শরিফুল হোসেনকে কুয়েতে দ্বিতীয় সচিব,
৯. কর্নেল কিসমত হাশেমকে আবুধাবিতে তৃতীয় সচিব,
১০. লে. খায়রুজ্জামানকে মিসরে তৃতীয় সচিব,
১১. লে. নাজমুল হোসেনকে কানাডায় তৃতীয় সচিব,
১২. লে. আবদুল মাজেদকে সেনেগালে তৃতীয় সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

এছাড়াও বঙ্গবন্ধুকে হত্যার অন্যতম দুই ক্রীড়নক মেজর ফারুক ও রশিদকে লিবিয়ায় থেকে বিলাসবহুল জীবনযাপনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছিল অবৈধ জিয়া সরকার। জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা লিবিয়ায় বসে বাংলাদেশে একের পর এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করে। উল্লেখ্য যে, ফারুক-রশিদ দুজন সম্পর্কে ভায়রা ভাই। আবার রশিদ সম্পর্কে খন্দকার মোশতাকের ভাতিজা। দুজনই আবার জিয়াউর রহমানের খুবই আস্থাভাজন কর্মকর্তা। তারা দুজনই পরবর্তীতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু হত্যার আগে একাধিকবার জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করা এবং অভ্যুত্থানের ব্যাপারে জিয়ার অনুমতি দেওয়ার কথা স্বীকার করেছে।

রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর পাকিস্তানিদের ক্ষতিপূরণ দেয় জিয়া

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের নিরপত্তা বলয়ে নিজেকে স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিন মাসেরও কম সময়ে ক্ষমতায় রাখতে সক্ষম হয় খন্দকার মোশতাক। এরমধ্যেই জিয়াউর রহমান নিজেকে সর্বেসর্বা হিসেবে পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। মুক্তিযোদ্ধা সেনাদের কোণঠাসা করে এবং পাকিস্তানফেরত অফিসারদের মাধ্যমে প্রশাসনের দখল নেয়। এরপরেই পাকিস্তানের সঙ্গে বিশেষ সমঝোতার জন্য তাহের উদ্দীন ঠাকুরকে ইসলামাবাদে পাঠায়। এমনকি বাংলাদেশবিরোধী অবস্থানের কারণে বঙ্গবন্ধু যাদের নাগরিকত্ব বাতিল করেছিলেন, তাদেরও নাগরিকত্ব ফেরত দেয় খুনি জিয়া।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেসব পাকিস্তানি শিল্পপতির সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রের অধীনে নিয়েছিলেন, পাকিস্তানকে খুশি করার জন্য জিয়াউর রহমান সেসব সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করে। এমনকি বাংলাদেশ যেসব ক্ষতিপূরণ দাবি করে আসছিল পাকিস্তানের কাছে, সেই জায়গা থেকেও সরে আসে সে। উল্টো পাকিস্তানকে ক্ষতিপূরণ দেয় সে।

জিয়ার হাত ধরেই দেশে উগ্রবাদীদের উত্থান

মুক্তিযুদ্ধকালে যারা বাঙালিদের খুন-ধর্ষণ-লুণ্ঠনে লিপ্ত হয়েছিল, তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময়কার দেশবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারের নির্মমভাবে হত্যার পর জিয়াউর রহমান সেসব দেশবিরোধী অপরাধীদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয় এবং তাদের দেশে ফেরার ব্যবস্থা করে। যার ফলে রাজাকারগুরু গোলাম আজমের দেশে ফেরার পথ সুগম হয়। এবং বাংলাদেশে ফিরে এসেই সে জামায়াতের রাজনীতি আবারো নতুন করে জাগিয়ে তোলে।

জিয়াউর রহমানের এই উদ্যোগের কারণেই ধর্মব্যবসায়ী মুসলীম লীগ, জামায়াত, নেজামে ইসলাম, আল বদর, আল শামসদের পুনরুত্থান ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশে। এছাড়াও সংবিধানের জাতীয় চারনীতিকেও ভূলুণ্ঠিত করে সে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধান থেকে উঠিয়ে দিয়ে দেশে উগ্রবাদীদের অবাধ পদচারণার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় খুনি জিয়া।

মুক্তিযুদ্ধকালে জিয়াউর রহমানের বিতর্কিত ভূমিকা

স্বাধীনতার আগে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে গোয়েন্দা বিভাগে প্রশিক্ষণ নেয় জিয়াউর রহমান। এরপর ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানি জান্তাদের বিশেষ গোয়েন্দা (আইএসআই)-এর কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করে সে। মুক্তিযুদ্ধের কয়েকমাস আগে তাদের বিশ্বাসভাজন সেনা হিসেবে চট্টগ্রামে অস্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে পোস্টিং দিয়ে পাঠানো হয় তাকে। ততোদিনে এই ভূখণ্ডে ব্যাপক অভিযান চালানোর পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে পাকিস্তানি জান্তারা। এটি মনে রাখতে হবে যে, এই জিয়াউর রহমানই একসময় পশ্চিম পাকিস্তানের আইএসআই-বস জেনারেল জিয়াউল হক (পরবর্তীতে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক)-এর অধীনে ক্যাপ্টেন হিসেবে গোয়েন্দা কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করত।

এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময়েও আইএসআই এর কয়েকজন বিশেষ কর্মকর্তার সঙ্গে মেজর জিয়ার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। একারণে অন্যান্য সেক্টর কমান্ডাররা রণাঙ্গণে উপস্থিত হয়ে নিয়মিত যুদ্ধে লিপ্ত হলেও জিয়াউর রহমান শাবরুম সেক্টরে ছিলেন পুরোপুরি নিস্ক্রিয়। যুদ্ধকালে তার বিতর্কিত ভূমিকার কারণে প্রধান সেনাপতি আতাউল গনি ওসমানী তাকে দুই বার কারণ দর্শানোর নোটিশ পর্যন্ত দিয়েছেন এবং বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত পর্যন্ত নিয়েছিরেন। এমনকি যুদ্ধকালে রিলিফ প্রদানের জন্য যেসব বিদেশি সহায়তা সংস্থা এদেশে এসেছিল, তাদের মধ্যে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্টও ছিল, তাদের সঙ্গেও যুদ্ধকালে ব্যক্তিগত যোগাযোগ গড়ে তোলে জিয়াউর রহমান। স্বাধীনতা-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে সেই যোগাযোগ আরও প্রকট হয়। বিশেষ করে সময়ের সাথে সাথে স্পষ্ট হয়ে পড়ে জিয়ার সঙ্গে মার্কিন দূতাবাস, সিআইএ এবং পাকিস্তানের আইএসআই-এর কানেকশান।

জিয়াউর রহমানের প্রতি বিদেশি সংস্থার আগ্রহের বিশেষ একটি কারণ ছিল। কারণটি হলো, বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে তার পাঠ করা স্বাধীনতার ঘোষণার কারণে তার নামের পরিচিতি। তবে জাতির সেই ক্রান্তিকালেও চতুরতা করার চেষ্টা করেছিল সাবেক আইএসআই অফিসার মেজর জিয়াউর রহমান। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতারা দিনব্যাপী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা লিফলেট হিসেবে বিতরণ করেন এবং নিজেরাও বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে সেই ঘোষণা প্রচার করেন রেডিওতে। এরপর প্রশিক্ষিত বাঙালি সেনাদের অনপ্রাণিত করার জন্য একজন সেনা কর্মকর্তাকে দিয়ে সেই ঘোষণা পাঠ করানোর সিদ্ধান্ত নেন তারা। তখন কোনো সিনিয়র অফিসার না থাকায় মেজর জিয়াউর রহমানকে ডেকে এনে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা পাঠ করতে বলেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এই সুযোগে জিয়া নিজের নামে সেই ঘোষণা পাঠের চেষ্টা করে। কিন্তু উপস্থিত নেতারা তাকে সঠিকভাবে সেই ঘোষণা পাঠ করতে বললে, পরে সে তা সংশোধন করে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকেই স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করে।

পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান যখন বাংলাদেশের ক্ষমতা কুক্ষিগত করলো, এরই একটা পর্যায়ে পাকিস্তানের ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত হয় তার আইএসআই-এর সাবেক বস জেনারেল জিয়াউল হক। এসময় জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সাবেক গুরু স্বৈরাচার জিয়াউল হকের ইচ্ছামতো বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবাদর্শে পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এজন্য জিয়াউর রহমানের সৈন্যদের জন্য ৫০ হাজার জোড়া জুতা ও মোজা উপহার দেওয়ার ঘোষণা দেয় জেনারেল জিয়াউল হক। এদিকে ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর শোনার পর উৎফুল্ল হয়ে ওঠে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশে ২৫ মার্চ কাল রাতে গণহত্যার অন্যতম কুশীলব জুলফিকার আলী ভুট্টো। এরপরই সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান ও মোশতাক আহমেদকে অভিনন্দন জানিয়ে জাহাজ ভর্তি করে উপহার হিসেবে চাল পাঠিয়ে দেয় সে। জিয়াউর রহমানও পাকিস্তানের সঙ্গে সুস্পর্ক রাখার প্রতিশ্রুতি দেয় সেসময়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *